পাকিস্তানের বিপক্ষে এবার কলকাতার মানুষের সমর্থন পাবে বাংলাদেশ?
প্রতিবেশি দুই দেশ; বাংলাদেশ ও ভারত। দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্কই বাংলাদেশের। তবে একেবারে গা ঘেঁষা হওয়ায় বেশি সখ্য কলকাতার সঙ্গে। ভারতের এই শহরটির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানতম মিল ভাষায়, দুই জায়গার মানুষই বাংলায় কথা বলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবন ধারণসহ আরও অনেক কিছুতেই আছে মিল। সম্পর্কের টান বুঝাতে অনেকে এপাড়-ওপাড় বাংলাও বলে থাকেন।
এপাড়-ওপাড় বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, একটি অংশেরই দুটি পাড় বা দিক। সেটা হলে যেকোনো বিষয়েই একে অপরের সমর্থন পাওয়ার কথা, কিন্তু বৈপরীত্য আছে। সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য ক্রিকেটে, নির্দিষ্ট করে বললে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন এই শহরটিতে খেলতে এসে কলকাতা মানুষের সমর্থন প্রত্যাশা করে, তখনই ফুটে ওঠে বৈপরীত্য। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচেও ইডেন গার্ডেন্সে বসে বাংলাদেশের বিপক্ষে গলা ফাটান কলকাতার অনেক মানুষই!
এটা পুরনো ঘটনা, এই চিত্র বুঝতে কয়েক বছর আগে ফিরতে হবে। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেন্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। ম্যাচের আগেরদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটার, বিসিবির কর্তা, এমনকি সাংবাদিকরাও কলকাতার মানুষের সমর্থন পাওয়ার আশার কথা জানান। কিন্তু ম্যাচে দেখা যায় উল্টো চিত্র। কানায় কানায় ভরে ওঠা ইডেনের গ্যালারি থেকে বাংলাদেশ তেমন সমর্থনই পায়নি। বাংলাদেশের উইকেট পতন বা পাকিস্তানের চার-ছক্কায় উল্লাসে ফেটে পড়ে গ্যালারি। তাতে বাংলাদেশ থেকে খেলা দেখতে আসা সমর্থকদের আওয়াজ চাপাই পড়ে যায়।
এবারও এমনই আভাস মিলেছে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কলকাতার দর্শকদের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এখানকার সামান্য সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে হাততালি দিয়েছেন। ইডেন গার্ডেন্সে সাংবাদিকদের কাজের স্থান প্রেসবক্সের নিচের গ্যালারিতে বসা বেশিরভাগ কলকাতার দর্শক ডাচদের সমর্থন যুগিয়েছেন। সৌজন্য টিকেট নিয়ে খেলা দেখতে আসা এসব দর্শক বাংলাদেশকে রীতিমতো 'প্রতিপক্ষ' হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। সাকিব-মুশফিকদের সমর্থন দেওয়া বেশিরভাগ দর্শকই বাংলাদেশ থেকে আসা।
পাকিস্তানের বিপক্ষে এই চিত্রটা বেশি করে ফুটে ওঠে। যে দেশটির সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বহুদিনের, ক্রিকেটসহ সব খেলায় চিরদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা; সেই দেশটির সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশ সমর্থন পাবে, সবার ভাবনা এমনই। কিন্তু মাঠে গিয়ে উল্টো চিত্র দেখায় অনেকেই সেবার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। এবারও তাদের শঙ্কা, কলকাতাবাসীর সমর্থন মিলবে না। ঢাকা থেকে খেলা দেখতে আসা রাজিব আহমেদ বললেন, 'সেবারের গল্প পত্রিকায় পড়েছি, এবার আমাদের আগে থেকেই তেমন মনে হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বলতে গেলে এখানকার কেউ-ই বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি।'
পাকিস্তানের বিপক্ষে কলকাতায় কেন সমর্থন পায় না বাংলাদেশ? চন্দন নাথ নামের এক ট্যাক্সি ড্রইভার মনে করেন, এটার জন্য বাংলাদেশের সমর্থকরা দায়ী। বাংলাদেশের মাদারীপুরে চন্দনের বাবার জন্ম, সেই সুবাদে তিনি ভারত ছাড়া অন্য দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশকেই সমর্থন দেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমর্থকদের কারণে সমর্থন দিতে ইচ্ছা করে না ক্রিকেটপাগল চন্দনের, 'আমি এখনও সমর্থন করি বাংলাদেশকে। কিন্তু কলকাতার অন্যরা কেন সমর্থন দেবে! কলকাতা তো ভারতের অংশ, আর সেই দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল করে বাংলাদেশের সমর্থকরা। কোহলির মতো ক্রিকেটারকে নিয়ে ট্রল করতে দেখেছি আমি। আমার কাছে মনে হয় সমর্থন না দেওয়ার এটাই বড় কারণ।'
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। এই দুই দলের মধ্যকার ম্যাচ রূপ নিয়েছে ঝাঁঝালো লড়াইয়ে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে দর্শকদের মধ্যে সেটা কাজ করে বলে মনে করেন শুভম চ্যাটার্জি নামের এক ব্যবসায়ী, 'বাংলাদেশ এখন ভারতকে ছেড়ে কথা বলে না, হারিয়েও দেয়। এটা ভারতীয় সমর্থকদের ভালো লাগার কথা নয়। এটায় এই ম্যাচের ঝাঁঝ বেড়েছে, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যেও চলে লড়াই। গত কয়েক বছরে ম্যাচটি নিয়ে চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং সমর্থকদের মাঝে ট্রল, সমালোচনার লড়াইয়ের কারণে এমন হয়েছে। আমার ধারণা বাংলাদেশের সমর্থকরাও ভারতের বিপক্ষ দলকেই সমর্থন করে।'
এবারও বাংলাদেশ সমর্থন পাচ্ছে না, এমনকি কাল পাকিস্তান ম্যাচে হয়তো আরও কম সমর্থন মিলবে। এটার কারণ হিসেবে উত্তরবঙ্গ সংবাদের জৈষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিবেদক অরিন্দম মুখোপাধ্যায় অবশ্য বাংলাদেশ দলকে দায় দিচ্ছেন, 'নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ইডেনের ৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে। হ্যাঁ, এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তবে কলকাতার মানুষও ছিল। আবার কলকাতা ভারতের পাসপোর্টধারী এমন মানুষও দেখেছি, যারা বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়নি। কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।'
'পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন থাকবে, পাকিস্তানেরও থাকবে। নেদারল্যান্ডসের চেয়ে পাকিস্তান ম্যাচে বাংলাদেশ যদি সমর্থন কম পায়, সেটা তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও দলের মধ্যকার বিতর্কের কারণে। সাকিবদের সেই রকম পারফরম্যান্স নেই। সাকিব সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তামিমের অনুসারী দলে থাকতে পারে, সেটারে কারণে পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়তে পারে। এটা তো অন্তর্ঘাতের কথা। জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে, সেটা বুঝতে হবে পারফরম্যান্সের কারণে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২৩০ রান তাড়া না করতে পারলে তো সমর্থন হারাবেই। হয়তো সেটারই প্রভাব।' বলেন তিনি।
ইটিভি ভারতের জৈষ্ঠ প্রতিবেদক সঞ্জয় অধিকারী আরেকটু গভীরে গেলেন, 'দুটো কারণ হতে পারে। একটি হচ্ছে, অনেকেই হয়তো মনে করে তারা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে, তারা এখন আলাদা দেশ, ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র। এই কারণে সমর্থন করব না। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, এখানকার বাঙালিরা মনে করেন ওখানকার মানুষ এসে এখানকার সংস্কৃতি ডমিনেট করছে, তো তাদেরকে যেখানে পাওয়া যায়, দমিয়ে রাখতে হবে।'
'এই কারণেই ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচে কলকাতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। এর বাইরে আরও অনেক কিছু্ বিবেচনা করা হয়ে থাকতে পারে। কোথাও যেন বিভেদ রয়ে গেছে, যা সম্প্রতি আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবও থাকতে পারে। সীমান্ত সমস্যা, তিস্তা সমস্যা, ইলিশ নিয়ে সমস্যা; এসবও কারণ হতে পারে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বাংলাদেশের হারের পর ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মোহনবাগানের সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে, 'আজ তো ওদের পূর্ব পুরুষরা হেরে গেল।' যা আমার চোখে পড়েছে।' যোগ করেন তিনি।
আরও কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'পাকিস্তানকে বেশি সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে বলব, এপাড় বাংলার বাঙালিরা কিন্তু সেভাবে সমর্থন করছে না। আমি এটা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। কারণ এখানে এখনও কিছু কিছু জায়গায় কিছু মানুষের মনে পাকিস্তান নিয়ে টান আছে যে, 'হ্যাঁ আমরা পাকিস্তান, পাকিস্তান হয়ে যাই।' পাকিস্তান মুসলিম দেশ, হ্যাঁ, বাংলাদেশও তাই। কিন্তু ধর্মীয় মেরুকরণের হাল্কা প্রভাব হলেও এখানে আছে। এ কারণেই হয়তো পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলতে নামলে বাংলাদেশ কম সমর্থন পায়, আমার কাছে এমনই মনে হয়। এ ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াটাও একটা কারণ। কোহলি-রোহিতকে নিয়ে ট্রল করলে নিশ্চয়ই এখানকার মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে না।'
'আবার কিছু মানুষ আছে, যারা বিশ্বাস করে 'আমরা ওদেরকে টেস্ট মর্যাদা দিতে সাহায্য করেছি, ওরা তো এক সময় সিএবি'র বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে খেলতো, আমাদের বাংলা দল গিয়ে ঠেলে ওদের এগিয়েছে।' সেই দল এখন আমাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে খেলছে, এটা অনেকেরই হজম করতে একটু অসুবিধা হয়। সেই বিক্রিত মানসিকতা থেকেই কেউ কেউ বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এদের মধ্যে ক্রিকেটীয় ভালোবাসা থাকে না, হয়তো দেশপ্রেমও থাকে না। কেউ উঠে আসছে, তাকে স্বাগত জানানোর যে উদার মানসিকতা দরকার, সেটা তাদের নেই।' বলেন তিনি।
কলকাতার মানুষের থেকে বেশি সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা এবারও নেই, পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সমর্থনও হারাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে যারপরনাই হতাশ খেলা দেখতে কলকাতায় আসা সমর্থকরা। এদের কেউ কেউ এতোটাই ক্ষুব্ধ যে, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের টিকেট কাটার পরও দেশে ফিরে গেছেন। এদের মধ্যে একজন সরকারী বাংলা কলেজের অনার্স পড়ুয়া তুহিন সরকার, 'খুবই হতাশ, কী বলব। দল হারতেই পারে, তাই বলে এভাবে! অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এক ম্যাচ বাকি রেখেই চলে যাচ্ছি। টিকেটটা সুভেনির হিসেবে রেখে দিবো।'
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে আউট হওয়ার পর সাকিবকে দুয়োধ্বনি শুনতে হয়। পুরো বাংলাদেশ দলকে উদ্দেশ্য করে ভক্ত-সমর্থকরাই বলতে থাকে, 'ভুয়া, ভুয়া।' বাংলাদেশের আইকনিক সমর্থক শোয়েব আলী বলেন, 'ছবি বসিয়ে সবার নামে কুর্তা বানিয়ে এনেছিলাম, ম্যাচের আগে কাড়াকাড়ি ছিল কে সাকিব ভাইয়েরটা পরবে, কে মুশফিক ভাইয়েরটা। কিন্তু ম্যাচের পর সবাই সেসব গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে যায়। আমি কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি।' ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক সমর্থক নিজের জুতা নিজের মুখে মেরে দলকে নিয়ে চরম হতাশার কথা বলছেন। অনেককে কাঁদতে কাঁদতেও মাঠ ছাড়েন।