দেশের মৃৎশিল্প যেন অন্য দেশের মানুষও চেনে
ঘরের সাজে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া আনতে যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের প্রথম পছন্দ মৃৎশিল্পের সামগ্রী। মাটির তৈজসপত্র, ফুলদানি, টেরাকোটার নানা সামগ্রী বদলে দেয় পুরো ঘরের আবহ। গ্রামবাংলার বিশুদ্ধতার ঘ্রাণের পাশাপাশি আমাদের শেকড়ের কথাও মনে করিয়ে দেয় এই শিল্প। দৈনন্দিন জীবনে চলাচলের সময় ঢাকার নানান রাস্তার ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা বিচিত্র নকশার মাটির সামগ্রীগুলোর দিকে চোখ আটকে যায় না এমন শৌখিন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কুমার পাড়া থেকে রাজধানীর ব্যস্ততম রাস্তার পাড়ে যাদের হাত ধরে আসে এই মৃৎশিল্পের সামগ্রী আসে তাদের মধ্যে অন্যতম এক নাম 'ভোলা মৃৎশিল্প'।
মাটির শিল্পীদের হাতের ছোঁয়া আর নৈপুণ্যতায় তৈরি পণ্যগুলো মহানগরীর বাসিন্দাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ভোলা মৃৎশিল্প পালন করছে প্রায় তিন যুগ ধরে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মাটির শিল্পকে দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন বিদেশেও। হুমায়ূনের দাবি, হস্তশিল্পের পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ভোলা মৃৎশিল্প।
দোয়েল চত্বর থেকে পথচলা
গল্পের শুরু আশির দশকের শেষের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকা সংলগ্ন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সামনে মৃৎশিল্প সামগ্রীর মেলা বসতো বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিনে। দেশের নানা প্রান্তের কুমার পরিবার থেকে মাটির সামগ্রী নিয়ে মেলায় উপস্থিত হতেন পাল বংশের মৃৎশিল্পীরা। একবার মেলা চলাকালীন শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি, পালরা মেলার সামগ্রী নিয়ে পড়লেন বিপাকে। শিশু একাডেমির গেটে থাকা এক সিকিউরিটি গার্ডের কাছে সেসব সামগ্রী রেখে গেলেন তারা। পালদের সাহায্য করতে সেই গার্ড মাটির সামগ্রীগুলো বিক্রি করার উদ্যোগ নিলেন।
শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গায় মৃৎশিল্পের পসরা দেখে অচিরেই আকৃষ্ট হলেন বিপুল সংখ্যক ক্রেতা। তাদের আগ্রহ দেখে কিছুদিনের ভেতরই সেখানে শুরু হলো মৃৎশিল্পের কিছু অস্থায়ী দোকান। পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, সাভার, মাদারীপুর, গাজীপুর ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে আসতো মৃৎশিল্পের সামগ্রী। ভোলা মৃৎশিল্পের পথচলা শুরু হয় এর মধ্য দিয়েই।
হুমায়ূন কবিরের বাবা মোহাম্মদ রুহুল আমিন ছিলেন সরকারি কর্মচারী। ঢাকায় চাকরির পাশাপাশি মৃৎশিল্পের সম্ভাবনাময় ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন গ্রামের বাড়ি ভোলার কুমারপাড়া থেকে মৃৎশিল্পের সামগ্রী ঢাকার দোয়েল চত্বরে এনে বিক্রি করবেন। সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে দোয়েল চত্বরের ছোট দোকান থেকেই শুরু হয় ভোলা মৃৎশিল্প।
হুমায়ূন কবির বাবার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেওয়ার পর লক্ষ্য করলেন মৃৎশিল্প সামগ্রীর চাহিদার সঙ্গে যোগানের অসামঞ্জস্যতা। কুমার পাড়া থেকে মাটির সামগ্রী ঢাকায় পৌঁছাতে প্রায়ই দেরী হতো। এতে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য যোগান দেওয়া যেত না অনেক সময়। ২০০০ সালের পর হুমায়ূন ব্যবসায় আনলেন নতুন মোড়। দেশের নানা প্রান্তের কুমারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে নানান ধরনের মাটির পণ্য জোগাড় করা শুরু করেন তিনি।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিখ্যাত সব পালদের তালিকা করেন হুমায়ূন। যার কাছে যেসব বিশেষায়িত মাটির পণ্য পেয়েছেন সব এনে মজুদ করেন ঢাকায়। তারপর সংগ্রহকৃত পণ্যগুলো সরবরাহ করতে শুরু করেন দোয়েল চত্বরের ব্যবসায়ীদের কাছে। ধীরে ধীরে হুমায়ূন কবিরের সংগৃহীত পণ্য ধানমন্ডি, মিরপুরসহ ঢাকার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বছর জুড়ে নানা সময়ে আয়োজিত কুটির শিল্পের মেলাতেও এসব সামগ্রী সরবরাহ করতেন হুমায়ূন। ক্রেতার চাহিদা বুঝে কুমারদের নতুন নতুন নকশার অনেক পণ্য অর্ডার দিয়েও বানানো শুরু করেন অচিরেই।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি বিদেশেও এসব পণ্য সরবরাহ করে চলেছেন তিনি। হুমায়ূন কবির বলেন, "যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই-এর মতো দেশে প্রতিনিয়তই মাটির সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে ভোলা মৃৎশিল্প। ব্যবসার বাইরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত থেকেও প্রায়ই অর্ডার আসে আমাদের কাছে।" হুমায়ূনের সংগ্রহে মাটির পণ্য ছাড়াও আছে বাঁশ, বেত, পাটের তৈরি কুটির শিল্পের অসংখ্য সামগ্রী।
