ঘরের মাঠের ভারতকে হোয়াইটওয়াশ করে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস
তখন ভরসা তিনি নিজেই, রক্ষণাত্মক খেলে উপায় মিলবে না; ততোক্ষণে বুঝে ফেলেছেন ওয়াশিংটন সুন্দর। নিউজিল্যান্ডের স্পিনার এজাজ প্যাটেলের বলে স্লগ সুইপ করতে গেলেন তিনি, কিন্তু ব্যাটে-বলে হলো না। বল ভেঙে দিলো স্টাম্প। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নিরাবতা। কিন্তু মাঠের ভেতরে ঠিক উল্টো চিত্র। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা তখন উল্লাসে মত্ত, ইতিহাস লেখার অপার আনন্দে কিছুক্ষণ চললো তাদের বুনো উদযাপন।
এই উদযাপনও তাদের কাছে কম মনে হতে পারে। ভারতের ঘরের মাঠে টেস্ট ইতিহাসে কোনো দল যা করতে পারেনি, নিউজিল্যান্ড সেটা করেছে দুর্দোণ্ড প্রতাপের সাথে। 'সর্বজয়ী' ভারত ঘরের মাঠে সব সময়ই অপ্রতিরোধ্য, দুর্বার; সেই তাদেরকেই তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করেছে কিউইরা। সিরিজের শেষ টেস্টে ভারতকে ২৫ রানে হারিয়ে এই সফরে সাফল্যের মালা গাঁথা শেষ করে তারা। ১১ উইকেট নিয়ে এই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের নায়ক এজাজ, ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে তার ঝুলিতেই।
ভারতের জন্য সিরিজটা নিশ্চিতভাবেই দুঃস্বপ্নের। ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজে কখনও তাদের এমন দশা হয়নি। সর্বশেষ ১২ বছর আগে টেস্ট সিরিজ হেরেছিল তারা। কিন্তু তিন বা এর বেশি ম্যাচে ঘরের মাঠে কখনই ভারত হোয়াইটওয়াশ হয়নি। এবার তাদেরকে সেই তেতো স্বাদই দিলো সফরকারী নিউজিল্যান্ড। মুম্বাইয়ে বিজয় কেতন ওড়ানোর আগে প্রথম দুই টেস্টেও দাপট দেখিয়েছে জেতে তারা। প্রথম টেস্টে বেঙ্গালুরুতে কিউইরা জেতে ৮ উইকেটে, দ্বিতীয় টেস্টে পুনেতে জয় পায় ১১৩ রানে।
ভারতের জন্য সিরিজটা যতোটা হতাশার, নিউজল্যান্ডের জন্য ততোটাই আনন্দের। হোয়াইটওয়াশ করা তো দূরের কথা, এর আগে ভারতের মাটিতে কখনও সিরিজই জিততে পারেনি তারা। ৭০ বছরে ১২ বার ভারত সফরে গিয়ে প্রতিবারই হতাশা নিয়ে দেশে ফিরতে হয় নিউজিল্যান্ড। আগের ৩৬ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের জয় ছিল কেবল দুটিতে। এবার তিন ম্যাচের তিনটিতেই জয়, সিরিজ জয়ের পাশাপাশি সব জেতার আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরবেন ল্যাথাম, এজাজ, ইয়াংরা।
সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টেস্টে টস জিতে আগে ব্যাটিং করে নিউজিল্যান্ড। ড্যারিল মিচেল ও সিরিজ সেরা উইল ইয়াংয়ের দারুণ দুটি ইনিংসের পরও ২৩৫ রানে থামে কিউইরা। এই ইনিংসে বল হাতে ভারতকে পথ দেখান রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও ওয়াশিংটন সুন্দর। অশ্বিন ৫টি ও সুন্দর ৪টি উইকেট নেন। জবাবে শুভমান গিল ও ঋষভ পন্তের হাফ সেঞ্চুরি ও দুটি ছোট ইনিংসে ভারত তোলে ২৬৩ রান। প্রথম ইনিংসে ২৮ রানের লিড পায় স্বাগতিকরা। কিউই স্পিনার এজাজ নেন ৫ উইকেট।
দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ আরও ছোট হয়। ৫ উইকেট নেওয়া রবীন্দ্র জাদেজা ও ৩ উইকেট পাওয়া অশ্বিনের বোলিংয়ের সামনে ১৭৪ রানেই গুটিয়ে যায় সফরকারী দলটির ইনিংস। প্রথম ইনিংসের পিছিয়ে পড়ায় তাদের লিড দাঁড়ায় ১৪৬ রান। ভারত ১৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে ২৯ রানেই ৫ উইকেট হারায়। এমন বিপর্যয়ের পরও দাপুটে ব্যাটিং শুরু করা পন্ত ৫৭ বলে ৬৪ রান করেন। কিন্তু তিনি ফিরতেই মিলিয়ে যায় ভারতের জয়ের আশা, তাদের ইনিংস শেষ হয় ১২১ রানে। আগের ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া এজাজের শিকার এবার ৬ উইকেট। এ নিয়ে ইনিংসে ১৫ বার পাঁচ উইকেট নিলেন তিনি, ম্যাচে ১০ উইকেট তৃতীয়বার।
যে মাঠে স্পিন ঘূর্ণিতে ভারতের ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল অবস্থা করে ছাড়লেন এজাজ, এই মাঠে তার আরও বড় কীর্তি আছে। ২০২১ সালের সফরে ইতিহাসের তৃতীয় বোলার হিসেবে ইনিংসে ১০ উইকেট নেন তিনি। আরেক ইনিংসে পান ৩ উইকেট, কিন্তু ১৪ উইকেট নিয়েও সেবার দলকে জেতাতে পারেননি। এবার নিজের জন্মস্থানে তিনি উইকেট বৃষ্টি নামালেন, দলকে জিতিয়ে প্রতিপক্ষকে ডোবালেন হোয়াইটওয়াশের হতাশায়। ১৯৮৮ সালে মুম্বাইয়ের এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন এজাজ, ভাগ্যের ফেরে এখন তিনি নিউজিল্যান্ডের। বিদেশি বোলারদের মধ্যে মুম্বাইয়ে সর্বোচ্চ ২৫ উইকেট এখন তার, ছাড়িয়ে গেছেন ২২ উইকেট নেওয়া ইয়ান বোথামকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ২৩৫
ভারত প্রথম ইনিংস: ২৬৩
নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস: ১৭৪
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস: (লক্ষ্য ১৪৭) ২৯.১ ওভার ১২১ (জয়সওয়াল ৫, রোহিত ১১, গিল ১, কোহলি ১, পন্ত ৬৪, সরফরাজ ১, জাদেজা ৬, ওয়াশিংটন ১২, অশ্বিন ৮, আকাশ ০, সিরাজ ০*; হেনরি ১/১০, এজাজ ৬/৫৭ , ফিলিপস ৩/৪২)।
ফল: নিউজিল্যান্ড ২৫ রানে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে নিউজিল্যান্ড ৩-০ ব্যবধানে জয়ী
ম্যাচ সেরা: এজাজ প্যাটেল
সিরিজ সেরা: উইল ইয়াং