যেভাবে হুট করে বিলুপ্ত হলো ‘ইশারা’ করতে পারা ব্যাঙ
চিরিকি হারলেকুইন ব্যাঙের প্রজাতিকে ২০১৯ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন বিজ্ঞানীরা।
বিশেষ প্রজাতির এই ব্যাঙের প্রজনন ব্যবস্থা ছিল বেশ বিচিত্র। নারী সঙ্গীকে খুঁজে পেলে পুরুষ ব্যাঙটি পিঠে উঠে সঙ্গীকে আঁকড়ে ধরে রইতো। পুরুষের চেয়ে নারী হারলেকুইনের আকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ হয়ে থাকে। নারী সঙ্গী কখন ডিম পারতে ইচ্ছুক হবে সেই অপেক্ষায় মিলিত অবস্থায় এভাবেই দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাসও কাটিয়ে দিত পুরুষ চিরিকি হারলেকুইন।
অদ্ভুত বিষয়টি হচ্ছে এই দীর্ঘ সময় পুরুষ সঙ্গীটি ইচ্ছাকৃতভাবেই খাওয়া ছেড়ে দিত। এমনকি তাদের শরীরের ওজনের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত তাতে কমে যেত।
তবে গত ৩০ বছর ধরে বিচিত্র এই ঘটনাটির দেখা পাননি বিজ্ঞানীরা। আর তারপরই আসে বিলুপ্তির ঘোষণা।
অ্যাটেলোপাস চিরিকিকুইএনসিস বৈজ্ঞানিক নামের এই ব্যাঙগুলো একসময় কোস্টারিকা এবং পানামার আর্দ্র উঁচু বনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানকার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সাধারণ ৪ হাজার মিলিমিটারের বেশি।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়রাই মাসে এরিক লিন্ডকুইস্ট নামের একজন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী দেশ দুটোর মধ্যে সংযোগকারী লা অ্যামিস্তাদ ইন্টারন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি প্রচুর হারলেকুইনের ডাক শুনতে পান। মাত্র ১০ মিটারের খাঁড়ির মধ্যে তিনি গুণে গুণে ১১৩টি হারলেকুইন পান।
পুরোনো সেই স্মৃতিচারণ করে লিন্ডকুইস্ট বলেন, 'আপনি অবাক হয়ে যেতেন। ভয়ও পেতেন কোনোটি আবার আপনার পায়ের নিচে চাপা না পড়ে। ব্যাঙগুলো ছিল সর্বত্র।'
তিনি আরও বলেন ব্যাঙগুলোকে তিনি সামনের পা হাতের মতো অন্যদের উদ্দেশ্যে নাড়তে দেখেছেন। তিনি বলেন হয়তো এভাবে তারা মারামারি এড়াতে চাইত কিংবা এটা ছিল তাদের প্রজননকালীন ব্যবহার। তিনি হাসতে হাসতে আরও বলেন, নারী হারলেকুইনগুলো যেন পুরুষদের ইশারায় ডেকে বলত, আসো আমার কাছে আসো।
কিন্তু মাত্র তিনমাস পরেই সেখানে গিয়ে লিন্ডকুইস্ট দেখতে পান চারদিক নীরব।
শুধু হারলেকুইনই নয়, সেসময় মধ্য আমেরিকার অন্যান্য সংরক্ষিত স্থানেও ব্যাঙের বিভিন্ন প্রজাতি হ্রাস পেতে দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে আমেরিকান হারপিটোলজিস্ট কারেন লিপস পানামার ফরচুনা রিজার্ভ ফরেস্টের চারটি জলধারায় ১০ প্রজাতির অন্তত ৫৪টি মৃত ও মৃতপ্রায় ব্যাঙ দেখতে পান। অথচ মাত্র এক বছর আগেও এই ব্যাঙগুলো ব্যাপক হারে দেখা যেত।
তিনি বলেন, তার হাতেই ব্যাঙগুলোকে তিনি মারা যেতে দেখেন এবং মৃত ব্যাঙগুলো তাদের স্বাভাবিক অবস্থাতেই একদম জমে যেত।
১৯৯৬ সালই শেষ বছর যেবার বিশ্বে চিরিকি হারলেকুইন ব্যাঙের দেখা মিলেছিল। এরা এত দ্রুত গায়েব হয়ে যায় যে ব্রিডিং-এর মাধ্যমে তাদের প্রজাতি রক্ষার শেষ চেষ্টাও করা সম্ভব হয়নি।
মধ্য আমেরিকায় হুট করে ব্যাঙ কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগে পড়ে বিজ্ঞানীরা। এই অঞ্চলগুলো সংরক্ষিত ছিল ফলে মানুষের আবাদের কারণের তাদের মৃত্যু হচ্ছে সেরকম যোগসূত্রও পাওয়া যাচ্ছিল না।
১৯৯৯ সালে ধরা পড়ল আসল অপরাধী। আসলে ছত্রাকজনিক একটি সংক্রমণের কারণে ব্যাঙগুলোর ত্বক সংক্রমিত হয়। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ব্যাঙ্গুলো পানির স্তর নিয়ন্ত্রণেও ক্ষমতাও হারায় এবং শেষ পর্যন্ত হার্ট ফেইল করে মৃত্যুবরণ করে। হারলেকুইন ব্যাঙ্গুলো শীতল ও আর্দ্র আবহাওয়ার ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল বলেই তারা এই ছত্রাকের অন্যতম শিকারে পরিণত হয়।
এশিয়ার স্থানীয় এই রোগটি সম্ভবত বণ্যপ্রাণীর বৈশ্বিক বাণিজ্যের কারণে অনাকাঙ্খিতভাবে মধ্য আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছে এবং বিশেষ কিছু প্রজাতির জন্য বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত জানা বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির ইতিহাসে ছত্রাকজনিত এই রোগটি ছিল সবচেয়ে বিধ্বংসী যার কারণে ৫০১টি উভচর প্রজাতি হুমকিতে পড়ে। এর মধ্যে ৯০টি প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু এখনও আশা দেখছেন জীবনবিজ্ঞানীরা।
স্থানীয় জীববিজ্ঞানী ফেদেরিকো বোলানো বলেন, 'কোস্টারিকায় কিছু প্রজাতির ব্যাঙ পুরোপুরি হারিয়ে গেছে বলে আমরা ভাবলেও নতুন কিছু জায়গায় তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে'।
উৎসাহ পেয়ে বিজ্ঞানীরা হারিয়ে যাওয়া ব্যাঙগুলোর পরিচিত আবাসস্থল পরিদর্শন করে চলেছেন এই আশায় যে তারা জীবিত কাউকে পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাঙের সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে, এমনকি কিছুক্ষেত্রে সংক্রমণের মাধ্যমও পরিবর্তিত হয়েছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান