যেভাবে তৈরি হচ্ছে মাটির তৈজসপত্র থেকে টেরাকোটা টাইলস
ঝুম বৃষ্টি। পরপর লাগোয়া কয়েকটি ঘর। সবগুলোতেই নানান কাজে ব্যস্ত কিছু মানুষ। কেউ মাটির পাত্র তাক তাক করে সাজাচ্ছে খড়ের ভেতর, কেউ হুইল মেশিনে মাটির দলা ফেলে হাতের নৈপুণ্যে নিমিষেই বানিয়ে ফেলছে মাটির পাত্র, আবার কেউ মাথায় করে মাটি এনে ফেলছে মেশিনের ভেতর।
বৃষ্টির ভেতরেও এভাবে নিরলস কাজ করছেন কুমিল্লার বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির কর্মচারীরা। বাংলাদেশের লোকশিল্পের অন্যতম ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প। মাটির তৈরি নানান নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্র ও শৌখিন পণ্যকে মৃৎশিল্প বলা হয়।
আমাদের দেশে মৃৎশিল্পের চর্চা প্রায় হাজার বছর পুরনো। প্রাচীনকালের মৃৎশিল্পের নমুনা কুমিল্লাতেই আছে। ময়নামতি জাদুঘরে দেখা যায় সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর নানা টেরাকোটা ও পোড়ামাটির ফলক।
কুমিল্লার বিজয়পুরে ও এর আশেপাশের কিছু গ্রামজুড়ে পাল বংশের লোকরা মৃৎশিল্পের চর্চা করে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তাদেরই হাত ধরে গঠিত হয় বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। বিজয়পুরে ঢুকে কিছুটা সামনে আগালেই তাদের মৃৎশিল্প কারখানা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর বিক্রয় কেন্দ্রের অবস্থান। কেনার পাশাপাশি যে কেউ চাইলে ঘুরে আসতে পারেন তাদের কারখানা থেকে।
মৃৎশিল্পী বা কুমারদের সুক্ষ্ম হাতের কাজ দেখা বেশ উপভোগ্য। মাটির দলা থেকে দৃষ্টিনন্দন শো-পিস তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া দেখার জন্য দেশের বাইরে থেকে অনেক দর্শনার্থী আসেন। আর দেশের মানুষের ভীড় তো লেগেই থাকে নিয়মিত। আমরাই যেমন গিয়েছিলাম দেখতে। গিয়ে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির ম্যানেজার বিপ্লব চন্দ্র পালের সাথে আলাপ হলো মৃৎশিল্প পল্লীর নানা দিক নিয়ে।
শুরুর গল্প
গত দুই-তিন শতাব্দী ধরে বিজয়পুর এলাকা মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু ষাটের দশক থেকে নানান কারণে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মৃৎশিল্পকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে বিজয়পুর এলাকার কুমার ও পাল বংশের ব্রাহ্মণরা 'প্রগতি সংঘ' নামে এক সংগঠন তৈরি করেছিলেন
তার এক বছর পরেই, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) এর প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান বিজয়পুরে এসে তাদেরকে শিল্পভিত্তিক সমবায় সমিতি তৈরি করার পরামর্শ দেন। একই বছর ২৭ এপ্রিল বিজয়পুর এলাকার কুমার ও পালদের সাতটি গ্রামের মানুষ একসাথে হয়ে বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। সেই সাতটি গ্রাম এখনো আছে।
গ্রামগুলো হলো— উত্তর বিজয়পুর, দক্ষিণ বিজয়পুর, টেগুরিয়াপাড়া, দুর্গাপুর, নোয়াপাড়া, গাঙকুল ও বরোপাড়া।
প্রথমদিকে, সমিতির সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫ জন। আমানত হিসেবে সবাই আট আনা করে মোট ৭ টাকা ৫০ পয়সা জমা করেন। শেয়ারে সবাই ১০ টাকা করে দিয়ে মোট ১৫০ টাকা ওঠে। সবমিলিয়ে ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা মূলধন দিয়ে শুরু হয় বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির যাত্রা।