অনলাইনে প্রসার
ভোলা মৃৎশিল্পের ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থী মঞ্জুর কিবরিয়া ভূঁইয়া। তার পরামর্শেই ২০১৯ সাল থেকে অনলাইনে ব্যবসা প্রসারিত করেন হুমায়ূন কবির। দূর-দূরান্তের গ্রাহকেরা সহজেই নিজেদের পছন্দের যেকোনো পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন অনলাইন পেজে অর্ডার করে।
করোনাকালে সাধারণ মাটির সামগ্রীর স্টলগুলো যখন প্রায় বন্ধ হতে চলেছিল অনলাইনই ছিল মূল ভরসা। খুচরা পণ্যের অর্ডারগুলোই মূলত অনলাইনে নেওয়ার উদ্যোগ নেন কিবরিয়া। দেশ-বিদেশের নানান প্রান্তের গ্রাহকদের কাছে অনলাইনের মাধ্যমে সহজে পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছানো গেলেও অক্ষত অবস্থায় পণ্যগুলো পৌঁছে দেওয়া ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সাধারণ কুরিয়ারে পণ্য ডেলিভারি করতে গিয়ে বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে। তাই মাটির সামগ্রী ডেলিভারির জন্য নিজস্ব ডেলিভারি ম্যানের ব্যবস্থা করেছেন তারা। এতে ডেলিভারির খরচ বেশি হলেও অক্ষত অবস্থায় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
কিবরিয়ার ভাষ্যে, "সারাদেশে এবং দেশের বাইরে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন পণ্য যোগান দেওয়ার প্রতিষ্ঠান এখনো খুব কম। আমারা এই অপ্রতুলতা কমানোর চেষ্টা করছি। অফলাইন, অনলাইন দুই মাধ্যমেই সমানভাবে সক্রিয় না হলে বর্তমান সময়ে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ভোলা মৃৎশিল্পকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও সমান গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত করার উদ্যোগ নিয়েছি।"
দেশের প্রথম অটোমেটেড মৃৎশিল্পের কারখানা
এবছর জানুয়ারি মাস থেকে কেরানীগঞ্জের মুজাহিদনগরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোলা মৃৎশিল্পের নিজস্ব কারখানা। যেটিকে দেশের প্রথম অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় মৃৎশিল্পের কারখানা দাবি করেছেন তারা। নানা অঞ্চল থেকে মাটি সংগ্রহ করার পর কারখানায় স্বয়ংক্রিয় মেশিন দিয়ে তা প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সাধারণ পদ্ধতিতে মাটি থেকে আবর্জনা বাছাই করে প্রক্রিয়াজাতকরণে যেখানে কয়েক দিন লেগে যেত, সেখানে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের কারণে কাজটিতে লাগছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। যে কারণে জনশক্তিও প্রয়োজন হচ্ছে কম।
তবে মাটি প্রক্রিয়াজাতকরণের পর শিল্পের বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এখনো পুরোপুরি নির্ভর করা হয় কুমারদের হাতের কাজের উপরই। কারখানাটিতে বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন শ্রমিক। যাদের বেশিরভাগই নারী। কারখানার কর্মকান্ডের তদারক করেন হুমায়ূন কবির নিজেই।
ঢাকার চানখাঁরপুলের মাজেদ সরদার রোডে অবস্থিত ভোলা মৃৎশিল্পের ডিসপ্লে সেন্টার। যেকোনো ক্রেতা সরাসরি খুচরা বা পাইকারি হিসেবে সেখান থেকে ক্রয় করতে পারেন নিজেদের পছন্দমতো হস্তশিল্পের সামগ্রী।
বর্তমানে প্রতি মাসে ভোলা মৃৎশিল্পের অনলাইন প্লাটফর্মেই বিক্রি হয় প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার মাটির সামগ্রী। অফলাইনে পাইকারি বিক্রির পরিমাণ মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। দেশের মৃৎশিল্পকে কুটির শিল্পের জায়গা থেকে বের করে বৃহৎ শিল্পের মর্যাদা অর্জন করানোই হুমায়ূন কবিরের স্বপ্ন। ভোলা মৃৎশিল্পের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে যেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি পরিচিতি পায় সে চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।