মরিচের আগমন চিরতরে বদলে দিলো উপমহাদেশের খাবার
ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নাবান্নায় অপরিহার্য একটি উপাদান- মরিচ। হোক সে টাটকা কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ অথবা গুড়ো করা। এটি এমন এক মসলা জাতীয় উপকরণ– যা ব্যঞ্জনে এনে দেয় স্বাদের ভিন্নতা। খাদ্যের ইতিহাসে এই পরিবর্তনকে যুগান্তকারী বা বৈপ্লবিক বলাটা মোটেও অত্যুক্তি হবে না। বলাই বাহুল্য যে, মরিচের সহজলভ্যতা কালের পরিক্রমায় অনেক নতুন পদও যুক্ত করেছে আমাদের রসনায়। স্লার্প ডটকম অবলম্বনে
উপমহাদেশে সর্ব-সাধারণের কাছে ঝালের এই সংযোজন সুবিদিত। একেবারেই ঝালবিহীন পদেও অরুচি অনেকের।
ব্যাপক এই ব্যবহারের ঐতিহ্য থাকার ফলেই হয়তো– বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই ভুলে গেছেন, চিরচেনা এই মরিচ কিন্তু উপমহাদেশের নিজস্ব সংযোজন নয়। এমনকী মরিচ গাছও নয়- স্থানীয় উদ্ভিদ। বরং এসেছিল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে।
প্রথম যেভাবে মরিচ এলো ভারতে
মধ্য আমেরিকা গিয়ে প্রথম মরিচ গাছ আবিষ্কার করে স্পেনিশ অভিযাত্রীরা। কিন্তু, ভারতে এটি আসে পর্তুগিজদের মাধ্যমে।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৪শ বছর আগে দক্ষিণ ভারতের বন্দরনগরী কালিকুটে হানা দেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী (দস্যু বলাই শ্রেয়) ভাস্কো ডা গামা। পর্তুগিজরা চলে যাওয়ার সময় জাহাজভর্তি গোলমরিচসহ অন্যান্য মসলা ফেলে রেখে যায়।
ধারণা করা হয়, এরমধ্যে শুকনো মরিচও ছিল। গামার রেখে যাওয়া চালান বিপুল লাভে রপ্তানি করা হয়। এতে করে, স্থানীয়ভাবে এসব মসলা চাষ করার গুরুত্বও বুঝতে পারেন অনেকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মরিচের চাষ। বিশেষ করে, দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে মরিচকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। এখানকার আদ্র আবহাওয়া ছিল মরিচ, গোলমরিচসহ অন্যান্য মসলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। গোলমরিচের চেয়ে কাঁচামরিচ উৎপাদন করার খরচ কম হওয়ায়, চাষিদের কাছে এটি জনপ্রিয় ফসল হয়ে ওঠে।
চাষাবাদ বিস্তারের সাথে সাথে কমে দামও। ফলে এটি আর্থ-সামাজিকভাবে নিচের সাড়ির মানুষের হাতের নাগালে চলে আসে। ভারতে দলিত সম্প্রদায়ে খাবারের প্রধান সুগন্ধি উপকরণ হিসেবে আজো রয়েছে মরিচ ব্যবহারের চল।
১৭ শতকে আচার ও চাটনি তৈরির উপাদান ছিল- কাঁচা ও শুকনো মরিচ। তারপর অন্যান্য খাবারেও ব্যবহার শুরু হয়। এক সময় তা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বস্তরে ব্যবহৃত মসলা হয়ে ওঠে। খুব দ্রুতই শুকনো মরিচ ও তার গুড়ো এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মসলার স্থান দখল করে।
কর্ণাটকে বিয়াদগি নামক জাতের একটি মরিচ আজ তুমুল জনপ্রিয়; এর ব্যবহারে খাবারে যুক্ত হয়- 'স্মোকি ফ্লেভার'। খাবারের সুঘ্রাণ, রঙ ও স্বাদেও আসে ভিন্ন মাত্রা। ঘ্রাণের জন্য আরেকটি বিখ্যাত কাঁচামরিচ হলো- জোয়ালা।
বাংলাদেশে সব অঞ্চলেই কাঁচামরিচ হয়। উত্তরাঞ্চলে কাঁচা মরিচ 'আকালি' নামে পরিচিত। টাঙ্গাইল জেলাতেও কাঁচামরিচ ভালো জন্মে, তবে সেগুলো ছোট আকৃতির—যার নাম হচ্ছে 'ধাইন্যা মরিচ' বা সুগন্ধযুক্ত তীব্র ঝাল মরিচ।
শুধুমাত্র ভারতেই আজ শতাধিকের বেশি মরিচের স্থানীয় জাত রয়েছে। এরমধ্যে জনপ্রিয় জাতগুলি হচ্ছে– ভূত জোলোকিয়া, নাগা, বিয়াদগি ইত্যাদি। দেশটির সবচেয়ে বড় উৎপাদক অঞ্চল হলো- অন্ধ্র প্রদেশ। ভারতের স্থানীয় মরিচ উৎপাদনের ৫০-৭০ শতাংশ হয় এখানেই।
অন্ধ্রের একটি বিখ্যাত মরিচের জাত হলো- গুনতুর। ঝাল ভোজের জন্যও সুখ্যাতি (কুখ্যাতি বলা ভালো) আছে অন্ধ্রবাসীর। এখানকার রেস্তোরাঁগুলিতে অতি-ঝালের 'চিলি-চিকেন' থাকাটা যেন বাধ্যতামূলক। কড়া ঝালে অভ্যস্ত না হলে এই ব্যঞ্জন জিভে তোলার পর 'আক্কেল গুড়ুম' হতে বাধ্য শৌখিন ভোজকের।
মরিচের আবিষ্কার
মধ্য আমেরিকা অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ আদি মরিচের জাত। ইউরোপে এটি নিয়ে আসেন ক্রিস্টোফার কলোম্বাস। এর আগে ভারত থেকেও মসলা কিনত স্পেনীয়রা। কিন্তু, ভারতে ঝাঁঝালো মসলা পাওয়া যেত চাহিদার চেয়ে অনেক কম; দামও ছিল অত্যধিক। ফলে বিপুল পরিমাণে আহরণ করা সম্ভব- এমন উৎস ও জাত খুঁজছিলেন কলম্বাস। আর সেই অনুসন্ধান করতে করতেই– কাঁচামরিচের সন্ধান পান। এতে করে, ইউরোপের বাজারে ভারত থেকে আমদানিকৃত মসলা বাণিজ্যে একচেটিয়া মধ্যস্বত্বভোগী– ভেনিসিয় বণিকদের পাশ কাটাতে পারে স্পেন।
আসলে ভারতবর্ষে আসার বিকল্প নৌপথ আবিষ্কার করতে গিয়েই কলম্বাস খুঁজে পান আমেরিকা। কিন্তু, তখনও তিনি বুঝতে পারেননি এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মহাদেশ। তাই খুঁজছিলেন, মসলার উৎস। খোঁজ করতে করতে পৌঁছান হাইতির উত্তর উপকূলে। এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে মরিচের ব্যাপক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেন তিনি।
১৫৯০ সালে জেসুইট যাজক ফাদার হোসে ডি অ্যাকোস্টাস তার 'নেচারাল অ্যান্ড মোরাল হিস্টোরি অভ দ্য ইন্ডিস' বইয়ে সেখানকার মরিচের ব্যবহার সম্পর্কে লিখেছেন। মরিচের নানাবিধ ব্যবহার এবং সে অনুসারে প্রস্তুত প্রণালী উঠে আসে তার লেখায়।
তিনি জানান, সেখানকার বাসিন্দারা এটি দিয়ে ঝাঁঝালো পানীয় প্রস্তুত করত, স্বাদ বাড়াতে সাথে দিত লবণ। পানীয়ের উপকরণ হিসেবে টমেটোর কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ভারতীয় খাবারে মরিচের নানা রকম ব্যবহার
মরিচ দক্ষিণ আমেরিকার আদি উদ্ভিদ হলেও– আজ বিশ্বের সর্বত্র তার জয়জয়কার। কিন্তু, ভারতীয় রসুই এই রাজত্বের সিংহাসনই বলা যায়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মরিচ উৎপাদন হয় ভারত ও চীনে।
ভারতে আজ হরেক পদে নানান রকম মরিচের ব্যবহার হয়। যেমন দক্ষিণ ভারতীয় খাবারে বেশি হয় কর্ণাটকের বিয়াদগি মরিচ। এটি খাবারে আনে গাঢ় লাল রঙ, আর কিছুটা গোলমরিচের মতো স্বাদ। শুধু খাবারেই নয়– বরং উজ্জ্বল রঙ হিসেবে লিপস্টিক ও নেইল পলিশের মতো প্রসাধণী পণ্য তৈরিতেও এটি ব্যবহার হয়।
উপমহাদেশীয় খাবারে অনেক মসলার ব্যবহার হয়। মসলার শক্ত বন্ধন হিসেবে কাজ করে মরিচের গুড়ো। চাল, মাংস ও সবজি– সব পদ রান্নায় মরিচ আনে স্বাদে অনন্যতা। পছন্দ অনুযায়ী, স্বাদে ভিন্নতা আনতে কাঁচা বা শুকনো মরিচ- যা ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়।
পানীয় আর নাস্তা তৈরিতেও মরিচের জুড়ি মেলা ভার। শিঙাড়া, সমুচা, মোগলাই– নাম যেটিই বলুন– মরিচ ছাড়া উপাদেয় অনেক ভাজাপোড়া নাস্তাও যে বিস্বাদ ঠেকে।
ঝাঁঝালো স্বাদ ছাড়াও মরিচের রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। সামান্য পরিমাণ মরিচ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এছাড়া, মরিচের গুড়োয় রয়েছে শক্তিশালী প্রদাহরোধী উপাদান ।