বিস্ময়বালক প্রজ্ঞানন্দে ভারতীয় দাবার ফিরে আসা
ভারতের প্রতিভাবান দাবাড়ু রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দের বিশ্বকাপ যাত্রা ট্রফি জয় ছাড়াই শেষ হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসরজুড়ে এই বিস্ময়বালকের দুর্দান্ত সব পারফরম্যান্স দেশটির দাবা খেলায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। খবর বিবিসির।
আজারবাইজানে ফিদে দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় প্রজ্ঞানন্দ ও বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা কার্লসেনের মধ্যে। প্রথম দুই গেম ড্র হয় প্রথম দুদিনে। লড়াই গড়ায় টাইব্রেকারে। তিনদিন ধরে চলা ফাইনালের ফলাফল মেলে গত বৃহস্পতিবার টাইব্রেকারের মধ্য দিয়ে। সেখানে প্রথম দুই রাউন্ড হেরে রানার্সআপ হন প্রজ্ঞানন্দ।
ফাইনালে হেরে গেলেও বিশেষজ্ঞরা বাকুতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ জুড়ে তরুণ প্রজ্ঞানন্দের দৃঢ়তা এবং ব্যতিক্রমী দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একইসাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ প্রজ্ঞানন্দের 'উল্লেখযোগ্য' পারফরম্যান্স ও 'কঠিন লড়াই' করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
টুর্নামেন্টে ১৮ বছর বয়সী প্রজ্ঞানন্দের প্রশংসনীয় ফলাফল লাভে অবশ্য তাকে দীর্ঘ পথ পারি দিতে হয়েছে। ফাইনালে জায়গা করে নিতে তাকে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের দাবাড়ুদের পরাজিত করতে হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০০২ সালে বিশ্বনাথন আনন্দের পর প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেন তিনি।
শুধু তাই নয়, প্রজ্ঞানন্দ দাবা বিশ্বকাপের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছেন। আর আসরটির ইতিহাসে প্রতিযোগী হিসেবে এই তরুণ তৃতীয় কনিষ্ঠতম ব্যক্তি।
এ সম্পর্কে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কলামিস্ট ও দাবাড়ু দেবাংশু দত্ত বলেন, "প্রজ্ঞানন্দের কৃতিত্ব দাবার জগতে তার সুনাম বাড়িয়েছে। এর ফলে তরুণ দাবাড়ুদের অনুপ্রাণিত করার সাথে সাথে খেলাটিতে একটি প্রজন্মগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। এটি ভারতের জন্য বেশ ইতিবাচক হবে।"
সদ্য অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারতীয় দাবাড়ুদের বেশ আধিপত্য ছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেওয়া আটজন দাবাড়ুর মধ্যে চার জনই ছিল ভারতের; যা একক দেশ হিসেবে ৫০ শতাংশ।
বর্তমানে জুনিয়র দাবাড়ুদের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১০০ জনের মধ্যে ২১ জনই ভারতীয় দাবাড়ু। এদের সকলের বয়স ২০ বছরের নিচে। এদের মধ্যে আবার শীর্ষ ১০ এ রয়েছেন চারজন আর শীর্ষ ২০ এ রয়েছেন সাতজন ভারতীয়।
এ সম্পর্কে দেবাংশু দত্ত বলেন, "ভারতের এই তরুণ দাবাড়ুরা আগামী এক দশক কিংবা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে দাবার মঞ্চে নিজেদের আধিপত্য প্রকাশ করবে।"
প্রজ্ঞানন্দের সফলতার ফলে ভারতীয়দের দাবা খেলার প্রতি আরও বেশি ঝোঁক বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন। কেননা ২০০০ এর দশকেও ঠিক এমন ঘটনাটিই ঘটেছিল। ২০০২ সালে বিশ্বনাথ আনন্দের বিশ্বকাপ জয়ের পর দাবার প্রতি ভারতীয়দের মধ্যে বেশ আগ্রহের জন্ম নিয়েছিল।
বর্তমানে ভারতে স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা ও সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট প্রাপ্তির সুযোগে ভারতীয়রা অনলাইনে নানা অ্যাপসে দাবা খেলছেন; নানা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করছেন।
এছাড়াও ইন্টারনেটে চাইলেই দাবার ব্যাসিক কোচিংয়ের সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এইসব সুবিধা লাভ অকল্পনীয় ছিল।
এ সম্পর্কে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের স্পোর্টস রাইটার সুসান নিনান বলেন, "আনন্দের বিশ্বকাপ জেতার দুই দশক পরেও যেসব ভারতীয় দাবাড়ুরা আসরে বাজিমাত করেছেন, তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই কোনো গ্র্যান্ডমাস্টারের অধীনে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির কোনো সুবিধা ছিল না।"
এক্ষেত্রে আনন্দের বিশ্বকাপ জয় ভারতে দাবার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল, এটা যেমন সত্য। ঠিক তেমনিভাবে বিশেষজ্ঞদের মতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাবাড়ুদের আরও বড় মাইলফলক স্পর্শ করতে ভারতের আরও উদ্যোগী হতে হবে।
বর্তমানেও ভারতে পেশাদার দাবাড়ুদের সুযোগ-সুবিধায় বেশ ঘাটতি রয়েছে। এমনকি ক্ষুদে দাবাড়ুদের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবককেই অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
এ সম্পর্কে সুসান নিনান বলেন, "ভারতে এখনো একদল অদম্য অভিভাবক রয়েছে যারা দাবার জগতে সন্তানদের স্বপ্ন পূরণের জন্য চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে, সন্তানদের স্কুলের থেকেও দাবাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, নিজেদের বাড়ি বন্ধক দিয়েছে এবং ৮-১৫ বছর বয়সী সন্তানদের সাথে টুর্নামেন্টে সঙ্গ দিতে ভ্রমণ করছেন।"
দাবার জগতে দাবাড়ু প্রজ্ঞানন্দের পথচলাও খুব একটা সহজ ছিল না। পেশায় তার বাবা ছিলেন একজন ব্যাংক ম্যানেজার আর মা ছিলেন গৃহিণী। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার পিতামাতাকে ছেলের খেলা চালিয়ে যেতে অর্থ ধার করতে হতো।
২০১৬ সালে প্রজ্ঞানন্দ দাবায় বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এরপরেই স্পন্সরের আদলে তিনি সাহায্য পেতে থাকেন।
পেশাদার দাবাড়ু হওয়ার পেছনে প্রজ্ঞানন্দের বোনই তাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তারা দুজনেই তাদের পরিবারে প্রথম প্রজন্মের দাবাড়ু। বৈশ্বিক আসরগুলোতে এখনো প্রজ্ঞানন্দের মা তার সাথে ভ্রমণ করেন। আসরজুড়ে এই দাবাড়ুর জন্য পছন্দের তামিল খাবার প্রস্তুত করেন মা।
তরুণ বয়সেই প্রজ্ঞানন্দের শীর্ষে উত্থান অনেক ভারতীয় দাবাড়ুদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। তার এই অর্জনের পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, প্রতিভা এবং সম্ভবত কিছুটা ভাগ্য।
এ সম্পর্কে দেবাংশু দত্ত বলেন, "প্রজ্ঞানন্দ হয়তো ফাইনালে হেরে গিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে ভারতের জয়যাত্রা হয়তো মাত্র শুরু হয়েছে।"