টাক, টাকলা নিয়ে দুই ছত্র!
দেবদাসকে নিয়ে মানুষ যেমন বলে-পার্বতী ভালো, চন্দ্রমুখী আরও ভালো! ঠিক তেমনি টাক মাথা ভালো নাকি ন্যাড়া মাথা ভালো? নাকি মাথা ভর্তি চুল থাকাটাই সবচেয়ে ভালো?
আসলে চুল যার যায়, সেই বোঝে 'ছাদখালি'র বেদনা! ন্যাড়া মাথা বা 'টাকলা' শব্দটা ইদানিং গুরুত্ব পেয়েছে অর্ন্তজাল (ইন্টারনেট) এক পেইজের জন্য যার নাম 'মুরাদ টাকলা'। এই পেইজ থেকে আগে বানান ভুলে ভরা পোস্ট দেওয়া হতো, বাংলা কথাটা লেখা হতো নাকি ইংরেজিতে! পরে দেশের এক মন্ত্রীর কল্যাণে পেইজটার নাম আবারো আলোচনায় আসে। এই মন্ত্রী ২০২১ এর ডিসেম্বরে 'নভেম্বর রেইন' এর পরিবর্তে 'ডিসেম্বর স্টর্ম' (নভেম্বর বৃষ্টির পরিবর্তে ডিসেম্বর ঝড়) চালু করতে যেয়ে নিজেই ঝড়ো হাওয়াতে হারিয়ে গেছেন। সমুদ্র উপকূল দিয়ে ভারতের দিকে বয়ে যাওয়া 'জাওয়াদ' (বহুদিন পর ছেলেদের নামে ঝড়) ঝড় 'মুরাদ টাকলা'র কল্যাণে 'মুরাদ' (এই আইডিয়াটা ধার করা) হয়ে গেছে বাংলাদেশে।
আসলে কোন নির্দিষ্ট টাকলাকে নিয়ে আজ আমরা ভাবতে বসিনি। কয়েক বছর ধরে এদেশের গণমাধ্যম একটা রোগে ভুগছে। রোগটার নাম কাব্য করে বলা যায় এভাবে-চোখে রাজার, ভালো সাজার, রোগ যে এলো দেশে! প্রধানমন্ত্রী রুষ্ঠ হওয়ার আগে পর্যন্ত এই মুরাদের বিরুদ্ধে কোন গণমাধ্যম তেমন কিছু বলে নি! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে পদত্যাগ করতে বলার পর পরই সব মিডিয়া এটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হলে গণমাধ্যম আর গণমাধ্যম থাকে না। যেটা চুলে ভরা সেটা হয়ে যায় টাকলা, যেটা টাকলা সেটা ন্যাড়া করেও শেষমেষ রক্ষা পাওয়া যায় না। এরচেয়ে ভালো আবারো চুল, ন্যাড়া আর টাকলা নিয়ে ভাবা!
চুল নিয়ে অবশ্য বাঙালির মাতামাতির অন্ত নেই। প্রধান দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের চুল ছিল দেখার মতো। জীবনানন্দ দাশ তো তাঁর কবিতায় চুলকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়- 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা!' রূপকথার চুলও আমাদের টানতো। রাজকণ্যার দীঘল কালো চুলের বিবরণ আমরা পড়েছি। এই চুল বেয়ে রাজকুমার আসতো আবার এই চুল বেয়েই নেমে যেত। ক্লিওপেট্রা ও তার চুলের যত্ন আত্তি নিয়ে নাকি গবেষণাও হয়েছে! চুল নিয়ে কত শত গান যে আছে!
বাংলা ছবির হিট গানের কথা এমন- 'খায়রুন লো তোর লম্বা মাথার চুল'। আর জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা গান- 'এক যে ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ/ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ!' মেঘবরণ কেশ বাঙালির এক প্রিয় উপমা!
এবার ন্যাড়া। ন্যাড়া মাথার অনেক বিখ্যাত মানুষ আছেন। একজন টেলি স্যাভেলাস। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত 'কোজাক' সিরিয়ালের জন্য দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কয়েকটি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। এমন আরেকজন অভিনেতার নাম ইয়োল ব্রাইনার। 'ডেথ রেজ' ছবির নায়ক ইয়োল ব্রাইনার ন্যাড়া মাথা কিংবা চুল নিয়েও নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বাংলাদেশের জসীম, ওয়াসীম আর সোহেল রানা'রা পরচুলা পরেই অভিনয় করতেন। হলিউডি ছবির জনপ্রিয় দুই নায়ক গ্রেগরি পেগ আর ওমর শরীফের ছিল বিবিধ রকম পরচুলার কালেকশন। অন্যদিকে বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন ও আইনস্টাইন আজীবন চুল নিয়ে ভাবার কোন সময়ই যেন পাননি। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতো এই দুই বিজ্ঞানীরও ছিল দৃষ্টিনন্দন চুল।
সবশেষে আবারো টাকলা। উপমহাদেশের বিখ্যাত এক টাকলার নাম (অভিনেতা) অনুপম খের। তার একটা বিখ্যাত উক্তি আছে এমন- 'চুলের চিন্তায় মাথার চুল আরও বেশি নষ্ট করবেন না। যতই টাকা ঢালুন মাথা না চাইলে আপনি চুল রাখতে পারবেন না। বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াতের কাছে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেয়া যেতে পারে!
অবশ্য টাক ঢাকার জন্য আরেকটা পদ্ধতি আছে যার নাম ক্যাপ পদ্ধতি। আইয়ুব বাচ্চর মতো মাইলস খ্যাত হামিন ও শাফিন আহমেদ আজীবন এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। বাংলাদেশে পরচুলা পরিহিত একজন গায়ক ছিলেন (এখনও আছেন তবে গানে সম্ভবত নেই!) যার একটা গান ছিল চরম হিট। তো সেই গায়ক একবার গান গাইতে গিয়েছিলেন এক বড়লোকের বাগান বাড়িতে। গানের মাঝখানে প্রবল বাতাস শুরু হলে পরচুলা উড়ে গিয়ে পড়লো পুকুরে! খানিক পরে দর্শক সব চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো শিল্পীর জন্য। টাক মাথার শিল্পীকে তারা পরচুলা পরা শিল্পীর সঙ্গে মেলাতেই পারলো না! মানুষ কেন যেন ন্যাড়া মাথাকে ফ্যাশন মনে করে কিন্তু টাকলা মাথার পুরুষদের ব্যঙ্গ করে। হুমায়ূন আহমেদ তার এক লেখায় লিখেছিলেন তিনি কোনো টাক রিক্সাওয়ালা দেখেননি, কিন্তু অনেক পয়সাওয়ালা দেখেছেন যাদের মাথা ভর্তি টাক! সম্ভবত টাকার সাথে টাকলাদের কোন সম্পর্ক আছে! কিন্তু কখনো সখনো টাকলাদের সাথে 'টাকিলা'রও সম্পর্ক থাকে!
প্রিয় পাঠক ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ চলে এসেছে বলে। পত্রিকার চাকরি করতে এসে আমি কেন ন্যাড়া হলাম সে গল্প লিখেছি, বহুবার টেলিভিশনেও বলেছি। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত পদত্যাগ এর ঘটনায় একজন আমার ইনবক্সে লিখেছেন- 'দুনিয়ার টাকলারা এক হও!' আরেকজন লিখেছেন-ভাই 'আমি জামালপুরের মুরাদ কিন্তু মুরাদ টাকলা নই! সে এখন থেকে আর জামালপুরের বা সেখানকার আওয়ামী লীগের কেউ না। দুঃখ এই মন্ত্রী সাহেবরাও আজকাল 'টাকিলা' খেয়ে কথা বলে'!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মুরাদ সাহেব মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন, তার গান,নাচ ও হুমকি দেওয়ার ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়েছে বলে। এরপর থেকে উনি ক্রমশঃ রাজনীতি আর আলোচনার বাইরে চলে গেলেও মনের বাইরে যাবে না অনেক কিছু। বহুদিন পরেও কেউ না কেউ প্রশ্ন তুলবে উনি নারীদের সম্মান করা কখনো শেখেন নি? তার মা,বোন,স্ত্রী কিংবা কন্যাদের অবস্থা কী হবে ভবিষ্যতে? তার কর্ম কী কখনো এদের স্পর্শ করবে না? প্রশ্ন উঠবে তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন কীভাবে? মুখ খারাপ হওয়া গর্বের হয় কী করে? একজন চিত্রনায়িকার সাথে মানুষ কী এভাবে কথা বলে? বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও তার কন্যা জাইমাকে নিয়ে অশ্লীল ধরনের কথা বলার পরেও কেন কোনো মিডিয়া তাকে নিয়ে সরব হয়নি?
মন্ত্রীদের সমালোচনা না করে আমরা বরং কৌতুক শুনি। লেখাতে কৌতুক ব্যবহার না করলে সেটা নাকি তেমন জমে না। তাই মন্ত্রী বিষয়ক কৌতুক। ছোটদের স্কুলে এক পরিদর্শক এসেছেন। তিনি শিশুদের কাজকর্ম দেখে ভবিষ্যত বলে দেন। একজন শিশু কাগজ দিয়ে এরোপ্লেন বানিয়ে উড়ালো। পরিদর্শক বললেন ছেলেটা এয়ারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার বা বিমান চালক হবে। একজন ফুটবল এঁকে নিয়ে আসলো। পরিদর্শক বললেন সে ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড় হতে চায়। একজন নদী,পাখি ও গাছপালার ছবি এঁকে আনলো। পরিদর্শক বললেন তার চিত্রশিল্পী বা কবি হবার সম্ভাবনা প্রবল। সবশেষে একজন শিশু এসে বললো-'সবাই দাঁড়াও। আমার কথা শোন। কেউ কিছু ধরবে না। চেয়ার,টেবিল,ছবি,ফুটবল,ফ্যান, ছবি আঁকার রং,তুলি ও ইজেল সব আমি নিয়ে যাব। বাচ্চা ছেলেটি এরপর তার গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে সব তার গাড়িতে তুলতে বললো'।
পরিদর্শক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আমি নিশ্চিত, বড় হয়ে এই ছেলে মন্ত্রী হবেইইই!!
- লেখক: রম্য লেখক