কালো স্যুটের রহস্যমানব ইয়াবুচি, তার ব্যবসা নির্যাতিত নারীদের ‘গায়েব’ করা
জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট শহর চিবা। এই শহরেই সাদামাটা এক অফিস নাওকি ইওয়াবুচির। গাঢ় কালো রঙের স্যুট পরিহিত ইয়াবুচি কথা বলেনও মেপে মেপে, মৃদু স্বরে। আসলে তার ব্যবসার ধরনটাই এমন, জাপানে যাকে বলা হয় 'ইয়োনিগেয়া'।
ইংরেজিতে 'ইয়োনিগেয়া'র অর্থ হয় 'নাইট মুভিং' বা রাতের আঁধারে (অর্থাৎ, সবার অলক্ষ্যে) সরিয়ে ফেলা। ব্যবসার নাম শুনেই যদি খটকা লাগে, তাহলে এর কার্যক্রম শুনে চমকে উঠবেন অনেকে। মানুষজনকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করাটাই ইওয়াবুচির রুজিরোগারের উৎস।
জাপানে অবশ্য নতুন নয় বিষয়টা। তথ্যপরিসংখ্যান ওয়েবসাইট স্ট্যাটিসটার তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে দেশটির ৮০ হাজার মানুষের 'হারিয়ে যাওয়ার' ঘটনা ঘটেছে।
এই হারিয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে রয়েছেন 'জোহাৎস্যু'রা, অর্থাৎ পরিচয় বদলে রাতারাতি যারা চলে গেছেন পরিচিতজনদের অন্তরালে। এদের অধিকাংশই দেনা, পারিবারিক সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতে গা ঢাকা দিয়েছেন। নতুন পরিচয়ে নবজীবন শুরু করেছেন অন্য কোথাও।
গোপনীয় এই দিকটিই উঠে এসেছে সম্প্রতি হংকং-ভিত্তিক গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক ডকুমেন্টারিতে।
গত ১৯ মার্চ ডকুমেন্টারিটি প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমটি। এতে দেখা যায়, ইওয়াবুচির মতো আরো অনেকেই এ ব্যবসা করছেন। তারা বিশেষত, শারীরিক বা মানসিকভাবে নিপীড়ন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির অনুসরণের শিকার নারীদের সমাজ থেকে আত্মগোপন করে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার বিষয়ে সহায়তা দিচ্ছেন।
ইওয়াবুচি জানান, কালো পোশাক তার গোপন সেবারই চিহ্ন বহন করে। তবে এই কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। তাই আত্মরক্ষার খাতিতে সবসময় একটি ব্রিফকেস সঙ্গে রাখেন, যার ভেতর দেওয়া আছে পুরু বর্মের স্তর। ভ্রমণের সময় সাথে থাকে ব্যাটনের মতো একটি ডিভাইস, সুইচ টিপলেই যেটি প্রসারিত হয়।
তিনি বলেন, "সবার অলক্ষ্যে কাউকে সরিয়ে ফেলাটা খুবই দুরুহ কাজ, সবসময় কোনো না কোনো বিপত্তি থাকেই। সমস্যা ছাড়া একদিনও কেটেছে বলে তো মনে পড়ে না।" কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটাই বাস্তব হবে এমন আঁচ করেই প্রস্তুতি রাখেন তিনি।
এই ব্যবসায় কীভাবে এলেন সে সম্পর্কে তিনি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে জানান, "আজ থেকে বছর ১৬ আগে এই ব্যবসা শুরু করি। আমি দেখেছিলাম, বহু নারী পারিবারিক হেনস্তার শিকার হন, কিন্তু তাদের পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। তখন তাদের 'হারিয়ে যেতে' সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেই।"
ইয়াবুচির ৯০ শতাংশ গ্রাহকই হলেন নারী, মাত্র ১০ শতাংশ হলেন পুরুষ। করোনা মহামারির আগের সময়ের চেয়ে বর্তমানে পরিচিতদের গণ্ডি থেকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছুক এমন মানুষের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
২০০৩ সালে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য লস এঞ্জেলস টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ইয়োনিগেয়া' সেবা নিতে ২,০০০ থেকে ২০,০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হতে পারে। ফি'র পরিমাণ নির্ধারিত হয় ওই ব্যক্তিকে সরিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন জটিলতা ও ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে। তাছাড়া, পালিয়ে যেতে সাহায্যকারীদের অনেকসময় ছদ্মবেশ নিতে হয়।
২০২০ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, একবার 'হারিয়ে যাওয়ার' পর এসব ব্যক্তির জন্য পরিচয় গোপন রাখা বেশ সহজ হয়ে যায়।
সমাজবিজ্ঞানী হিরোকি নাকামোরি বিবিসিকে বলেন, জাপানে গোপনীয়তা রক্ষা করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে এসবয নিখোঁজ ব্যক্তিরা সনাক্ত হওয়া ছাড়াই এটিএম বুথ থেকে টাকাও তুলতে পারে।
নাকামোরি বিবিসিকে বলেন, "যদি না তাদের সাথে অন্য কোনো ঘটনা যেমন অপরাধ বা দুর্ঘটনার সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে পুলিশ কখনোই হস্তক্ষেপ করবে না।"
তিনি আরো বলেন, হারিয়ে যাওয়া এসব ব্যক্তিদের পরিবার আসলে যা করতে পারে তা হলো, অনেক বেশি অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভাড়া করা। কিংবা তাদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা।"