মুরাদ টাকলা অভিধান: পাতায় পাতায় হাসি আর চ্যালেঞ্জে ভরা স্মৃতিমেদুর ডিজিটাল অতীত
এক প্রেমিক যুগলের ফেসবুকে কথোপকথন…
-ke kara sana amar, bire breasty. 2mr songe bigte ecce hocce
- abbo asapasqa asa, pora masag dicci 2mk
-buglam
লেখাগুলো পড়তে নিশ্চয়ই আপনার দাঁত ভেঙে যাচ্ছে, তাই না? আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি। এর 'বঙ্গানুবাদ' হলো:
-কী করো সোনা আমার, বাইরে বৃষ্টি, তোমার সঙ্গে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-আব্বু আশেপাশেই আছে। পরে মেসেজ দিচ্ছি তোমাকে।
-বুঝলাম।
কঠিন, দুর্বোধ্য এ ভাষা আজ যতই হাস্যকর বা দুর্বোধ্য মনে হোক, একটা সময় অহরহ কিছু মানুষ এই ভাষাতেই মোবাইল বা অনলাইনে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে গেছে। তবে, বাংলা কী-বোর্ড চলে আসায়, মানুষ এখন সরাসরি বাংলাতেই লিখছে বেশিরভাগ সময়।
২০০৭-এর পর ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আমাদের দেশে। ফলে স্ট্যাটাস, কমেন্ট, মেসেজ এসকল ক্ষেত্রে নিজেদের ভাবপ্রকাশের জায়গাটিও আস্তে আস্তে শুরু হয়। তবে, এখন আমরা যেভাবে বাংলা হরফেই লিখতে পারি, ২০১১-১২ সালের দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সে সুযোগ ছিল না। ফলে, ফোনেটিক উচ্চারণে রোমান হরফে বাংলা লেখার চল বাড়তে থাকে তখন। রোমান হরফে বাংলা লেখাকে আমরা বলে থাকি সাধারণত 'বাংলিশ' ভাষা। ফেসবুকের আবির্ভাবের ফলে, সে সময় ফোনেটিক কী-বোর্ডের সঙ্গে মানুষ মাত্র পরিচিত হয়ে উঠছে। তবে অনেকেই তেমন দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। যার ফলে, প্রথাগত ফোনেটিক উচ্চারণে নয়, বরং একেবারেই ব্যতিক্রমী ও স্পষ্ট কাঠামোহীন উচ্চারণে বাংলা লেখা হতো। যে কারণে, তাদের ভুলভাল 'বাংলিশ' লেখা অন্যদের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠতে থাকে।
ফলে তা একদিকে যেমন দুর্বোধ্য, তেমনি উচ্চারণগুলোও হাস্যকর হয়। যেমন, 'কেমন আছো' লেখা হতো, kamon aco (কামন আকো)। 'আমি' শব্দটিকে 'ami'র বদলে 'ame' কিংবা 'দেখা' শব্দটিকে 'dekha'র বদলে 'daka' লেখা হতো। এমনকি, কিছু কিছু বানান এমনিই উদ্ভটভাবে লেখা হতো, যে তার কোনো অশ্লীল অর্থ দাঁড়িয়ে যেত! যেমন, tar pasa ki? (তার পেশা কী?)