আমাদের দেশে সমবায় সমিতির ইতিহাসের একদম প্রথমদিকে নিবন্ধিত হওয়া সমিতি এটি। বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির নিবন্ধন নম্বর ৩৭। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা ২৫০ জন।
প্রতিষ্ঠার পরেই ১৯৬৪ সালে তারা ১২ হাজার টাকা ঋণ ও একটি কয়লার চুলা পায় ঢাকার একটি সংস্থা থেকে। রুরাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি (আরআইএস) নামক এই সংস্থা তখন গ্রামীণ নানান লোকশিল্পের কল্যাণে কাজ করতো। কয়লার চুলা পাওয়ার কারণে মৃৎশিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ।
কয়েক বছর সফলতার সাথে মৃৎশিল্প উৎপাদন ও বিক্রয়ের কাজ চালিয়ে যান তারা। তারপর দেশে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতির অফিস ও কারখানা জ্বালিয়ে তছনছ করে দেয়। সমিতির সদস্য ও শিল্পীরা সবাই পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসে দেখেন তাদের সমিতি ধ্বংস হয়ে সেখানে জঙ্গল তৈরি হয়েছে।
ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার করে তারা আবার মৃৎশিল্পের কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে কুমিল্লা সফরে আসেন। কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। তখন 'ইন্দিরা-মুজিব' যৌথ ক্যালেন্ডার সারাদেশে পাওয়া যেত। বিজয়পুরে শিল্পীরা সে ক্যালেন্ডার দেখে একটি ত্রিমাত্রিক মডেল বানান প্লাস্টার দিয়ে। সমিতির পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে তা তুলে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাজ দেখে খুশি হন। বিজয়পুরের ভগ্ন অবস্থার কথা শুনে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়কে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিকে ৭৫,০০০ টাকা অনুদান দিতে। স্থানীয় প্রশাসনকেও নির্দেশ দেন তাদেরকে সহযোগিতা করতে। স্থানীয় প্রশাসন টিন, সিমেন্ট ও ২০০ স্কয়ার ফুট কাঠ যোগান দেয় সমিতির নতুন অবকাঠামো তৈরি করার জন্য।
১৯৭৫ সাল। আবার বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে সহায়তা পান বিজয়পুরের মৃৎশিল্পীরা। সে বছর জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতির বিশেষ তহবিল থেকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) মৃৎশিল্প সমিতিকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিল বৈদ্যুতিক চুলা বসানোর জন্য। কিন্তু ওই বছরেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পরে সে অনুদানের টাকা আর পাননি তারা।
১৯৮২ সালে বিসিক সেই বৈদ্যুতিক চুলা বসাতে সক্ষম হয়। কিন্তু চুলাটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ— যা আর কাজে লাগাতে পারেনি সমিতি। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে ফার্নেস অয়েলের একটি চুলা লাগিয়ে দেয় বিসিক।
মৃৎশিল্পের কাজের জন্য তাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটির পণ্য তৈরির পর সেটিকে ১২০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়। এত বেশি পরিমাণ তাপের জন্য গ্যাসের সংযোগ প্রয়োজন ছিল। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৪ সালে সাড়ে ৮ কিলোমিটার দূর থেকে গ্যাসের সংযোগ পান তারা। এরপর থেকে উৎপাদন ও লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। লভ্যাংশ দিয়ে সমিতি থেকে প্রায় ৮৮ শতাংশ জমি কেনা হয় নতুন কারখানা তৈরির জন্য।
