প্রথম সিরিজ জয়ের সঙ্গে হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দে বাংলাদেশ
লিটন কুমার দাস ও আফিফ হোসেনের ব্যাটে উড়ন্ত শুরুর পরও হঠাৎই শঙ্কা জেঁকে ধরেছিল, চোখের পলকেই নেই তিন উইকেট। অনেকটা আকাশ থেকে মাটিতে পতনের মতো। মাঝারি লক্ষ্য পাড়ি দিতে নেমেও বাংলাদেশ তখন নড়বড়ে অবস্থায়। ওখান থেকে কিছুক্ষণ পথ দেখালেন তাওহিদ হৃদয়, শামীম হোসেন পাটোয়ারীকে নিয়ে বাকি কাজটুকু সারলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। জয়ের সঙ্গে আফগানিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দে মাতলো বাংলাদেশ।
রোববার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে বৃষ্টি আইনে আফগানিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতলো ঘরের মাঠের দলটি। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে প্রথমবারের মতো আফগানদের বিপক্ষে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ, মিললো প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার প্রশান্তিও। এ নিয়ে প্রথমবারের মতো টানা চারটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। ২০২২ সালে সংযুক্ত আবর আমিরাতের বিপক্ষে ২-০, গত মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০, একই মাসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জেতার পর আফগানদের বিপক্ষে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ।
বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা আফগানিস্তান ভালো শুরু করতে না পারলেও ইব্রাহিম জাদরান ও মোহাম্মদ নবীর ব্যাটে গতি পায়। এরপর আজমতউল্লাহ ওমরজাই ও করিম জানাতের ব্যাটে ১৭ ওভারে ৭ উইকেটে ১১৬ রান তোলে আফগানিস্তান। বৃষ্টি আইনে ১৭ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১১৯ রান। আফগানদের বোলিং বিবেচনায় এই সংগ্রহ পাড়ি দেওয়া কঠিন হওয়ার কথা থাকলেও লিটন কুমার দাস ও আফিফ হোসেন ধ্রুবর উদ্বোধনী জুটিতেই জয়ের রসদ মিলে যায় বাংলাদেশের। এ দুজনকে দ্রুত হারিয়ে বিপদে পড়লেও হৃদয়ের পর শামীমকে নিয়ে ৫ বল হাতে রেখেই দলকে জয় এনে দেন ম্যাচ ও সিরিজ সেরার পুরস্কার জেতা সাকিব।
রনি তালুকদার একাদশে না থাকায় উদ্বোধনী জুটিতে পরিবর্তন এনে লক্ষ্য তাড়া করতে নামে বাংলাদেশ। লিটন কুমার দাসের সঙ্গে ওপেন করেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। শুরুটা দাপুটে হয় বাংলাদেশের, আফিফকে এক পাশে রেখে ঝড় তোলেন লিটন। প্রথম ওভারে ফজলহক ফারুকীকে ২টি চার মারা লিটন দ্বিতীয় ওভারে মারেন ৩টি চার। দ্বিতীয় ওভারের ১৯ রানসহ দুই ওভারে বাংলাদেশের স্কোরকার্ডে জমা হয় ২৮ রান।
এরপর আফিফও দারুণ ব্যাটিং শুরু করেন। পাওয়ার প্লের ৬ ওভার থেকে ৫৪ রান তোলেন এই দুই ব্যাটসম্যান। এখানে লিটনের অবদান বেশি, ২৪ বলে ৩১ রান করেন তিনি। আফিফ করেন ১২ বলে ১৫ রান। দারুণ শুরুর ধারা বজায় রেখে ব্যাট চালিয়ে যেতে থাকেন লিটন-আফিফ, ৮ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরকার্ডে জমা হয় ৬৬ রান।
এরপর হঠাৎই রান তোলার গতি কমে যায়, নবম ওভারে মাত্র ১ রান খরচা করেন আজমতউল্লাহ ওমরজাই। এরপরের ওভারে এলেমেলো বাংলাদেশ। এক বলের ব্যবধানে লিটন ও আফিফকে ফিরিয়ে দেন আফগান অফ স্পিনার মুজিব-উর-রহমান। লিটন ৩৬ বলে ৬টি চারে ৩৫ ও আফিফ ২০ বলে ২টি ছক্কায় ২৪ রান করে আউট হন।
এক ওভারে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া দলকে পথ দেখাতে শুরু করেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়ের নায়ক হৃদয়। যদিও এই জুটিতে স্বস্তি মেলেনি। দলীয় ৭৬ রানে আজমতউল্লাহর স্টাম্পে করা সহজ ডেলিভারিতে বোল্ড হন ৬ বলে ৪ রান করা শান্ত। দ্রুত তিন উইকেট হারালেও দলকে চাপ বুঝতে হয়নি। হৃদয় ও সাকিব মিলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
চতুর্থ উইকেটে ২০ বলে ৩১ রান যোগ করেন এ দুজন। ১৭ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৯ রান করা হৃদয়ের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। শামীমকে নিয়ে জয় তুলে নেওয়ার কাজটি সারেন সাকিব। ১১ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৮ রানে অপরাজিত থাকেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। শেষ ওভারের প্রথম বলে চার মেরে জয় তুলে নেওয়া শামীম ৭ বলে ৭ রান করেন। আফগানিস্তানের মুজিব ও আজমতউল্লাহ ২টি করে উইকেট নেন।
এর আগে ব্যাটিং করতে নামা আফগানিস্তানের ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ তেড়েফুঁরে শুরু করেন। তাসকিন আহমেদের করা ইনিংসের প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে ছক্কা মারেন তিনি। পরের বলেও বাউন্ডারি মারতে যান গুরবাজ, এবার আর টাইমিং হয়নি। তাসকিনের বাউন্সার টেনে খেলতে গিয়ে আকাশে ক্যাচ তুলেন তিনি, যা তাসকিন নিজেই তালুবন্দী করেন।
এই উইকেটে সাকিব ও মুস্তাফিজুর রহমানের পর তৃতীয় বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। আফগানদের দ্বিতীয় উইকেট নিতেও দেরি করেননি আগুনে বোলিং করতে থাকা তাসকিন। নিজের দ্বিতীয় ওভারে গতিময় এক্সট্রা বাউন্সে হজরতউল্লাহ জাজাইকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন তিনি।
এরপর আফগানদের প্রতিরোধ, দলকে পথ দেখাতে থাকেন ইব্রাহিম জাদরান ও অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবী। ৭.২ ওভারে ২ উইকেটে ৩৯ রান তোলার পর সিলেটে শুরু হয় বৃষ্টি। দেড় ঘণ্টা বিরতির পর খেলা শুরু হয়, তবে তিন ওভার কমিয়ে দেওয়া হয়। শুরুটা ভালো হয়নি, রানও ওঠেনি। তাই মারকুটে মেজাজে শুরু করার চেষ্টা করেন ইব্রাহিম ও নবী।
যদিও সেভাবে ব্যাটে-বলে করতে পারছিলেন না তারা। অষ্টম ওভারে ক্যাচ তুলেও বেঁচে যান ইব্রাহিম। নাসুমের করা ইনিংসের নবম ওভারে দুটি ক্যাচ তুলে বেঁচে যান নবীও। সাকিব মিস করার পরের বলেই ক্যাচ ছাড়েন উইকেটরক্ষক লিটন। জীবন ফিরে পাওয়ার সুবিধা অবশ্য কাজে লাগাতে পারেননি নবী, দশম ওভারে মুস্তাফিজের শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ২২ বলে একটি চারে ১৬ রান করেন তিনি।
পরের বল থেকেই অবশ্য ঝড় ওঠে। উইকেটে গিয়েই মুস্তাফিজকে চার মারেন নাজিবুল্লাহ জাদরান। এক রান নিয়ে ইব্রাহিমকে স্ট্রাইক দিলে তিনি মারেন ছক্কা। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা এই জুটি ভাঙেন সাকিব, ১১তম ওভারের প্রথম বলে তার শিকার ইব্রাহিম। ২৭ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ২২ রান করেন আফগান এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান।
এই ওভারের শেষ বলে ৫ রান করা নাজিবুল্লাহর স্টাম্প উপড়ে নেন সাকিব। পরের ওভারে নাসুমের খরচা পাঁচ রান। কিন্তু ১৩তম ওভারটি খরুচে করেন হাসান মাহমুদ। তার ওভার এই থেকে ১৬ রান পায় আফগানরা, আগের ম্যাচে ঝড় তোলা আজমতউল্লাহ ওমরজাই একটি করে ছয় ও চার মারেন। তাসকিনের করা ১৪তম ওভারে একটি করে চার ও ছক্কা মারেন আগের ম্যাচের হ্যাটট্রিকম্যান করিম জানাত, এই ওভার থেকে যায় ১২ রান।
পরের ওভারে দারুণ বোলিংয়ে মাত্র ৩ রান খরচা করেন মুস্তাফিজ, নেন ২১ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ২৫ রান করা আজমতউল্লাহর উইকেটও। শেষ ওভারের প্রথম চার বলে মাত্র এক রান খরচা করেন তাসকিন। ফেরান ১৫ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ২০ রান করা করিম জানাতকে। কিন্তু পঞ্চম বলে বিশাল ছক্কা মারেন অধিনায়ক রশিদ খান। তাসকিন ৪ ওভারে ৩৩ রানে ৩টি উইকেট নেন। মুস্তাফিজ ৩ ওভারে ৩০ রানে ২টি ও সাকিব ৩ ওভারে ১৫ রানে ২টি উইকেট নেন।