ফলে, এসব শব্দ যে মানুষের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
জয়ন্ত কুমারের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি
২০১২ সালের ১৫ জুলাই জয়ন্ত কুমার নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে একটি কমেন্ট করে। কমেন্টটি ছিল, 'Murad Takla jukti diya bol falti pic dicos kan, lakapora kora kata bal.' কমেন্টটিকে প্রথমদিকে কেউ পাত্তা না দিলেও পরে কিছু তরুণ এই কমেন্টের অর্থ বের করতে চেষ্টা করে। কমেন্টের ভাষা এতটাই দুর্বোধ্য ছিল যে, পরবর্তীতে এরজন্য একটি গ্রুপই খোলা হয়েছিল। দীর্ঘ দুই মাস গবেষণার পর অবশেষে এর অর্থ বের করা সম্ভব হয়। কমেন্টটিতে জয়ন্ত কুমার বলতে চেয়েছিলেন, 'মুরোদ থাকলে যুক্তি দিয়ে কথা বল। ফালতু পিক দিছস কেন? লেখাপড়া করে কথা বল।'
এই ঘটনায় ওই তরুণদল এতই মজা পেয়ে যায় যে, তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে এই বিশেষ ভাষাভাষীর মানুষদের প্রতি। মাস দেড়েকের মধ্যে অর্থাৎ ২০১২ সালের শেষদিকে তারা ফেসবুকে একটি বিশেষ পেজও খুলে ফেলে। যার নাম দেওয়া হয় 'মুরাদ টাকলা'।
'Murad Takla jukti diya bol falti pic dicos kan lakapora kora kata bal.' বাক্যের প্রথম দুই শব্দ 'মুরাদ টাকলা (Murad Takla)'-কে গ্রুপের নাম হিসেবে রাখা হয়।
ইংরেজি অক্ষরে কঠিন ও ভুল বানানে বাংলা লিখিয়েদেরই বলা হয় মুরাদ টাকলা। মূলত ইংরেজি অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ না জানার ফলে এ ধরনের ভাষা তৈরি হয়। শুধুই ইংরেজি অক্ষর নয়, ইংরেজি ডিজিটের ব্যবহারও দেখা যায়। এভাবে ধীরে ধীরে ভুলভাল লেখার প্রতিশব্দই হয়ে যায় 'মুরাদ টাকলা'।
এভাবেই নিজের অজান্তেই জয়ন্ত কুমার নামক ঐ ভদ্রলোক বাংলা অনলাইন জগতে সূচনা করেন এক নতুন যুগের। আবিষ্কার হয় স্বতন্ত্র এক ভাষা। যার কোনো খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি যে সে কে?
অল্পদিনের মধ্যেই এই পেজ তরুণ সমাজের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে, যেমন: কোনো ফেসবুকের স্ট্যাটাস, কমেন্ট, ইনবক্সের মেসেজ ইত্যাদির স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়ে পেজের সদস্যরা পোস্ট করতে থাকেন সেখানে। 'মুরাদ টাকলা' পেজ থেকে পাওয়া বিভিন্ন স্ক্রিনশট নিয়ে একে অপরকে পাঠাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে।
এ ব্যাপারে পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট ও জনপ্রিয় স্যাটায়ার ওয়েবসাইট eআরকি প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিমু নাসের বলেন, 'মনের ভাব বোঝাতে নিজেদের মধ্যে, পাবলিক প্লেসে তখন এভাবেই লিখতো অনেকে। আর আমরাও অবসর সময়ে বসে বসে এসব কথার অর্থ বের করার চেষ্টা করতাম। পোস্ট করতাম পেজে। এতে যেমন মানুষ মজাও পেত তেমনি যারা আসল 'মুরাদ টাকলা' তারা নিজেদের লেখার পার্থক্যগুলো বুঝতে পারতেন।'
তবে, পেজটি বিনোদনের জন্য হলেও, এসব স্ক্রিনশট বা মিম প্রকাশের জন্য কখনো যেন কেউ আঘাত না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। এজন্য পোস্টের নাম বা ছবি ব্লার করে আপ্লোড করা হয়েছে।
তবে, এখন যেভাবে হাসাহাসি করা হয়, প্রথমদিকে কিন্তু ভাষাটিকে একদমই আলাদা বা অস্বাভাবিক কোনো ভাষা হিসেবেই দেখা হতো না। সিমু নাসের বলেন, 'মনের ভাব বোঝাতে নিজেদের মধ্যে, পাবলিক প্লেসে তখন এভাবেই লিখতো অনেকে। হয়তো প্রেমিক প্রেমিকাকে প্রপোজ করছে এই দুর্বোধ্য ভাষায়, কিন্তু যারা লিখতো এভাবে, তাদের কাছে এ ভাষা কিন্তু কঠিন বা ফানি না। কিন্তু যারা মুরাদ টাকলা না, তাদের জন্য এ ভাষা পড়তে সত্যিই একটা ডিকশনারি লাগার মতো অবস্থা হয়ে যেত মাঝে মাঝে!
