টিকেট কিনেও টাইটানিকে উঠতে না পেরে প্রাণে বেঁচে যান যেসব বিখ্যাত ব্যক্তি
১৯১২ সালে ডুবে যাওয়া জাহাজ টাইটানিক নিয়ে আজও মানুষের মনে আগ্রহের কমতি নেই। এ জাহাজ নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র বই, তৈরি হয়েছে সুপারহিট সিনেমা, গড়ে উঠেছে জাদুঘর, উঠেছে বিতর্কের ঝড়।
এ জাহাজের প্রতি কৌতূহলের জন্য এ মাসের মারা গেছেন পাঁচজন পর্যটক। সাবমেরিনে করে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হন তারা। এরপরই জানা গেছে, সাবমেরিনটির নির্মাতা কোম্পানি ওশানগেটের আমন্ত্রণ পেয়েও এ সফরে শামিল হননি বেশ কয়েকজন মানুষ।
টাইটানিকেও কিন্তু বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। টিকেট কিনেও সফরে শামিল না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান তারা। চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের পরিচয়।
জে. পি. মরগান
বিখ্যাত ব্যাংকার জে. পি. মরগানের ব্যক্তিগত স্যুইট ছিল টাইটানিকে। ১৯১১ সালে জাহাজটির উদ্বোধনী পার্টিতেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
তবে টাইটানিকের যাত্রা শুরু হওয়ার সময় জে. পি. মরগান ফ্রান্সে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ছুটি বাড়ানোর কারণে তিনি এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান।
ধারণা করা হয়, ভগ্নস্বাস্থ্য অথবা কাস্টমসে নিজের আর্টের সংগ্রহ নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কারণে টাইটানিকে সফর বাতিল করেন এই ব্যাংকার।
জেনারেল ইলেকট্রিক, ইন্টারন্যাশনাল হার্ভেস্টার ও ইউএস স্টিলের সহপ্রতিষ্ঠাতা জে. পি. মরগান ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিনেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এছাড়া তিনি টাইটানিকের পরিচালন কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইনের মালিকও হন পরে।
পরবর্তীতে টাইটানিকের ডুবে যাওয়া নিয়ে মরগান নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদককে বলেন, 'জীবনের ক্ষতির কাছে আর্থিক লোকসান কিছুই না। প্রাণহানিই গুরুত্বপূর্ণ।'
মিল্টন হার্শে
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চকলেট উৎপাদনকারী ও বহুজাতিক কোম্পানি হার্শে'স-এর প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন হার্শে। তিনিও টাইটানিকের টিকেট রিজার্ভ করার জন্য জাহাজটির পরিচালন কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইনে ৩০০ ডলারের চেক পাঠান। কিন্তু পরে এসএস আমেরিকায় উঠে দেশে ফেরেন তিনি।
হার্শে ও তার স্ত্রী ক্যাথেরিন বয়স বাড়ার পর শীতকালটা কাটাতেন ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায়। ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে এই দম্পতি ইউরোপে আরও কিছুদিন ছুটি কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। হার্শে তখন হার্শে ট্রাস্ট কোম্পানি থেকে ৩০০ ডলারের একটি চেক লিখে হোয়াইট স্টার লাইনকে বলেন, তাদের নতুন জাহাজ টাইটানিকে টিকেট রিজার্ভ করতে।
তবে ব্যবসায়িক কাজে হার্শে ছুটি সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হন। টাইটানিকের প্রথম যাত্রা শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি ইউরোপ ছাড়েন। আমেরিকা নামে একটি জার্মান লাইনারে চেপে দেশে ফেরেন তিনি।
হার্শের বাতিল করা চেকটি এখনও হার্শে কমিউনিটি আর্কাইভসে সংরক্ষিত আছে। চাইলে অনলাইনেই সেটির ছবি দেখে নিতে পারেন।
জি মার্কনি
রেডিওর আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃত জি (গুগলিয়েলমো) মার্কনিরও একটি ফ্রি টিকেট পাওয়ার সুবাদে টাইটানিকে ওঠার কথা ছিল।
টাইটানিকডুবির পরই মার্কনি তার ওয়্যারলেস রেডিও আবিষ্কারের বদৌলতে নায়ক বনে যান। এই আবিষ্কারের কারণে তিনি নোবেল পুরস্কারও পান। এ রেডিওর সাহায্যে পথহারানো জাহাজ আশপাশের এলাকায় লাইফবোট খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়।
১৯২৬ সালে মার্কনির মেয়ে ডেগনা তার 'মাই ফাদার, মার্কনি' বইয়ে লেখেন, টাইটানিকে তাকে একটি ফ্রি টিকেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মার্কনির স্টেনোগ্রাফার সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি লুসিটানিয়া নামক জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ মার্কনি লুসিটানিয়ার স্টেনোগ্রাফারকে টাইটানিকের স্টেনোগ্রাফারের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন।
হেনরি ক্লে ফ্রিক
ইতালিতে স্ত্রীর গোড়ালি মচকে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সে কারণে টাইটানিকের যাত্রায় শামিল হতে পারেননি কার্নেগি স্টিল কোম্পানির চেয়ারম্যান হেনরি ক্লে ফ্রিক।
ফ্রিক ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপতি ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। ফ্রিক টাইটানিকের স্যুইট বুক করেছিলেন। কিন্তু ইউরোপে ঘুরতে গিয়ে ইতালিতে গোড়ালি মচকে যায় মিসেস ফ্রিকের। এ কারণে তাদের সফর বাতিল হয়ে যায়।
আর ফ্রিকের বাতিল করা টিকেট পান হোয়াইট স্টার লাইনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জে. ব্রুস ইজমে। জাহাজডুবির পর অল্প যে কজন মানুষ লাফিবোট পেয়ে প্রাণে বেঁচে যান, তাদের দলে ছিলেন ইজমেও। তবে বাকি জীবন সমালোচনার ঘা সহ্য করে বাঁচতে হয়েছে তাকে।
জন মট
এই নোবেল পুরস্কার বিজয়ীকেও টাইটানিকে ফ্রি টিকেট দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি তুলনামূলক ছোট জাহাজ ল্যাপল্যান্ডে চেপে সফর করেন।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী জন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে তিনি দু-দুবার এরকম দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান।
প্রথমে টাইটানিকের বদলে ল্যাপল্যান্ডে উঠে প্রাণে বাঁচেন। এর তিন দশক পর, ১৯৪৩ সালে তিনি একটি ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।
আরও যেসব বিখ্যাত মানুষের ওঠার কথা ছিল টাইটানিকে
ভবিষ্যতে টাইটানিক ওঠার জন্য আরও অনেক তারকা টিকেট কিনেছিলেন। কিন্তু তার আগেই জাহাজটি ডুবে যায়।
মার্কিন ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইন জেসিপেনি-র জে. সি. পেনি ইংল্যান্ড থেকে নিউইয়র্কে টাইটানিকের দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য টিকেট কেটেছিলেন।
এছাড়া আমেরিকান টায়ার উৎপাদনকারী কোম্পানি গুডইয়ার টায়ারস-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক সিবারলিংও ইংল্যান্ডের সাউথহ্যাম্পটন থেকে টাইটানিকের দ্বিতীয় যাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য টিকেট বুক করেছিলেন। সিবারলিং ও তার স্ত্রী প্রায়ই ইংল্যান্ডে ভ্রমণ করতে যেতেন। তবে টাইটানিক ডুবে যাওয়ায় তাদের এরকম একটি সফর বাতিল হয়ে যায়।
টাইটানিকের দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় শামিল হওয়ার কথা ছিল সাবেক দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস ও জন কুইন্সি অ্যাডামসের বংশধর, ইতিহাসবিদ হেনরি অ্যাডামসেরও। তবে জাহাজটি ডুবে যাওয়ায় তার সফরও বাতিল হয়ে যায়।