উৎপাদন বাড়াতে ১৯৯৭-৯৮ সালে সমিতির সদস্যরা ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কয়লার চুল্লি কেনেন। সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমবায়ের মৃৎশিল্প উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প থেকে কুমিল্লা বিজয়পুর মৃৎশিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালে ২ কোটি ৫১ লাখ ৩৯ হাজার বরাদ্দ দেওয়া হয় তাদেরকে।
বরাদ্দকৃত টাকায় আধুনিক কারখানা, ট্রেনিং সেন্টার, হোস্টেল ভবন, প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় নির্মাণ ছাড়াও উপকরণের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। ২০১০ সালে আবার সমবায় অধিদপ্তর প্রকল্পের অনুদানে পায় সাড়ে ২২ লাখ টাকা মূল্যের একটি বড় গ্যাসের চুল্লি। এভাবেই নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিজয়পুর বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
'মাটি থেকে খাঁটি…'
"এই যে দেখেন, এই এক দলা মাটি যোগালি রেডি করে আনলো। পানি দিলাম, হুইল মেশিনে মাটি ফেলে ধরলাম হাত দিয়ে, ডিজাইন মতো উপরে টান দিয়ে বানায়ে নিলাম হাঁড়ি। এবার এটারে শুকায়ে আগুনে দিলেই আপনি ব্যবহার করতে পারবেন এই জিনিস। মাটি থেকে হয়ে গেলো খাঁটি!", হাতের নৈপুণ্যে নিমিষেই মাটি থেকে হাঁড়ি বানানোর প্রক্রিয়া দেখাতে দেখাতে বলছিলেন মৃৎশিল্পী রত্না রানী পাল।
আসলে মাটি দিয়ে জিনিস বানানো এত সহজ নয়। এর পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সমিতির ম্যানেজার বিপ্লব চন্দ্র পালের সাথে আলাপ করে জানা গেলো এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
মাটি দিয়ে জিনিস বানাতে হলে লাগে ভালো মানের মাটি। যেকোনো মাটি দিয়ে এই কাজ করা সম্ভব না। এরজন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের এটেল মাটি। এই মাটি সংগ্রহ করা হয় শীতকালে। শীতকালে পুরো বছরের কাজের জন্য মাটি সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখা হয়। এরপর এই মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে নরম করা হয়। নরম করার পরে মাটিকে 'অগার মেশিন' নামক একটি মেশিনে ঢুকিয়ে লম্বাটে আকারের মণ্ডের রূপ দেওয়া হয়।
সেই মাটির মণ্ডকে আবার শ্রমিকরা প্রয়োজন মত পানি দিয়ে দলাই-মলাই করে ছোট-ছোট মণ্ড বানায়। সেই মণ্ড দিয়ে মৃৎশিল্পীরা ডিজাইন ও পাত্রের আকার অনুযায়ী নির্দিষ্ট আকৃতিতে রূপদান করে হুইল মেশিনের সাহায্যে।
একটি আকৃতির পাত্র অনেক বেশি পরিমাণে তৈরি করতে হলে বারবার হুইল মেশিনে হাত দিয়ে কাজ করেন না তারা। জিপসাম দিয়ে বিভিন্ন আকারের ছাঁচ বানানো হয়। সেই ছাঁচে মাটি দিয়ে চাপ দিয়ে হুইল মেশিন ঘুরোলেই তৈরি হয়ে যায় কাঙ্খিত আকৃতির পাত্র। এতে করে সময়ও বাঁচে আর পাত্রের আকারও হয় নিখুঁত।
মাটিকে বিভিন্ন আকারে রূপ দেওয়ার পর এগুলোকে একটি ঘরে শুকাতে দেওয়া হয় দুই-তিন দিনের জন্য। ভেজা মাটি শুকিয়ে সাদা হলে সেগুলোকে রোদে দেওয়া হয়। আরও শুকানোর পর খড় দিয়ে বানানো চুল্লিতে তাক তাক করে সাজানো হয় সব পণ্য। এই চুল্লিকে স্থানীয় ভাষায় বলে 'পন'। আগে গ্যাসের চুল্লি ব্যবহার করলেও এখন গ্যাসের অভাবে সনাতনী পদ্ধতির খড়ের চুল্লি ব্যবহার করা হয়।