এর আগে 'টাকলা' ভাষাকে অনলাইনের গণ্ডির বাইরে দেখা যায়নি
আসলে, অনলাইনে বাংলা লেখা সহজ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই যুগটি ছিল সেই সময়ের তরুণদের জন্য অন্যরকম এক সময়। আর এই ছোট্ট একটি সময়কে ধরে রাখতেই এ ভাষা নিয়ে একটি বই বের করার চিন্তা মাথায় আসে সিমু নাসেরের। চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করেন সিমু নাসের। সহযোগী হিসেবে যুক্ত হন তার সহকর্মী পীয়্যান মুগ্ধ নবী। দুজন মিলে লিখে ফেললেন একটি অভিধান! সে অভিধানে আছে প্রায় ১২০০ শব্দ। হলুদ মলাটের উপর কালো মোটা হরফে লেখা, 'মুরাদ টাকলা অভিধান'।
এর আগে 'টাকলা' ভাষাকে অনলাইনের গণ্ডির বাইরে দেখা যায়নি। ছাপার অক্ষরে পোস্টার, লিফলেট অথবা ব্যানারে হয়তো কখনো কখনো টাকলা ভাষা দেখা যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু ২০২০ সালে eআরকি প্রকাশনী থেকে এটি প্রথম বইয়ের পাতায় এলো সিমু নাসেরের হাত ধরেই।
যেকোনো অভিধানের সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনেই রচিত এই অভিধানটি। ভেতরে একদম প্রথাগত অভিধানের মতোই শুরুতে ব্যবহারবিধি, সেখানে আছে ভুক্তি, অর্থ—এবং প্রতিটি ভুক্তির সাথেই আছে মজার একটি করে টাকলা বাক্য। পাঠকের যেন দাঁত ভেঙে না যায়, তাই এসব বাক্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে স্পষ্ট বাংলা অনুবাদ।
এছাড়া মুরাদ টাকলা ভাষায় যে দ্ব্যর্থকতা সৃষ্টি হয়, সেটিকে পুঁজি করেই করা হয়েছে দারুণ সব কার্টুন-লাইক ইলাস্ট্রেশন। সাথে আছে পাঠকদের তব্দা খাওয়ানোর মতো সব স্ক্রিনশট।
একদম রোমান হরফের 'A' থেকে শুরু করে 'Z' পর্যন্ত ক্রমানুসারে প্রতিটি শব্দের অর্থ, তার রোমান হরফের বানান এবং প্রয়োগবাক্য দেওয়া আছে। এই শব্দগুলো এবং তার সঙ্গে দেওয়া প্রয়োগবাক্যগুলোতে খুঁজতে গিয়েই ২০১৮ থেকে ২০২০ প্রায় দু'বছর লেগে গেছে।
ফেসবুকের মুরাদ টাকলা নামে যে পেজ আছে, ওই পেজে শেয়ার করা বিভিন্ন পোস্ট থেকে অনেক শব্দ বা বাক্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ফেসবুকের বিভিন্ন প্রোফাইল, পাবলিক পোস্ট বা কমেন্ট করা বিভিন্ন ব্যক্তির আইডিতে গিয়ে গিয়ে এই উদ্ভট শব্দগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান অভিধানের অপর সম্পাদক পীয়্যান মুগ্ধ নবী।
সিমু বলেন, 'সম্পাদনার সবচেয়ে খাটনির কাজটুকু করেছে পীয়্যান। তবে, বিভিন্নভাবে আমাদের সাহায্য করেছে শান্ত কৈরী, আনন্দ, নাবিল, সাদীদ, দুর্জয়, তৌকির, সৈকত, সিয়াম, অন্তু, খালেদ, রাকিব, নাবিলাসহ আরও দশ-বারোজন মুরাদ টাকলা ভক্ত। বইটি লেখার সময় তারা কোথাও কিছু পেলেই আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেছে। অভিধানের ভিতরে দূর্দান্ত কিছু ব্যঙ্গাত্মক চিত্র এঁকে বইটিকে আরও প্রাণবন্ত করেছে তরুন প্রতিভা আরহাম হাবীব। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন রীশাম শাহাব তীর্থ। এছাড়া, মুরাদ টাকলা নিয়ে দুর্দান্ত একটি ছড়া লিখে দিয়েছেন প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন।'
