বোতলজাত পানির রমরমা ব্যবসা; বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণ
বোতলজাত পানির ব্যবসা যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। নতুন এক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি পানির বোতল বিক্রি হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ বিক্রি দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
তবে বোতলজাত পানির ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে নানা নেতিবাচক দিক। সদ্য প্রকাশিত ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট ফর ওয়াটার, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেলথের গবেষণালব্ধ রিপোর্ট অনুযায়ী, এ ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশগত, জলবায়ুগত ও সামাজিক ঝুঁকি বাড়ছে। খবর সিএনএন এর।
প্রতিবছর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করতে যেয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে বোতলজাত পানি উৎপাদন করা হচ্ছে। যার ফলে জনসাধারণের নিত্যদিনের চাহিদা অনুযায়ী একটি দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরই যে দায়িত্ব সুপেয় পানির জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করা, সেটি আড়ালে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে এ পানির বোতলগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিক।
দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প
রিপোর্টে বিশ্বের ১০৯টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বোতলজাত পানি বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৭৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসাটি এত দ্রুত বাড়তে থাকায় বর্তমানে একে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পের একটি বলেও বিবেচনা করা হচ্ছে।
২০২১ সালে বিশ্বে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন লিটারের বোতলজাত পানি বিক্রি হয়েছে। অর্থের হিসেবে যা প্রায় ২৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে এ বিক্রি প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এত বৃহৎ শিল্প হলেও পুরো বিশ্বের ২৫ ভাগ বোতলজাত পানি বিক্রির দখল মাত্র পাঁচটি কর্পোরেশনের অধীনে। কোকাকোলার মালিকানাধীন ডাসানি, পেপসিকোর মালিকানাধীন অ্যাকুয়াফিনা, নেসলে, ডেনন ও প্রিমো ২০২১ সালে মোট ৬৫ বিলিয়ন ডলারের বোতলজাত পানি বিক্রি করেছে।
বোতলজাত পানি পুরো বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয়। এরমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে সবমিলিয়ে পুরো বিশ্বের ৬০ ভাগ বোতলজাত পানির ব্যবসা রয়েছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভৌগলিক অবস্থানভেদে বোতলজাত পানি পানের উদ্দেশ্যে ভিন্নতা রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে ট্যাপের পানি খুবই সহজলভ্য এবং তা পান করার যোগ্য। কিন্তু তবুও উন্নত দেশগুলোতে বোতলজাত পানি পানকে অনেকটা আভিজাত্যের চর্চা বলে ধরে নেওয়া হয়। এছাড়াও ট্যাপের পানি থেকে বোতলজাত পানি বেশি স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু মনে করার প্রবণতা থেকেও অনেকসময় তা পান করা হয়।
এ বিষয়ে গবেষণাটির নেতৃত্বে থাকা জেইনেব বোহলেল সিএনএনকে বলেন, "বোতলজাত পানি বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশনগুলো ভোক্তাদের মাঝে এমন ধারণা তৈরি করেছে যে, বোতলজাত পানি ট্যাপের পানি অপেক্ষা বেশি বিশুদ্ধ।"
অন্যদিকে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সুপেয় পানির ট্যাপের সংকট রয়েছে। যার ফলে এসব দেশের মানুষকে অনেকটা বাধ্য হয়েই বোতলজাত পানি কিনতে হয়।
গবেষণাটির সাথে সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘের ওয়াটার থিংকট্যাঙ্কের সাবেক পরিচালক ভ্লাদিমির স্মাখতিন জানান, বোতলজাত পানির শিল্পের প্রসারের ফলে জনসাধারণের সুপেয় পানির জন্য অবকাঠামো তৈরির যে প্রয়োজনীয়তা, সেটি আড়ালে চলে যাচ্ছে। এর ফলে পানির প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে এক প্রকার অসমতা তৈরি হচ্ছে এবং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর কারণে এ ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বোতলজাত পানি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশনের এক মুখপাত্র সিএনএনকে জানান, "আমরাও চাই জনসাধারণের জন্য পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।"
এ মুখপাত্র আরও বলেন, "তবে নিরাপদ পানি পানের জন্য বোতলজাত পানিও প্রয়োজনীয়। কেননা উন্নয়নশীল বহু দেশেই যখন নিরাপদ সুপেয় পানি পাওয়া যায় না, তখন বোতলজাত পানি বিকল্প হিসেবে সে চাহিদা পূরণ করে।" এছাড়াও অন্য বেভারেজ পণ্যের তুলনায় বোতলজাত পানি শিল্পে তুলনামূলক কম বিজ্ঞাপন করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
পানি উত্তোলন
বোতলজাত পানি তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট খরা, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে বোতলজাত পানি তৈরির কারণে বিশ্বের বহু অঞ্চল হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
কৃষিকাজে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে বোতলজাত পানি শিল্পের ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে কৃষিতে সেচ প্রকল্পে তা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। তারাও এর ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে।
বোতলজাত পানি তৈরিতে মাটি থেকে পানি উত্তোলন বড় পরিসরে খুবই সামান্য পরিমাণ মনে হলেও স্থানীয় পর্যায়ে এর খুবই বড় প্রভাব রয়েছে। এমনকি বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কিছু প্রতিষ্ঠান যেসব জায়গা থেকে পানি উত্তোলন করছে, ক্ষেত্রবিশেষে সেখানে ইতোমধ্যেই পানির সংকট রয়েছে। যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝেও এসব কোম্পানির ওপর অসন্তোষ রয়েছে।