চুল্লিতে আগুন জ্বালিয়ে মাটির পণ্য পোড়ানো হয় দুই দিন ধরে। দুই দিন পরে পরিণত হয়ে যেসব পণ্য বের হয়— সেগুলোকেই আমরা মৃৎশিল্প হিসেবে চিনি। সুন্দর ও নান্দনিক কারুকাজ করা হয় যেসব পণ্যে— সেগুলো কয়েক ধাপে বানানো এবং রং করা হয়। মৃৎশিল্পীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা সূক্ষ্মভাবে সুঁচ দিয়ে আলপনা একে ফেলেন মাটির পাত্রে।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিতে তৈরি করা হয় অনেক ধরনের জিনিসপত্র। এরমধ্যে প্রধান হলো— মাটির হাঁড়ি, টব, ব্যাংক, সানকি, দইয়ের হাঁড়ি, গ্লাস, মগ, প্লেট, ফুলদানি, ছাইদানি, টেরাকোটা, টাইলস, প্রদীপ, বিখ্যাত ব্যাক্তিদের অবয়ব, নানান রকমের খেলনা, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত শো-পিস ইত্যাদি। পণ্যের আকার, ডিজাইন ও চাহিদাভেদে এগুলো পণ্যের দাম ১০০ টাকা থেকে শুরু করে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এখানে কেউ চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়ে বিভিন্ন মাটির জিনিস বানিয়ে নিতে পারেন। বিপ্লব চন্দ্র পাল বলেন, "কাস্টমাইজ অর্ডারে আমাদের সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে ফুলের টব আর টেরাকোটা বা টাইলসের। কাস্টমাররা তাদের পছন্দ মতো ডিজাইন আমাদেরকে দিলে আমাদের শিল্পীরা সে অনুযায়ী অবিকলভাবে তা বানিয়ে দিতে পারেন। অনেক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে নানান রকম পোট্রেট বানানোর অর্ডারও আসে আমাদের কাছে। দেশের বাইরে থেকে অর্ডার একটু কম আসে এখন। একটা সময়ে আমরা ইউরোপ ও আমেরিকায় নিয়মিত পণ্য রপ্তানি করতাম।"
দেশের বাইরে থেকেও এমন নান্দনিক মাটির পণ্যের অর্ডার আসে। ঘর সাজাতে মাটির জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। ঘরের ভেতর বাঙালিয়ানার ছোঁয়া আনতে শহরের ঘরে ঘরে নানান মৃৎশিল্পের সামগ্রী দেখা যায় অহরহ।
"আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি অর্ডার আছে দইয়ের পাত্রের। আগের মতো শোপিস এত বেশি বিক্রি হয় না নানান কারণে। কিন্তু দইয়ের পাত্রের অর্ডার দেশের বাইরে থেকেও পাই। এই যে এখন আমাদের শিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করছে দইয়ের পাত্র বানাতেই। মালয়েশিয়া থেকে ৫০ হাজার পিস দইয়ের পাত্রের অর্ডার এসেছে আমাদের কাছে। আর সারাদেশে নিয়মিতই দইয়ের পাত্র সাপ্লাই করি আমরা," জানান বিপ্লব চন্দ্র পাল।
গ্যাসের জন্য হাহাকার
মাটি দিয়ে বানানো যেকোনো পণ্য টেকসই হতে হলে সেটিকে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোড়ানো জরুরি। বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির কারখানায় এখন পর্যন্ত তিনটি আধুনিক গ্যাসের চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে এ কাজের জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে তিনটি গ্যাসের চুল্লিই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। কারণ, তাদের কারখানায় গ্যাসের সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে যে গ্যাসের লাইন দেওয়া হয়েছিল, আর বিভিন্ন সময়ে কেনা গ্যাসের চুল্লি ব্যবহার করে বেশ ভালোই চলছিল মৃৎশিল্পের কাজ। কিন্তু সেই গ্যাসের লাইনে আবাসিক লাইন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও যোগ হয়েছে অবৈধ সংযোগ। ফলে সবমিলিয়ে গ্যাসের চাপ কমতে শুরু করে ২০১৫ সাল থেকে। ২০১৭ সালের দিকে গ্যাসের চাপ একদম শেষ হয়ে যায়। তারপর থেকে গ্যাস ছাড়াই কাজ চলছে বিজয়পুরে।
বর্তমানে সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করে মাটির জিনিস বানানো হয়। খড় দিয়ে চুল্লি বানিয়ে দুইদিন ধরে আগুনে জ্বালানো হয় সে চুল্লি। এতে করে ভালো পণ্য বের হয় কম। কারণ খড়ের চুল্লিতে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে— যা আবার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তাই দেখা যায়, খড়ের চুল্লি থেকে পণ্য বের করার পর প্রায় ৪০ ভাগই ভেঙ্গে বা নষ্ট হয়ে যায়। আর ভালো পণ্য থাকে ৬০ ভাগ। সেই ৬০ ভাগ পণ্যে আবার রঙ বসাতে সময় লাগে বেশি। এর ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি।
