মহাবিশ্বের নক্ষত্রের চেয়েও বেশি ভাইরাস পৃথিবীতে, কিন্তু সব ভাইরাস দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয় না কেন?
করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণে বিপর্যস্ত সম্পূর্ণ পৃথিবী। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের মতো আরও অসংখ্য ভাইরাসের মধ্যেই আমাদের বসবাস। তবে পৃথিবীতে বিদ্যমান ভাইরাসের সম্ভাব্য সংখ্যা শুনলে মনে হবে, মানুষের নয় বরঙ ভাইরাসের পৃথিবীতেই আমাদের বসবাস। পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ ননিলিয়ন ভাইরাস আছে (১ ননিলিয়নে ১ এর পর ৩০টি শুন্য থাকে)। এই বিপুল সংখ্যক ভাইরাসের ক্ষুদ্রাংশও যদি মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতো বা মানবদেহে সংক্রমণ ঘটানোর মতো বৈশিষ্ট্যধারী হতো, তবে পৃথিবীতে মানব জাতির টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিলনা।
ভাইরাস সাধারণত পোষকদেহ ছাড়া নিষ্ক্রিয় থাকে, জীবদেহ ছাড়া ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা। তবে আমাদের পরিবেশে অসংখ্য ভাইরাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার পরও ভাইরাসভর্তি পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারার কারণ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নয়।
ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডারের একজন ভাইরোলজিস্ট সারা সোয়ার জানান, মূলত ভাইরাসগুলো তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায় না। এই এককোষী অণুজীবগুলো তাদের পোষকদেহ নির্ধারণের ব্যাপারে অন্যান্য অণুজীব থেকে আলাদা, আমাদের চারপাশের অসংখ্য ভাইরাসের অতি ক্ষুদ্রাংশ-ই আমাদের জন্য ক্ষতিকর।
তবে কোভিড-১৯ মহামারির পর এটি স্পষ্ট যে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন নিত্যনতুন ভাইরাসের আবির্ভাব হয় প্রায়শই। ভবিষ্যতে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে তাই বিজ্ঞানীরা মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে কেন শুধু নির্দিষ্ট কিছু ভাইরাসই মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়। কিছু ভাইরাসের খুব দ্রুত মিউটেশন হয়, ফলে তারা বিভিন্ন প্রজাতির জীবে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রাণী থেকে মানুষের সংস্পর্শেও অনেক ভাইরাস তাদের পোষকদেহ পরিবর্তন করতে পারে। মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিজিজ ইকোলজিস্ট রায়না প্লোরাইট জানান, মানদেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে মহামারির সৃষ্টি করতে পারে এমন ভাইরাসগুলোর আলাদা ধরণ আছে এবং এই নির্দিষ্ট ধরণ অনুমানযোগ্য।
মানবদেহের বেশিরভাগ সংক্রামক রোগই কোভিড-১৯ এর মতোই ছড়ায়। এই রোগগুলোর বেশিরভাগই জুনোসিস বা পশু-পাখি থেকে মানদেহে ছড়াতে পারে এমন রোগ। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর স্তন্যপায়ী ও পাখিরা অন্তত ১.৭ মিলিয়ন অনাবিষ্কৃত ভাইরাসের আবাসস্থল। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা পরবর্তী সম্ভাব্য মহামারির ব্যাপারে ধারণা পেতে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করছেন।
সফলভাবে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির জীবদেহে আশ্রয় নিয়ে সংক্রমণ ঘটাতে ভাইরাসকে বেশকিছু বাধা পার করতে করতে হয়। ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট জেমা জিওঘেগান জানান, ভাইরাসকে প্রথমে তার পোষকদেহ থেকে বের হয় অন্য জীবের সংস্পর্শে আসতে হয়, তারপর দ্বিতীয় পোষক দেহে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। এই প্রক্রিয়া 'স্পিলওভার' নামে পরিচিত। স্পিলওভারের পরবর্তী ধাপে ভাইরাস ওই প্রজাতির অন্যান্য সদস্যের দেহে সংক্রমণ ঘটায়। অন্যান্য জীব থেকে মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ভাইরাসই এই প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে পারেনা।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট ও ডিজিজ ইকোলজিস্ট ডরোথি টোভার জানান, নতুন কোনো ভাইরাসের মহামারি ছড়ানোর আগে ভাইরাসটিকে অনেকগুলো স্তর পার করতে হয়, একসাথে অনেকগুলো ব্যাপারের প্রভাব আছে এক্ষেত্রে। ভাইরাস বহনকারী কোনো জীব কতোবার মানুষের সংস্পর্শে আসে, কোন মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, ভাইরাসটি পোষকদেহের বাহিরে কতোক্ষণ টিকে থাকতে পারে এবং ভাইরাসটির মানবদেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আক্রমণের ক্ষমতা- সবগুলো ব্যাপারই এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এই ধাপগুলোর কোনো একটিতে ব্যত্যয় হলেই কোনো ভাইরাস নতুন প্রজাতির জীবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারেনা। এমনকি কোনো অঞ্চলের গড় বৃষ্টিপাতের বেশি বৃষ্টিপাত, খাদ্য সংকট কোনো এলাকার মানুষ অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ধরণে প্রভাব রাখে, এর প্রভাব পড়ে ভাইরাস সংক্রমণের ওপর।
সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষেত্রে ভাইরাসের জন্য সবচেয়ে কঠিন ধাপটি নতুন পোষকদেহে প্রবেশের সুযোগ পাওয়া। সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এসিই-২ নামক ঝিল্লি প্রোটিন দ্বারা মানবদেহে প্রবেশ করে। মানুষের সংস্পর্শে আসা বেশিরভাগ ভাইরাসই মানবকোষ ভেদ করে শরীরে প্রবেশ করতে পারেনা।
অন্তত ২০০টির মতো ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে রোগ ছড়াতে সক্ষম। তবে ভাইরাসগুলোর এই সক্ষমতা শুরু থেকেই ছিল এমনও নয়। সারা সোয়ার জানান, ভাইরাস জীবদেহের যে রিসেপ্টরের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, তা প্রজাতিভেদে ভিন্ন হয়। 'ভাইরাস যে সক্ষমতার মাধ্যমে মানবদেহের রিসেপ্টরের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে পারে, বিবর্তনের বেশ কিছু ধাপ পেরিয়েই ভাইরাসগুলো এই সক্ষমতা পায়।'
জেনেটিক পরিবর্তনে সক্ষম এবং আরএনএ ভাইরাসের-ই এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির জীবে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। অবার্ন ইউনিভার্সিটির ডিজিজ ইকোলজিস্ট সারাহ জোহডি জানান, দ্রুত মিউটেশনের সক্ষমতার কারণে আরএনএ ভাইরাসগুলোর নতুন পরিবেশে নতুন প্রজাতির জীবদেহে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম।
ইবোলা, সার্স, মার্স, জিকা, বিভিন্ন ধরণের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ও সার্স কোভ-২ সবগুলোই আরএনএ ভাইরাস। এছাড়াও কিছু ভাইরাস একধরণের প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও তাদের জেনেটিক কোড বদলাতে পারে। দুটি ভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস একই জীবদেহে অবস্থানকালে তাদের জিনোম উপকরণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে নতুন সংকর ভাইরাস সৃষ্টি করতে পারে।
তবে মিউটেশন কিংবা দুটি প্রজাতির ভাইরাসের প্রজনন কোনোটিই সংক্রমণের স্পিলওভার ধাপ অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার এই দুইটির একটি সক্ষমতাও নেই এমন ভাইরাসও বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠিতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
জেমা এবং তার সহকর্মীদের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, কিছু ভাইরাস জীবদেহে দীর্ঘকাল সুপ্তাবস্থায় থাকে, এটি তাদেরকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে এবং ভিন্ন প্রজাতিতে সংক্রমণ ছড়াতে সাহায্য করে। অন্যান্য প্রাণী থেকে মানবদেহে প্রবেশ করা অনেক ভাইরাসেরই এই বৈশিষ্ট্য আছে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিস'ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী পরিচালক ট্রেসি গোল্ডস্টেইন জানান, শুধু ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য মহামারির সম্ভাবনা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য নিরুপণ পরবর্তী গবেষণার জন্য সহায়ক হবে। মহামারি ছড়াতে সক্ষম এমন সম্ভাব্য ভাইরাস চিহ্নিত করা গেলে, গবেষণা করে সম্ভাবনা বোঝা যাবে।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক