৬০০-র বেশি অ্যাপ বানিয়েছে সরকার। আসলে কাজ করে কয়টি?
বিআইডব্লিউটিএ-র যে একটা অ্যাপ আছে, জানতেন?
গত ৩০ আগস্ট আমি গুগল প্লে থেকে অ্যাপ্লিকেশনটি ডাউনলোড করি। ডাউনলোডের সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় ভেসে ওঠে সংস্থাটির পরিচিত লোগো—লাল বৃত্তের ভেতর একটি ছোট হলুদ স্টিমার।
দাবি করা হয়, ভাড়া, রুট এবং সারা দেশে বিআইডব্লিউটিএর অফিসের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য রয়েছে অ্যাপটিতে। কিন্তু অ্যাপটিতে ক্লিক করার পর শুধু বলা হলো, 'লোড হচ্ছে, দয়া করে অপেক্ষা করুন' (লোডিং, প্লিজ ওয়েট)।
গত সাত বছরে অ্যাপ্লিকেশনটি ১ হাজারবার ডাউনলোড করা হয়েছে, প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ১৫ জন, রেটিং ৩.৯ এবং রিভিউসংখ্যা ১১।
মো. রাসেল নামে একজন ব্যবহারকারী ৪ স্টার রেটিং দিয়ে ব্যঙ্গের সুরে মন্তব্য করেছেন, 'ভালো পেজ এটা সেরা।'
অ্যাপ্লিকেশনটি গুগল প্লে-তে ছাড়া হয় ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি। অ্যাপটি সর্বশেষ আপডেট হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ।
আরেকটি অ্যাপ ডাউনলোড করেছিলাম আমি—হসপিটাল ফাইন্ডার। এর পরের অভিজ্ঞতা কমবেশি আগের মতোই। এই অ্যাপ্লিকেশনটির উদ্দেশ্য হলো নিকটস্থ হাসপাতাল, হাসপাতালের তথ্য এবং যোগাযোগের বিস্তারিত খুঁজে বের করতে সাহায্য করা। অ্যাপটি যখন খুললাম, স্ক্রিনে একটি গুগল ম্যাপ এল, কিন্তু তাতে কোনো হাসপাতাল দেখা গেল না।
একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, 'এটা সবচেয়ে খারাপ অ্যাপ। আপনার সময় নষ্ট করবেন না।' অ্যাপটি সর্বশেষ আপডেট হয়েছে ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
এরপর ভিলেজ কোর্ট নামে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করলাম। ওটা এখন পর্যন্ত ১০ হাজারবার ডাউনলোড করা হয়েছে। অ্যাপটি খোলার পর গ্রাম আদালত, সাজা দেওয়ার নিয়ম, আবেদনের নিয়ম ইত্যাদি সম্পর্কে জানার জন্য চারটি অপশন পাবেন। কিন্তু স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো স্ক্রিন ফাঁকা হয়ে গেল।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আইসিটি বিভাগ দুটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬০০টি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে। সেগুলোর মধ্যে আমার ডাউনলোড করা অ্যাপ তিনটিও রয়েছে। এই প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
কিন্তু এই ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে গুগল প্লে-তে এখন মাত্র ৪৪টি পাওয়া যায়। আর এই ৪৪টি অ্যাপও ঠিকমতো কাজ করে কালেভদ্রে।
আপডেট করতে ব্যর্থ
২০১৩ সালে সরকার আনুমানিক ৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম প্রকল্পটি হাতে নেয়। কর্মসূচিটি শেষ হয় ২০১৫ সালের জুনে।
প্রকল্পটির তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো গুগল প্লে থেকে কেন উধাও হয়ে গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন সবসময় আপডেট করতে হয়। কিন্তু 'কেউই অ্যাপগুলোর আপগ্রেডেশন করছে না।'
গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, 'কথা ছিল সরকারি সংস্থাগুলো নিজেরা আলাদাভাবে অ্যাপগুলো আপ-টু-ডেট রাখবে, কিন্তু প্রকল্পটি হস্তান্তরের পরে তারা তা করেনি।'
৫০০ অ্যাপ তৈরিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এথিক্স অ্যাডভান্স টেকনোলজি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মুবিন খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইসিটি বিভাগ অ্যাপ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো চুক্তি করেনি।
তিনি বলেন, 'অ্যাপগুলো কাজে এসেছে কি না, তার উত্তর আইসিটি বিভাগ দিতে পারবে। আমাদের কাজ ছিল অ্যাপগুলো টেকনিক্যাল কমিটির কাছে হস্তান্তর করা।'
আরেকটি প্রকল্পে আইসিটি বিভাগ ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে 'ন্যাশনাল-লেভেল মোবাইল অ্যাপস ট্রেনিং অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম' গ্রহণ করে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ১০০টি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা।
তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মিনা মাসুদ উজ্জামান—যিনি এখন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক—দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তিনি ওই প্রকল্পের নাম ভুলে গেছেন।
তিনি বলেন, 'অ্যাপগুলো যদি ক্রমাগত আপডেট না করেন, তাহলে ওগুলো কাজ করবে না।'
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস লিমিটেড এই ১০০টি অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সানি মো. আশরাফ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইসিটি বিভাগ অ্যাপ্লিকেশনগুলোর আপগ্রেডেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো চুক্তি করেনি।
তিনি বলেন, 'তারা পুরনো সংস্করণ ও কনটেন্ট আপডেট করছে না বলে গুগল বেশিরভাগ অ্যাপ্লিকেশন সরিয়ে ফেলেছে। এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো যতদিন গুগল প্লেতে ছিল, আমরা এগুলোর আপডেট ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইসিটি বিভাগকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা করেনি।'
নতুন প্রজন্মের অ্যাপ
দুই প্রকল্পের ৬০০টি অ্যাপের মধ্যে প্রায় ৩০০টি বানানো হয়েছিল মানুষ যাতে নির্দিষ্ট কিছু সরকারি অফিস বা সংস্থার সেবা সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। সেগুলোর বেশিরভাগ অকেজো হয়ে গেছে, তবে এরপর কিছু অ্যাপ সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) জন্য দুটি সরকারি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ইউটিলিটি সেবাদানকারী সংস্থাটি এখন আর অ্যাপগুলো ব্যবহার করে না।
ডিপিডিসির আইটি-র প্রধান প্রকৌশলী শামীম আহসান চৌধুরী বলেন, 'পুরনো অ্যাপে গ্রাহকরা শুধু বিলিং-সংক্রান্ত তথ্য দেখতে পেতেন; তখন কোনো পেমেন্ট সিস্টেম যুক্ত ছিল না। এখন আমাদের অ্যাপে পেমেন্ট সিস্টেম আছে।'
ডিপিডিসির মতো বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের প্রথম মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করে না। বিবি কমপ্লেইন্টস নামে একটি নিজস্ব মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গুগল প্লে-তে এখন ১৩টির মতো অ্যাপ পাওয়া যায় যেগুলো প্রথম দুটি প্রকল্পের বাইরে তৈরি করেছে আইসিটি বিভাগ। এর মধ্যে কয়েকটি অ্যাপ হলো—নদী রকজ, ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার, মুজিব১০০, এপিক অভ পলিটিক্স, স্মার্ট রাজশাহী ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ।
টিকাদান প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য তৈরি সুরক্ষা অ্যাপটি ৫ লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে, রিভিউ পেয়েছে ১৭ হাজার, রেটিং ৪.১ স্টার।
সহজে ব্যবহার করা যায় বলে এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট এক রিভিউয়ে আবরার চৌধুরী লিখেছেন, 'এই অ্যাপ আমাদের [জীবনকে] সহজ করে তুলছে। দ্রুত এবং সহজে কাজ করতে চাইলে অ্যাপটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।'
তবে সব প্রতিক্রিয়াই ইতিবাচক নয়। কিছু ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন, ট্র্যাফিক বেশি থাকলে অ্যাপটির কার্যকারিতায় ত্রুটি দেখা দিতে শুরু করে।
বাকি অ্যাপগুলো অবশ্য তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। কিছু কিছু অ্যাপ ভালোমতো কাজও করে না।
যেমন, আমি স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামের অ্যাপটি ডাউনলোড করি। অ্যাপটি বানানো হয়েছিল আইটি উদ্যোক্তাদের নানা আইডিয়া দেওয়ার জন্য। কিন্তু অ্যাপ্লিকেশনটি আমি খুলতেও পারিনি। এমজে আদনান বক্স অ্যাপটিকে এক-স্টার রেটিং দিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে এক রিভিউয়ে লিখেছেন, 'এই অ্যাপটি ব্যবহারযোগ্য নয়।'
এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) ফর ডিজিটাল বাংলাদেশ নামের সরকারি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পের আওতায়ও ১৮টির বেশি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ডিরেক্টরি, মাইগভ ও উত্তরাধিকার নামের অ্যাপগুলো বানানো হয়েছে। আর এই অ্যাপগুলো ভালোভাবে কাজ করছে দুটি প্রধান কারণে—এগুলো সম্প্রতি তৈরি করা এবং তুলনামূলকভাবে নিয়মিত আপডেট করা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ডিরেক্টরি সর্বশেষ আপডেট করা হয়েছিল ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল।
বাংলাদেশ ডিরেক্টরি একটি দারুণ অ্যাপ। এই অ্যাপে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায় পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যায়।
৫ জানুয়ারি ২০২০ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, 'সারা দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের কন্টাক্ট নম্বর পাওয়ার জন্য ভালো তালিকা। ভালো প্রচেষ্টা। কন্টাক্ট নম্বরগুলো নিয়মিত আপডেট করতে হবে।'
মিনহাজুল হৃদয় নামে আরেকজন ব্যবহারকারী ২০২২-এর ১১ এপ্রিল অ্যাপটিকে চার স্টার রেটিং দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম সেরা ও সময়োপযোগী উদ্যোগ।
অনেকগুলো সরকারি সংস্থা অ্যাপ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় অনিবার্যভাবেই দেখা যাবে একাধিক সংস্থা একই অ্যাপ নিয়ে কাজ করছে।
আইসিটি বিভাগ সিটিজেন হেল্প ডেস্ক নামে একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছে। অ্যাপটিতে বাংলাদেশ ডিরেক্টরি এবং মাইগভের মতো একই ধরনের ফিচার আছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল আপডেট করা সিটিজেন হেল্প ডেস্কের রেটিং ৪.৫, এটি ডাউনলোড হয়েছে ৫ হাজারবার। আমি অ্যাপ্লিকেশনটি ইনস্টল করি, কিন্তু এটি খোলেইনি। এর আগে একই ধরনের ফিচারসংবলিত ন্যাশনাল অ্যাপস বাংলাদেশ ছিল, যাতে ই-ডিরেক্টরি পাওয়া যেত।
এদিকে আইসিটি বিভাগ ২০১৬ সালে ২৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি নতুন মোবাইল গেমস ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হবে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রকল্পটি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রথম প্রজন্মের ৬০০টি মোবাইল অ্যাপের অকার্যকারিতার বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম বলেন, এসব অ্যাপ গুগল প্লেতে নেই বা কাজ করে না, এমনটা বলা ঠিক হবে না।
এনএম জিয়াউল আলম বলেন, 'এটা না দেখে আমি কথা বলতে পারব না। কিছু [অ্যাপ] কাজ করছে।' সুরক্ষার সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু অ্যাপ আছে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য এবং জনবান্ধব।
গেমস, এক্সআর ও এনএফটিবিষয়ক বেসিসের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মূল সমস্যা হলো এই অ্যাপগুলোর নিয়মিত আপডেট ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, '২০১৩ সালে রিলিজ করা মোবাইল অ্যাপ যদি আপডেট না করেন, তাহলে অপারেটিং সিস্টেমগুলোতে পরিবর্তন আসার কারণে এসব অ্যাপ এখনকার রিলিজ পাওয়া ফোনগুলোতে কাজ করবে না।'
গুগল যখন দেখে গ্রাহক নতুন ফোন ব্যবহার করছে, তখন তারা পুরনো অ্যাপগুলো মুছে ফেলে, কারণ ওগুলো কেউ ব্যবহার করে না।
'আমার মনে হয় কর্তৃপক্ষ কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করেনি [এবং] এর ফলে, গুগল এই মোবাইল ফোন অ্যাপগুলো মুছে ফেলেছে,' এরশাদুল হক বলেন।