অতিরিক্ত 'স্ক্রিন টাইম' শিশুদের দেরিতে বিকাশের ঝুঁকি বাড়ায়: গবেষণা
নিজেদের ব্যস্ততার সময় অনেক বাবা-মা শিশুদের ভুলিয়ে রাখতে বা তাদেরকে যেন বিরক্ত না করে সেজন্য মোবাইল ফোন দিয়ে রাখেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা কোনো সমস্যা মনে না হলেও, নতুন একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে এটি শিশুদের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে।
সোমবার জামা (JAMA) পেডিয়াট্রিকস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এক বছর বয়সী শিশুদের দৈনিক ১ থেকে ৩ ঘণ্টার 'স্ক্রিন টাইম' থাকলে, দুই বছর বয়সে পা রাখতে রাখতে ফাইন মোটর স্কিল (শিশুদের হাত-কবজির ছোট ছোট পেশীর নড়াচড়ার মাধ্যমে কাজ), যোগাযোগ, সমস্যা-সমাধান, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে তাদের বিকাশ দেরিতে হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ৭০৯৭ জন শিশুর ওপর এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জেসন নাগাতা বলেন, "এই গবেষণাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে বড় পরিসরে নমুনা নেওয়া হয়েছে এবং এই শিশুদের কয়েক বছর ধরে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।" তবে নাগাতা নিজে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, "এ গবেষণার মাধ্যমে একটা শূন্যস্থান পূরণ হবে কারণ এখানে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশ দেরিতে হওয়ার কথা বলা হয়েছে (দক্ষতার ক্ষেত্রে); যেমন- স্ক্রিন টাইমের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমস্যা-সমাধান দক্ষতার যোগসূত্র রয়েছে দেখানো হয়েছে।" এছাড়াও, তিনি জানান যে কয়েক বছরের ফলো-আপ ডেটাসহ এ ধরনের গবেষণা খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
এই শিশুরা ও তাদের মায়েরা জাপান-ভিত্তিক টোহকু মেডিকেল মেগাব্যাংক প্রজেক্ট বার্থ এবং থ্রি-জেনারেশন কোহর্ট স্টাডির অংশ ছিলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মিয়াগি ও ইওয়াতে প্রিফেকচারের ৫০টি প্রসূতি ক্লিনিক ও হাসপাতাল থেকে তাদেরকে বাছাই করা হয়।
এক বছর বয়সে শিশুরা দৈনিক কত ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ২ ও ৪ বছর বয়সে ফাইন মোটর স্কিল, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ এবং সমস্যা-সমাধানের ক্ষেত্রে এই শিশুরা কতখানি বিকাশ লাভ করেছে তা পরিমাপ করা হয়েছে। মায়েদের পাঠানো রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এ পরিমাপ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু দৈনিক ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, যোগাযোগ ও সমস্যা-সমাধানে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তাদের দেরি হওয়ার ঝুকি তিন গুণ বেশি।
অন্যদিকে, যারা স্ক্রিনে চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাটিয়েছে তাদের যোগাযোগের দক্ষতা কম থাকার সম্ভাবনা ৪.৭৮ গুণ বেশি, খুবই সাধারণ মানের ফাইন মোটর স্কিল থাকার সম্ভাবনা ১.৭৪ গুণ বেশি এবং দুই বছর বয়সের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা কম থাকার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেশি।
তবে চার বছর বয়সে পা রাখতে রাখতে দেখা গেছে, শুধুমাত্র যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা রয়ে গেছে।
সিনসিনাতি চিলড্রেন'স মেডিকেল সেন্টার-এর জেনারেল অ্যান্ড কমিউনিটি পেডিয়াট্রিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ডা. জন হাটন বলেন, "গবেষণাতে স্ক্রিন টাইমের বিষয়ে একটি দিকে তুলনামূলক কম নজর দেওয়া হয়েছে, আর তা হলো স্ক্রিন এক্সপোজারের ফলে অল্পবয়সী শিশুদের ওপর কি কি প্রভাব পড়ছে, বিশেষ করে একেবারেই ছোট বাচ্চাদের হাতে যখন কোনো ডিভাইস তুলে দেওয়া হচ্ছে। সারা বিশ্বজুড়েই এটা একটা চিন্তার বিষয় এবং আমি মনে করি, এ গবেষণায় যেসব ফলাফল উঠে এসেছে তা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।"
স্ক্রিন টাইম যেভাবে শিশুদের বিকাশকে প্রভাবিত করে
ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে অতিরিক্ত তাকিয়ে থাকলে শিশুদের যোগাযোগ দক্ষতায় সম্ভাব্য যে ক্ষতি হতে পারে তা হলো ভাষাগত বিকাশ দেরিতে হওয়া। ডা. জন হাটন বলেন, "শিশুরা কথা বলতে শেখে যখন তাদেরকে কথা বলতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু শুধু যদি স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকে তাহলে কথা বলার চর্চা কমে যায়।তখন হয়তো তারা অনেক কথা শুনবে, কিন্তু নিজেরা বলার চর্চা করবে না বা সক্রিয়ভাবে মিথস্ক্রিয়া করবে না।"
আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের সময় ছিনিয়ে নেয় প্রযুক্তি, অথচ এই যোগাযোগই শিশুর সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে; যেহেতু স্ক্রিনে থাকা চরিত্রগুলোর চেয়ে বাস্তবে মানুষ অনেক বেশি মাল্টিডাইমেনশনাল, বলেন হাটন। মানুষের চেহারার দিকে তাকালেই আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করে যে তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলবো।
এদিকে নাগাতা বলেন, "নিষ্ক্রিয়ভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকাতে মিথস্ক্রিয়ামূলক বা শারীরিক নড়াচড়ার কিছু নেই। ফলে বাচ্চারাও এক জায়গায় নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে এবং হাত-পা নড়াচড়া করে কিছু করার চর্চাও হয় না।"
শিশুরা যদি যথেষ্ট খেলাধুলার সময় না পায় অথবা নেতিবাচক আবেগকে প্রশমিত করতে তাদেরকে ট্যাব বা ফোন হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের অস্বস্তি বা অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার দক্ষতাও তৈরি হবে না।
"দীর্ঘমেয়াদে শিশুদের জন্য একটা মূল লক্ষ্য হলো নিজস্ব চিন্তার মধ্যে থেকে কাজ করা। যখন তাদের একটু একঘেয়েমি লাগে তখন তারা নিজেরাই এটা দূর করতে কিছু না কিছু করতে চায়, এভাবেই সৃজনশীলতার জন্ম হয়", বলেন হাটন।
নাগাতা বলেন, "আরও অনেক কারণ রয়েছে যা শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে; যেমন- জেনেটিকস, অবহেলা বা খারাপ আচরণের সম্মুখীন হওয়ার মতো প্রতিকূল অবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক কারণ।"
সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুদের স্ক্রিন টাইম বেশি, তাদের অনেকের মায়েরই বয়সও কম, কেউ কেউ আগে কখনো মা হননি, তাদের আয় ও শিক্ষার মান নিচে এবং পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
তবে এ গবেষণারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে: কোনো কোনো মা হয়তো 'সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য' বোঝাতে কিংবা 'সঠিক' হিসেবে প্রমাণ করতে তাদের বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম কমিয়ে বা বাড়িয়ে লিখতে পারেন রিপোর্টে।
সেইসঙ্গে, গবেষকরাও বিস্তারিত জানানটি যে স্ক্রিন টাইমটা কি ব্যবহারে হচ্ছে বা সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে শিশুদের ক্ষতি বা উপকার হচ্ছে কিনা।
জন হাটন বলেন, "আরেকটা প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- অভিভাবক কি শিশুর দিকে নজর রাখছেন? যখন তারা নজর রাখেন, তখন সমস্যাগুলো কমে আসার কথা।"
ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় যেভাবে শিশুকে ব্যস্ত রাখবেন
আপনি যদি সত্যিই চান শিশুকে কোনোভাবে ব্যস্ত রাখতে যাতে আপনি চটজলদি হাতের কাজটা সেরে ফেলতে পারেন বা কিছুক্ষণ আরাম করতে পারেন, তাহলে তাদেরকে বই, রঙপেন্সিল, খেলনা ইত্যাদি দিন। এ কাজগুলোর মাধ্যমে তারা নিরাপদেই সময় কাটাতে পারবে।
মাঝেমধ্যে যদি স্ক্রিন টাইমের ওপর নির্ভর করতেই হয়, তাহলে শিক্ষামূলক কন্টেন্ট দেখতে দিন বা প্রিয়জনের সঙ্গে ভিডিও চ্যাটে যুক্ত করুন যাতে তারা কিছুটা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পায়, বলেন নাগাতা। এক্ষেত্রে নাগাতা ও হাটন দুজনেই একটু লম্বা সময়েই ভিডিও দেখতে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে শিশুরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে এবং যা দেখছে তা তাদের বোধগম্য হয়।
এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাবা-মায়েরও নিজেদের বেশিক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না, যেহেতু শিশুরা অনুকরণ করতে পছন্দ করে।
হাটন বলেন, "আমাদের ধীরে ধীরে যেতে হবে... আর সাবধানে থাকতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে শিশুদেরকে বাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে। ভবিষ্যতে তারা অনেক স্ক্রিন টাইম পাবে, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে আগে বুঝতে হবে তারা কেমন ও তাদের চাহিদা কি।