বিশ্বের বিরল প্রাণী কোনগুলো? এ সময়ের সবচেয়ে বিপন্ন ১০ প্রজাতি
চোরাশিকার, আবাসস্থল ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে।
গত বছরের শেষের দিকে আমেরিকার জনগণ 'ইনডেঞ্জারড স্পেসিস অ্যাক্ট'-এর ৫০ তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। এই আইনে ১৬৬২ টি দেশি এবং ৬৩৮টি বিদেশি প্রজাতির সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। তবে, এগুলোর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্বের অনেক প্রাণীই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বিরলতম বা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী কোনগুলো?
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ)-এর তথ্যানুসারে আনুমানিক জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে 'মহাবিপন্ন' ১০টি প্রজাতি হলো:
ভ্যাকুইটা:১০
ভ্যাকুইটা বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণী। ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরে বিরলতম সামুদ্রিক এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটির দেখা পাওয়া যায়।
ডব্লিউডব্লিউএফ'র তথ্যানুসারে, ১৯৫৮ সালে এই প্রাণীটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। আবিষ্কৃত হওয়ার মাত্র অর্ধ শতাব্দী পরেই এই প্রাণীটি চিরতরে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
১৯৯৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর অব ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন) এই প্রাণীটিকে সবচেয়ে বিরল প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০০৮ সালে, মাত্র ৬-২২টি ভ্যাকুইটা অবশিষ্ট ছিল।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে মাত্র ১০টি ভ্যাকুইটা অবশিষ্ট আছে।
মেক্সিকোর ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরে বেআইনিভাবে মাছ ধরার জন্য পেতে রাখা গিলনেটের কারণে ভ্যাকুইটা বিলুপ্তির মুখে। গিলনেটে জড়িয়ে এগুলো পানিতে ডুবে যায় এবং নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়।
তবে উত্তর মেক্সিকোর সংরক্ষণবাদীরা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ভ্যাকুইটা শিশুকে তার মায়ের পাশে সাঁতার কাটতে দেখেছেন, যা এই প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধির একটি আশাব্যঞ্জক লক্ষণ।
সুমাত্রান গন্ডার:৪০
গন্ডারের পাঁচটি প্রজাতির মধ্যে তিনটিই বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। এগুলো হলো: কালো গন্ডার, জাভান গন্ডার ও সুমাত্রান গন্ডার।
সুমাত্রান গন্ডার একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। অন্য সব গন্ডারের তুলনায় সুমাত্রান গন্ডার ছোট ও লোমশ।
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ এবং বোর্নিওর কালিমান্তান প্রদেশে এদের দেখা পাওয়া যায়। একসময় ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ, জাভা ও বোর্নিওতে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত এরা। তবে, অন্যান্য গন্ডারের মতো এরাও শিংয়ের জন্য নির্বিচারে শিকারের কবলে পড়ে। এছাড়া আবাসস্থল হ্রাসের কারণেও এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে রয়েছে।
তাছাড়া সুমাত্রান গন্ডারগুলো 'ছোট, বিচ্ছিন্ন ও অস্থায়ী দলে' বাস করে। এভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, তাই বংশ বিস্তারও কম হয়।
ডব্লিউডব্লিউএফ -এর তথ্যমতে, পৃথিবীতে মহাবিপন্ন এই প্রজাতির মাত্র ৪০টি গন্ডার টিকে আছে।
জাভান গন্ডার:৭০
আরেকটি মহাবিপন্ন গন্ডারের প্রজাতি হলো জাভান গন্ডার।
ডব্লিউডব্লিউএফ-এর তথ্যমতে, চোরাশিকারের কারণে বর্তমানে 'পাঁচ প্রজাতির মধ্যে জাভান গন্ডার সবচেয়ে বিপন্ন'।
পৃথিবীতে একমাত্র ইন্দোনেশিয়ার জাভার উজুং কুলন ন্যাশনাল পার্কেই এই প্রজাতির মাত্র ৭০টি গন্ডার টিকে আছে। অথচ একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে দেখা মিলত এই গন্ডারের। তবে শিকার ও আবাসস্থল হ্রাসের কারণে জাভান গন্ডারের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে হ্রাস পায়।
আমুর চিতাবাঘ: ৮৪-এর বেশি
আমুর চিতাবাঘ বিশ্বের বিরলতম প্রাণীগুলোর মধ্যে একটি। এই প্রজাতির মাত্র ৮৪টির বা তার কিছু বেশি সংখ্যক প্রাণী পৃথিবীতে অবশিষ্ট রয়েছে।
বর্তমানে রাশিয়ার সুদূর পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব চীনের তুলনামূলক ছোট অঞ্চলে আমুর চিতাবাঘের দেখা পাওয়া যায়। শিকার, আবাসস্থল হ্রাস, খাদ্য ঘাটতি এবং মানুষের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি যেমন: সড়ক, রেললাইন প্রভৃতি কারণে এগুলো বিলুপ্তির মুখে।
ক্রস রিভার গরিলা: ২০০-৩০০
গরিলার প্রধানত দুটি প্রজাতি আছে, পূর্ব গরিলা ও পশ্চিমা গরিলা। এই দুই প্রজাতির আবার দুটি করে উপ-প্রজাতি আছে।
চারটির মধ্যে তিনটি প্রজাতিই মহাবিপন্ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী,সবচেয়ে বিপন্ন গরিলা হলো ক্রস রিভার প্রজাতি। বর্তমানে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০টি প্রাপ্তবয়স্ক ক্রস রিভার গরিলা অবশিষ্ট রয়েছে।
অনেক বিপন্ন প্রাণীর মতোই চোরাশিকার, আবাসস্থল হ্রাস, রোগ এবং যুদ্ধের কারণে এদের প্রাণহানি হয়েছে।
এছাড়া এদের প্রজনন হার কম হওয়ায় বংশ বিস্তার কম হয়। একটি নারী গরিলা প্রতি চার থেকে ছয় বছরে একবার সন্তান জন্ম দেয়। একটি নারী গরিলা তার জীবদ্দশায় তিন বা চারবার সন্তান জন্ম দেয়।
সাওলা: ৭৫০ এর কম
সাওলা পৃথিবীর বিরলতম স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৯২ সালে ভিয়েতনামের অ্যানামাইট রেঞ্জে এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়।
সাওলা খুব কম মানুষের সামনে আসে। এটি এতই কম দেখা যায় যে এটিকে এশিয়ান ইউনিকর্ন বলা হয়! তাই এ প্রাণীর সংখ্যা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা শক্ত। তবে এটি মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীতে ৭৫০টিরও কম সাওলা বেঁচে আছে।
তপানুলি ওরাং-ওটাং: ৮০০
তাপানুলি ওরাং-ওটাং হলো ওরাঙ্গুটানের একটি প্রজাতি। ২০১৭ সাল থেকে এটিকে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শুধু ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে তাপানুলি ওরাংওটাংদের দেখা যায়।
বর্তমানে এই প্রজাতির মাত্র ৮০০ টি প্রাণী অবশিষ্ট আছে। তাই এই প্রাণীটি মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে বিবেচিত।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনগুলিতো কৃষি, খনন ও জলবিদ্যুৎ প্রভৃতির কারণে আবাসস্থলের ক্ষতি হওয়ায় এদের বেঁচে থাকা হুমকির মুখে রয়েছে। ১৯৮৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে উত্তর সুমাত্রা প্রদেশের ৪০% এরও বেশি বনভূমি (যেখানে তপানী ওরাং-ওটাং পাওয়া যায়) ধ্বংস করা হয়েছে।