"গ্যাসের চুল্লিতে বানানো জিনিসগুলো টেকসই হতো। রঙ ও ভালো হতো সেগুলাতে। কিন্তু এখন আমরা খড়ের চুল্লিতে যেই পণ্য বানাই, সেগুলো আগের মতো ভালো হয় না। গ্যাসের চুল্লি থেকে খড়ের চুল্লিতে খরচ অনেক বেশি হয়। দিন দিন সকল ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আমাদের এই কারখানা চালানোর খরচও দিনদিন বাড়ছে। আগে এক ট্রাক মাটি কিনতাম ৩০০ টাকা দিয়ে। এখন সেটি কেনা লাগে ২,৫০০ টাকায়," বলেন বিপ্লব।
আরও জানান, "সবদিক দিয়ে আমাদের খরচ বাড়লেও আমরা মাটির জিনিসের দাম তেমন বাড়াতে পারিনি। সবকিছুর দাম প্রায় আগের মতোই আছে। যার ফলে আমরা লসে চলছি এখন। শ্রমিকদেরকেও ভালো বেতন দিতে পারি না। ন্যূনতম মজুরির চেয়েও কমে তারা কাজ করছে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য।"
গ্যাসের লাইন ফিরিয়ে আনার জন্য ২০১৭ সাল থেকেই সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত পাঠানো হয়েছে সমিতির পক্ষ থেকে। বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড ও সমবায় অধিদপ্তরে বারবার গ্যাসের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা
"প্রত্যেকদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি এখানে। মাস শেষে বেতন পাই মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। স্বামী বেঁচে নেই। দুই বাচ্চা নিয়ে চলা খুব কঠিন। বাপ-দাদারে দেখতাম এই কাজ করতো, তাই আমিও করি। গার্মেন্টসে গেলে শুনসি ১৫ হাজার টাকার উপরে বেতন দেয়। বাজারের যা অবস্থা, এমনে বেশিদিন কাজ করতে পারবো বলে মনে হয় না," বলছিলেন মৃৎশিল্পী কাজল রানী দাস।
মৃৎশিল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী হলো প্লাস্টিকের পণ্য। মাটির তৈরি জিনিস থেকে প্লাস্টিকের জিনিস বেশি টেকসই হয়। দামও কম। কিন্তু প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মাটির তৈরি জিনিস পরিবেশের ক্ষতি করে না।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির ভবিষ্যৎ কী— জানতে চাইলে ম্লান হেসে ম্যানেজার সাহেব বললেন, "দেখেন, আমাদের ভবিষ্যৎ পুরাটাই প্রশাসনের হাতে। তারা যতদিন আমাদেরকে গ্যাস না দেবে, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। খড়ের চুল্লি দিয়ে এভাবে কয়দিন কাজ চালিয়ে নিতে পারবো জানি না। অনেক দিক দিয়ে আমরা লসের মুখে আছি। বলতে পারেন এখন আমরা শুধু দই এর পাতিল বিক্রি করে বেঁচে আছি। বাকি সব পণ্য কম বিক্রি হয়।"
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিতে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে, সেখানে দেশের নানান প্রান্ত থেকে শিল্পীরা এসে প্রশিক্ষণ নিতেন। কিন্তু এখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খালি পড়ে আছে। ২০১৫ সালে শেষবারের মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এখানে।
দেশের লোকশিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আমাদের লোকশিল্পের স্বরূপ জানেন না। বিজয়পুর ছাড়াও দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় মৃৎশিল্পের কাজ করা হয়। তারাও আজ ধুঁকছেন। প্রশাসনের সুনজর পড়লেই বেঁচে যেতে পারে মৃৎশিল্পসহ আরও নানান লোকশিল্প।