কিন্তু স্বভাবইতই প্রশ্ন আসে, কেন মানুষ এই বইটি কিনবে? বা এই বইটির পাঠক সমাজ ঠিক কতটা বিশাল। হেসে সিমু জানান, 'বইটির কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় দুই বছর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটা আমরা প্রথম বাজারে আনি। অনেকটা চোখের পলকেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়! কিন্তু করোনার কারনে নতুন করে আর ছাপতে পারিনি। এবারের বইমেলা উপলক্ষে দ্বিতীয় মুদ্রণ এখন বাজারে। এই মুদ্রণও প্রায় শেষের পথে। যারা সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড ফলো করেন ও বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবেন তারাই মুলত আমাদের পাঠক। এবং এর সংখ্যা ব্যাপক।'
নাসের আরও জানান, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই বই কলকাতা আর নর্থ আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যেও ভালো চাহিদা তৈরি করেছে। দ্বিতীয় মুদ্রণের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই প্রায় ৫০০ কপির প্রিঅর্ডার আসে কলকাতা থেকে। ভারতে যে মুরাদ টাকলার এত ফ্যান আছে আমাদের জানা ছিলে না। তাদের অনেকে বইটি পড়ে চমৎকার সব রিভিউ দিয়েছেন।
বাংলিশে লেখার এ প্রবণতা কমে আসে বাংলার বিভিন্ন কিবোর্ড এবং বিশেষত অভ্র আসার পরে। তবে এখনো অনেকেই মাঝে মধ্যে বাংলিশে লেখে। আর সে লেখায় দেখা মেলে মুরাদ টাকলাদের। কিন্তু বাংলার চাপে এই সংখ্যাটা চাপা পড়ে গেছে এখন। আবার অনেকেই আগে হয়তো মুরাদ টাকলা ভাষায় লিখতেন, কিন্তু এখন লেখেন না। নিজের এমনি এক বন্ধুকে 'মুরাদ টাকলা অভিধান' উপহার দিয়েছেন নাজমুল হোসেইন। ২০২০ সালে বইমেলা থেকে দু'কপি কেনেন তিনি। তিনি বলেন, 'মুরাদ টাকলা ভাষা নিয়ে সে সময়টায় আমরা এত বেশি মেতে ছিলাম যে, বইটি বের হওয়ার পর আর দেরি করিনি। বইটির মাধ্যমে না-হয় সে সময়টা বেঁচেই থাকুক!'
বিনোদন আর সেই সময়টুকুকে ধরে রাখতেই মুরাদ টাকলা অভিধান
ভাষার 'বিকৃতি' নিয়েও যে একটি বই বের হতে পারে তার উদাহরণ মুরাদ টাকলা অভিধান। যে কারণে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে পাশের দেশেও এই বইটি সমাদৃত হয়েছে। যদিও অনেকেরই বইটি নিয়ে হয়তো বিপরীত মত আছে। যেমনটা হয়েছিল তানভীর সেলিমের বাবার ক্ষেত্রে। কিন্তু তানভীর জানান, মন খারাপ থাকলে, বইটি পড়লে তার মনটা হালকা হয়ে যায়। আর এটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।
তানভীরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সিমু বলেন, 'আসলে আমাদের একটা বড় অংশ মুরাদ টাকলা দেখে ও পড়ে বড় হয়েছে। এখন সেই সময়টা হয়ত তীব্রভাবে নেই, কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে ঠিকই রয়ে গেছে। সেই স্মৃতিটুকু ধরে রাখতেই ডিজিটাল মাধ্যমের বাইরে গিয়ে একে একটা ফিজিক্যাল রূপ দেওয়া হয়েছে। আর বইটিকে আমরা খুব সিরিয়াস একটি বই হিসেবেই বিবেচনা করি। কিন্তু পাঠক এটিকে রেফারেন্স বই হিসেবে নেবেন, নাকি নিছক বিনোদনের জন্যই পড়বেন, সে ভার পাঠকের।'