ইয়াংজি ফিনলেস পোরপয়েজ: ১০০০-১৮০০
ইয়াংজি ফিনলেস পোরপয়েজ হলো এই গোত্রের সবচেয়ে বিচিত্র। কারণ এটি বিশ্বের একমাত্র জীবিত মিঠা পানির পোরপয়েজ। এই জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীটি বর্তমানে চীনের ইয়াংজি নদীতে বাস করে এবং এটি একটি মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত।
এই অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে পরিবেশের অবক্ষয়, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং পানি দূষণ এই নদীতে বাসকারী অনেক প্রাণী প্রজাতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
একসময় ইয়াংজি নদীতে ফিনলেস পোরপয়েজের পাশাপাশি ডলফিনেরও দেখা মিলত। কিন্তু গত দুই দশক ধরে এখানে কোনো মিঠা পানির ডলফিনের দেখা মেলেনি। তাই এখানে বসবাসরত ইয়াংজি ফিনলেস পোরপয়েজসহ অনেক বিপন্ন প্রজাতির ভাগ্যে শিগগিরিই কী ঘটতে পারে তা স্পষ্ট অনুমেয়।
সর্বশেষ হিসাবে, বর্তমানে ইয়াংজি ফিনলেস পোরপয়েজের সংখ্যা প্রায় ১০০০-১৮০০ এর মধ্যে।
সুমাত্রার হাতি: ২৪০০-২৮০০
২০১২ সালে সুমাত্রান হাতিকে 'বিপন্ন' থেকে মহাবিপন্ন' প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। মূলত আবাসস্থল হ্রাস এবং মানুষ-হাতি সংঘাতের কারণে এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হ্রাস পেয়েছে।
এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সুমাত্রায় সর্বোচ্চ বন উজাড় হয়েছে। যার ফলে এখানকার অনেক অঞ্চলে হাতি বিলুপ্তির পথে। গত ২৫ বছরে সুমাত্রার নিম্নাঞ্চলের বনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এক প্রজন্মের মধ্যে সুমাত্রান হাতির প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে।
লামপুং প্রদেশে হাতির পালের সংখ্যা ১৯৮০ এর দশকে বারোটি থেকে ২০০২ সালের মধ্যে মাত্র তিনটিতে নেমে এসেছে।
সুমাত্রায় দ্রুত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং বন উজাড়ের ফলে হাতি প্রায়ই মানুষের বসতির সংস্পর্শে আসে। তারা ফসলে হানা দেয়, বাড়িঘর পদদলিত করে এবং কখনও কখনও মানুষকে আঘাত করে বা হত্যা করে। ক্ষতিগ্রস্তরা কখনও কখনও প্রতিশোধ নেয় এবং বিষ খাইয়ে বা গুলি করে হাতিগুলোকে হত্যা করে।
সুন্দা বাঘ-৫৫৭৪
সুন্দা দ্বীপের বাঘ বা সুমাত্রান বাঘ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট বাঘের উপপ্রজাতি। এর একেকটির ওজন ১৪০ কেজি পর্যন্ত হয়। শুধু ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে এই বাঘের দেখা পাওয়া যায়।
১৯৮০ -এর দশক থেকে দক্ষিণ- এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৫৭ মিলিয়ন থেকে ২০২০ সালে প্রায় ৬৬৮ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। আর এর প্রভাব পড়েছে বাঘের সংখ্যায়, কারণ তাদের বাসস্থান সংকুচিত হয়ে এসেছে। এছাড়া বাঘ শিকার এবং বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও পণ্যের অবৈধ বাণিজ্যও এই প্রাণীর বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।।
এছাড়া মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় আফ্রিকার বন্য হাতি, কালো গন্ডার, বোর্নিয়ান ওরাং-ওটাং, পূর্বাঞ্চলীয় নিম্নভূমির গরিলা, হকসবিল কচ্ছপ, সুমাত্রান ওরাং-ওটাং, সুমাত্রান গন্ডার এবং পশ্চিমা নিম্নভূমির গরিলাও রয়েছে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি