ভারতের টাইটানিক যেভাবে জাপানি টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যায়!
১৯৪২ সালের ২৭ নভেম্বর ভারতের বোম্বাইয়ের (বর্তমানে মুম্বাই) ব্যালার্ড পিয়ারে এসে ভিড়ে এইচএমএস বার্মিংহাম নামক একটি জাহাজ। জাহাজটিতে মোট যাত্রী ছিলেন ৬৭৮ জন। এরা সবাই দিন কয়েক আগে ভারত মহাসাগরে এক ভয়াবহ জাহাজ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনায় মারা যান ২৮০ জন যাত্রী।
ঠিক এক সপ্তাহ আগেই এদের অনেকেই বোম্বে থেকে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। তাদেরকে বহন করা এসএস তিলাওয়া নামক ওই জাহাজে ছিল মোট ৭৩২ জন যাত্রী। জাহাজটির মূল গন্তব্য ছিল ডারবান। তবে যাত্রাপথে এটির মোমবাসা ও মাপুতোয় থামার কথা ছিল।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, ভারতের স্বাধীনতাও অর্জিত হয়নি। যুদ্ধের কারণে সমুদ্রে বেসামরিক জাহাজ চলাচলের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। সেজন্য এসএস তিলাওয়া'র টিকিট পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে ছিলেন। কেউ কেউ ঘুষ দিয়ে টিকিট কিনেছিলেন।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির পরিচালিত তখনকার সব জাহাজে বিভিন্ন ধরনের যাত্রীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল। তিলাওয়া'র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাহজটির নিচের ডেক হিন্দু নিরামিষাশী এবং মুসলিম আমিষভোজীদের জন্য রান্না ও খাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল। প্রথম শ্রেণীর খাবার ও পানীয়র সুবিধা পেতেন কেবল ইউরোপীয় যাত্রীরা।
বিকেল পাঁচটায় ৭৩২ যাত্রী, ২২২ ক্রু, চারজন গানার, ও ৬,৪৭২ মেট্রিক টন কার্গো নিয়ে নিয়ে বোম্বে থেকে যাত্রা শুরু করে এসএস তিলাওয়া। জাহাজটিতে ছিল ৬০ মেট্রিক টনের মতো রুপার ব্যুলিয়ন। যাত্রীরা অবশ্য জানতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওই উত্তাল সময়ে সুমুদ্রযাত্রা করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
চুনিলাল নাভাসারিয়া নামক জাহাজটির বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী পরবর্তীকালে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, যাত্রা শুরু করার পর যাত্রীদেরকে নিরাপত্তাবিষয়ক মহড়া দেওয়া হয়। 'আমাদের বলা হয়েছিল ওপরের ডেকে ম্যাচ না ধরাতে, লাইট না জ্বালাতে,' চুনিলাল বলেন। জাহাজে আলোও জ্বালানো হতো না। পোর্টহোলগুলো কালো রংয়ে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এগুলোকে রাতের বেলা বন্ধ করে রাখতে হতো। জাহাজের যাত্রীদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটত ভয়ে আর আতঙ্কে।
সর্বোচ্চ ১২ নট গতিতে প্রথম কয়েকদিন কোনো প্রকার বিপদ ছাড়াই সমুদ্রের জলরাশি কাটিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল এসএস তিলাওয়া।
আক্রমণের রাত
১৯৪২ সালের ২৩ নভেম্বর আফ্রিকা মহাদেশের সেশেলস-এর কাছে ইমপেরিয়াল জাপান নৌবাহিনীর আই-২৯ সাবমেরিন এসএস তিলাওয়াকে লক্ষ্য করে টর্পেডো নিক্ষেপ করে। জাহাজটিতে থাকা ভারতীয় আরেক যাত্রী ইসমাইল আলি ধানসে'র নাতি গোলাম ধানসে তিলাওয়া১৯৪২ ডটকম-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন 'সেদিন শেষ রাতে হঠাৎ এক তীব্র আওয়াজে জাহাজের যাত্রীদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।' এসএস তিলাওয়া দুর্ঘটনার স্মৃতি সংরক্ষণে তৈরি করা হয়েছে তিলাওয়া১৯৪২ ডটকম নামক এ ওয়েবসাইটটি।
নিজের চাচীর কাছ থেকে তিলাওয়া দুর্ঘটনার কথা জেনেছিলেন গোলাম ধানসে। 'জাহাজের ফার্স্ট অফিসার জরুরি উদ্ধার আবেদন (এসওএস) পাঠাতে শুরু করেন। জাহাজটি ধীরে ধীরে ডুবতে শুরু করে। যাত্রীরা সবাই লাইফবোটে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেন। কিন্তু সবার জায়গা হয়নি লাইফবোটগুলোতে। অনেকে সমুদ্রে পড়ে ডুবে মরেন। যারা ভেসেছিলেন, তারা জাহাজের বিধ্বস্ত টুকরাগুলোকে আশ্রয় করে কোনোরকমে বেঁচে থাকেন।'
চুনিলাল নাভাসারিয়া কোনোক্রমে একটি অর্ধেক পূর্ণ লাইফবোটে উঠতে সক্ষম হন। এরপর বিধ্বস্ত জাহাজ থেকে ভাসতে ভাসতে দূরে সরে যায় তাদের লাইফবোট।
প্রবীণ জীবনের বাবা মোরার এসএস তিলাওয়া'র একজন যাত্রী ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে প্রবীণ জানান, টর্পেডোর আঘাতে জাহাজের উপরের ডেকের কেবিনগুলোর অনেকগুলোর তালা আটকে গিয়েছিল। 'আমার বাবা একটা ফায়ার এক্স নিয়ে অনেক চেষ্টায় বেশ কয়েকটি কেবিনের দরজা খুলতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে আতঙ্কিত হয়ে তিনি নিজে জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেন। একটি ভেলা দেখতে পেয়ে তিনি সেটি লক্ষ্য করে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। প্রথমে ডুবে গেলেও লাইফ জ্যাকেট থাকায় একটু পরেই ভেসে ওঠেন তিনি। এরপর ভেলায় উঠতে সক্ষম হন।'
প্রথম টর্পেডো নিক্ষেপের এক ঘণ্টা পর দ্বিতীয় টর্পেডোটি নিক্ষেপ করে জাপানি সাবমেরিন। এবার পুরোপুরি ডুবে যায় এসএস তিলাওয়া। কী কারণে যাত্রীবাহী এ জাহাজটি জাপানি সাবমেরিন দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তা কোনোদিন জানা যায়নি। অনেকে মনে করেন, জাহাজে থাকা রুপার ব্যুলিয়নগুলোর লোভে এ আক্রমণ করেছিল জাপানিরা। তবে সেক্ষেত্রে চাইলেই জাহাজটি ধ্বংস না করে এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে পারত তারা।
২৮০টি প্রাণের সলিলসমাধি ঘটে 'ভারতের এ টাইটানিক' দুর্ঘটনায়।
সমুদ্রে ভেসে বাঁচা
সমুদ্রে যারা জাহাজের ভাঙা অংশ, জিনিসপত্র ইত্যাদি আঁকড়ে ভেসে ছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। ইসমাইল আলি ধানসে কাঠের একটি ভারী দণ্ড ধরে ভেসে ছিলেন। এক পর্যায়ে টের পাওয়া গেল, তার পায়ে কামড় বসিয়েছে শিকারি ব্যারাকুডা মাছ।
পুরো একদিন ও একরাত সমুদ্রে ভেসে থাকার পর নভেম্বরের ২৫ তারিখ এইচএমএস বার্মিংহাম এসব ভাসমান যাত্রীদের উদ্ধার করে। অনেকের কাছে কোনো খাবার ও পানি ছিল না। অনেক লাইফবোটের ক্রুরা কোনদিকে যাত্রা করবেন এ নিয়ে তর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সমুদ্র ছিল অস্থির, একইসঙ্গে বইছিল ঠাণ্ডা বাতাস। দিনেরবেলা বৃষ্টি এসে সমুদ্রকে আরও উত্তাল করে দিয়েছিল।
এইচএমএস বার্মিংহাম নিজেদের যাত্রাপথ বদলে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ৬৭৪ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে তারা। একদিন আগে অবশ্য আরএমএস এসএস কার্থেজ নামক আরেকটি জাহাজ চারজন যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল।
স্মৃতিরক্ষা
তিলাওয়া দুর্ঘটনার ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ব্যালার্ড এস্টেটের গ্র্যান্ড হোটেলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যাত্রীদের মধ্যে বর্তমানে কেবল দুজন বেঁচে আছেন।
এসএস তিলাওয়া ডুবে যাওয়া নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেছে। তবে এর স্মৃতিরক্ষার্থে বর্তমানে অনেকেই সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। ভারত, আফ্রিকা, ব্রিটেন, উত্তর আমেরিকার অনেক পরিবারই তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছিল এ দুর্ঘটনায়। 'ভারতের টাইটানিক' ডুবিতে নিহতদের ইতিহাসের বইতে ঠিকমতো স্থান না হলেও, এ পরিবারগুলোর স্মৃতি আর শোকের মাঝে তারা এখনো অক্ষয় হয়ে আছেন।
- স্ক্রল ডটইন থেকে অনূদিত