মুক্তিযুদ্ধ, একটি ফিলিপস রেডিও আর বিবিসি নামে বদলে যাওয়া এক বাজার
১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ চলছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর জানতে উদগ্রীব সবাই। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের মুক্তিকামী মানুষও ব্যাকুল যুদ্ধের খবর জানতে। গ্রামের আবুল কাসেম মোল্লার চায়ের স্টলে ছিল থ্রি ব্র্যান্ডের ফিলিপস কোম্পানির একটি রেডিও। সেই রেডিওতেই সকালে ও সন্ধ্যার পর বিবিসি বাংলার খবর শোনার জন্য ভিড় করত সবাই। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর কয়েক গ্রামের মানুষ জড়ো হতো রেডিওতে বিবিসি বাংলার খবর শোনার জন্য। সেই থেকে মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে খবর শোনাকে কেন্দ্র করে বাজারটির নাম হয়ে গেল বিবিসি বাজার।
একটি গণমাধ্যম জনমানুষের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাবনার রূপপুরের বিবিসি বাজার। একসময়ের পাড়াগাঁয়ের একটি চায়ের স্টল থেকে এখন সেই বাজারে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক দোকানপাট। প্রত্যন্ত একটা গ্রামের গত পঞ্চাশ বছরের উন্নয়নের বিবর্তন যেন এ গ্রাম।
রূপপুর মোড় থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে এগোলে বিবিসি বাজার। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে পাঁচ টাকা ভাড়া লাগে। সম্প্রতি এক বিকেলে যখন বিবিসি বাজারে পৌঁছা গেল, বাজার তখন সরগরম। বাজারের কড়ই গাছের নিচের চায়ের স্টলটিতেই জমে গেছে তুমুল আড্ডা।
এলাকাবাসী জানালেন, এই কড়ই গাছটি কাসেম মোল্লার নিজ হাতে লাগানো। গাছটির পাশেই ছিল তার চায়ের স্টল, যেখানে বাজানো হতো রেডিও। যুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে দেশের পরিস্থিতি জানতে রেডিওতে বিবিসি বাংলার খবর শুনতে লোকজন ভিড় জমাত কাসেম মোল্লার দোকানে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেসুর রহমান ও জুলফিকার আলী বলেন, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধা ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের। এই ইউনিয়ন থেকে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাই রয়েছেন ৩৫০ জন; যার বেশিরভাগ আবার রূপপুর গ্রামের। প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নিজের পরিবারের না থাকলেও আত্মীয়-স্বজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সেজন্যই এ এলাকার মানুষ দেশের পরিস্থিতি জানার জন্য তখন উদগ্রীব হয়ে থাকতেন।
তখন গ্রামে খুব বেশি রেডিও ছিল না। টিভি তো ছিলই না। কাসেম মোল্লার দোকানে চায়ের স্টলে রেডিও ছিল। সেই রেডিওতে সবাই খবর শুনতে আসত। আবার যখন পাকবাহিনী আসার খবর পেত, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিত আরও দক্ষিণে। পুরো এলাকা জলমগ্ন থাকায় রাতে পাক বাহিনী আসার সাহস পেত না। সেই কারণেও কাসেম মোল্লার দোকানে লোকজন জড়ো হয়ে খবর শোনার সাহস পেত।
চর রূপপুরের ৮৫ বছরর বৃদ্ধ আব্দুল হামিদ বলেন, 'যুদ্ধের ভয়াবহতার সময় সন্ধ্যা হলে আমরা সবাই এক হয়ে কাসেম মোল্লার দোকানে বিবিসি বাংলার খবর শুনতাম। সেই খবর বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।'
তখন সেখানে একটি চায়ের স্টল থাকলেও গত পঞ্চাশ বছরের এলাকাটির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একটি চায়ের স্টল থেকে সেখানে তৈরি হয়েছে দুই শতাধিক দোকানপাট। বাজারে মাছের বাজার, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই যা পাওয়া যায় না। গার্মেন্টস পণ্য থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, স্বর্ণের দোকানসহ প্রায় সবই পাওয়া যায় বিবিসি বাজারে।
রূপপুর বিবিসি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি জানান, একটি দোকান থেকে বিবিসি বাজারে এখন ১৭০টি স্থায়ী দোকান ও কিছুসংখ্যক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো হাটবার না থাকলেও প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় হাট বসে।
তবে যে কাসেম মোল্লার বদৌলতে বিবিসি বাজার নামকরণ, তিনি এখন আর বেঁচে নেই। ২০১৫ সালে মারা গেছেন। বাজারের পাশেই তার বাপ-দাদার বাস্তুভিটা। সেখানেই তার ছেলেমেয়ে ও ভাইয়েরা বসবাস করেন।
কাসেম মোল্লার বাড়িতে গেলে তার ছোট ছেলে পাকশী রেলওয়ে কলেজের অফিস সহকারী জায়দুল ইসলাম বাড়ির আলমারি থেকে তার বাবার ব্যবহৃত থ্রি-ব্র্যান্ডের রেডিওটি বের করে দেখান। রেডিও বেশ পরিপাটি করে রাখা।
তবে জায়দুল ইসলাম জানালেন, এক সারাইকারীকে রেডিওটি মেরামত করতে দিয়েছিলেন। তিনি মেরামত করতে পারেননি। উপরন্তু আরও নষ্ট করে ফেলেছেন। বাইরে থেকে সুন্দর দেখা গেলেও ভিতরের কলকবজা আর অবশিষ্ট নেই।
তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় রূপপুরে বাবার চায়ের স্টল থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রূপপুর থেকে দোকান সরিয়ে তিনি পাকশী রেলবাজারে চা ও মিষ্টির দোকান দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই দোকানটিও ভালো চলছিল।
বিবিসি বাজারের খবরটি জেনে ১৯৯২ সালে বিবিসির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গণমাধ্যমটির একটি টিম বাংলাদেশে এসে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি শ্রোতাদের সঙ্গে আলাপ করা। বিবিসি বাজারটি তারা পরিদর্শন করেন। ওই সফরে এসেছিলেন বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন প্রধান ভ্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান, ভাষ্যকার দীপঙ্কর ঘোষ এবং বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ সংবাদদাতা আতাউস সামাদ।
পাকশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিন্টু বলেন, 'স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমার বাবা মুনির উদ্দিন কোরবান পাকশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সময়ে বাজারটি দুইবার পুনর্গঠন করা হয়। তখন থেকেই খাতা-কলমে বিবিসি বাজার হিসেবেই বাজারটি উপজেলা প্রশাসনের আত্মীকরণ হয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বিবিসি বাজারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার জন্য প্রকল্প পাশ করেছি। খুব শিগগিরই তার কাজ শুরু হবে।'