নেসলে ওয়াটারস নর্থ আমেরিকা নামের প্রতিষ্ঠান (যেটি বর্তমানে ব্লু ট্রাইটন নামে পরিচিত) বোতলজাত পানি তৈরিতে ক্যালিফোর্নিয়ার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় সমালোচিত হয়েছে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ রাজ্যটি ইতোমধ্যেই খরার ঝুঁকিতে রয়েছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে নেসলে ওয়াটার প্রতিদিন ফ্লোরিডা রাজ্যের ভূগর্ভ থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ লিটার পানি উত্তোলন করেছে। অন্যদিকে একই বছর ফ্রান্সে আরেক ওয়াটার কোম্পানি ডেনন প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করেছে।
এ বিষয়ে নেসলের এক মুখপাত্র বলেন, "সংরক্ষণশীল মানসিকতা নিয়ে আমরা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছি এবং দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে আমরা কার্যকরীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছি।"
অন্যদিকে ডেনন কোম্পানির এক মুখপাত্র বলেন, "আমরা পানি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছি। রিপোর্টে আমাদের পানি উত্তোলনের যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। বরং বোতলজাত পানি শিল্পে খুবই কম পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হয়।"
রিপোর্ট মতে, সর্বোপরি বোতলজাত পানি উৎপাদনে ঠিক কী পরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে তোলা হচ্ছে সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেই। অনেক দেশেই আবার ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনায় তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় না। যার ফলে পরিবেশগত ঝুঁকির কথা বিবেচনা না করেই ইচ্ছামতো পানি তোলা হয়।
বোতলজাত পানি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বলেন, "বোতলজাত পানি উৎপাদনে অনেক পানি ব্যবহার করার যে দাবি করা হয়, সেটির বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যবহৃত পানির মাত্র ০.০১ ভাগ বোতলজাত পানি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।"
প্লাস্টিক দূষণ
২০২১ সালে বোতলজাত পানি শিল্পে মোট ৬০০ বিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এসব বোতল তৈরিতে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বোতলগুলোর বেশিরভাগই আর রিসাইকেল করা হয়নি এবং এগুলো প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পরেছে।
অন্যদিকে প্লাস্টিকগুলো তৈরিতে ব্যাপক পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক দূষণ রোধে কাজ করে যাওয়া জুডিথ এঙ্ক এই প্লাস্টিকগুলোকে 'ক্লাইমেট কিলার' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
২০২১ সাথে আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্লাস্টিক শিল্পকে যদি একটি আলাদা একটি দেশ হিসেবে কল্পনা করা হয়, তবে সেটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ গ্রিন হাউজ গ্যাসের উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো।
রিপোর্ট অনুযায়ী, প্লাস্টিক বোতলগুলোর শতকরা ৮৫ ভাগ পরিবেশে বর্জ্য আকারে ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা মিশে যেতে প্রায় ১ হাজার বছর লাগবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীর সমুদ্রগুলোতে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন টন ওজনের প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে রয়েছে। প্লাস্টিক বোতলগুলো বর্জ্য আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার পর তা ভেঙে মাইক্রো-প্লাস্টিকে রুপান্তরিত হতে পারে। আর এই মাইক্রো-প্লাস্টিক ধীরে ধীরে খাদ্য, পানি ইত্যাদিতে প্রবেশ করে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে প্লাস্টিক থেকে বিষাক্ত নানা রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরিত হতে পারে যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করে।
ইন্টারন্যাশনাল পলিউটেন্ট ইলিমিনেশন নেটওয়ার্কের সায়েন্স ও টেকনিক্যাল উপদেষ্টা থেরেস কার্লসন বলেন, "এটা খুবই উদ্বিগ্নের ব্যাপার যে আমরা এমন একটা সিস্টেমে জড়িয়ে যাচ্ছি যেখানে পানি পান করতে যেয়ে আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। আর এই প্লাস্টিকে রয়েছে নানা ক্ষতিকারক ক্যামিকেল, যা বর্জ্য আকারে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে।"
বোতলজাত পানি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বলেন, "পরিবেশগত দিকটি বিবেচনা করা বোতলজাত পানি শিল্পের ইতিহাসের অংশ। সরকার, ইন্ডাস্ট্রি, জনসাধারণের জন্য কাজ করে যাওয়া প্রতিটি সম্প্রদায়ের উচিত পানির বোতল পুনরায় ব্যবহারের জন্য সকলকে অনুপ্রাণিত করা।"
প্লাস্টিক বোতলের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব বোতল তৈরির বিষয়ে প্রচেষ্টাও চলছে। তবে রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনো আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। কিছু কোম্পানি বায়োডিগ্রেডেবল বোতল তৈরির চেষ্টাও করছে।
কিন্তু ইঙ্ক মনে করেন, এতে করে সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, "বাস্তবতা হচ্ছে, বায়ো-প্লাস্টিকগুলোর বেশিরভাগই বায়োডিগ্রেডেবল নয়। প্লাস্টিক দূষণ কমাতে হলে রিসাইকেল করা হয় না এমন সবক্ষেত্রে প্ল্যাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে।"
রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও প্লাস্টিক দূষণ আসন্ন খরাপ্রবণ দিনগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ।
স্মাখতিন বলেন, "ভবিষ্যতের খরাপ্রবণ জলবায়ুর জন্য প্রস্তুতি নিতে আমাদের সকলের বাড়িতে নির্ভরযোগ্য পানির উৎস নিশ্চিত করতে হবে। আপনি যদি সেটা না করতে পারেন, তবে আপনি এই বৈশ্বিক ক্রমবর্ধনশীল তাপমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। বোতলজাত পানি আপনার তৃষ্ণা সাময়িকভাবে মেটাবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারবে না।"