একজন সাংবাদিক যেভাবে সুন্দরবনের জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছেন
২০১৫-১৬ সালে 'মাস্টার বাহিনী' সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় জলদস্যু দল ছিল। ঐ সময় সুন্দরবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তিশালী অভিযানের কারণে ছোট-বড় প্রায় সব দস্যুদল কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় 'ক্রসফায়ারে' প্রাণ হারানোর ভয়ে আত্মগোপনে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন মাস্টার বাহিনীর নেতা মোস্তফা শেখ। তার সাথে আবার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ ছিল সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের।
সেই পরিচয়ের সূত্রে মোস্তফা শেখ মোহসীনকে বলেন, তিনি আত্মসমর্পণ করতে চান। জেলেদের ওপর ডাকাতি বন্ধ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে সুন্দরবনের খবর সংগ্রহ করছিলেন। সেখানে জলদস্যুদের কারণে সাধারণ জেলেদের জীবন যে বিপন্ন হচ্ছিল সেটি তিনিও গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন।
ঐ সময়টাতে জলদস্যুরা জেলেদের প্রায়শই অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য চাঁদাবাজি করতো। একইসাথে তারা নিজেরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হাতে অথবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে নিহত হতো। এমন পরিস্থিতিতে তাদের দৌরাত্ম্য দূর করা সহজ ছিল না। কারণ প্রতিনিয়ত নতুন নেতা ও দস্যুদলের উত্থান হচ্ছিল।
এখানে একটি দুষ্ট চক্র কাজ করছে, এবিষয়ে উপলব্ধি করতে পেরে মহসীন নিজের সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরেও কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মূল চাওয়া ছিল- জলদস্যু জীবনধারার পরিবর্তন; যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
একইসাথে কার্যত অসহায় জেলেদের জীবন উন্নয়নের চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাই তখন থেকেই মোহসীন-উল হাকিম জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে এবং দস্যুজীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। কিন্তু প্রথম কয়েক বছর তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে থাকে।
২০১৫ সালের শেষের দিকে মোহসীন তার দুই সহকর্মীকে সাথে নিয়ে সুন্দরবনের গভীরে ঝালোইরখালে মাস্টার বাহিনীর আস্তানায় যান। পরিকল্পনা ছিল বনের সবচেয়ে বড় জলদস্যু দল যে আত্মসমর্পণ করতে চায় এমন খবর প্রকাশ করা।
কিন্তু ঝালোইরখালে জলদস্যু দলটির উপস্থিতির খবর কোস্ট গার্ডের কাছে পৌঁছে যায়। মহসীন ও তার সহকর্মীরা যখন আত্মসমর্পণের বিষয়ে দস্যুদের সাথে কথা বলছিলেন তখনই ১০-১২ জন কোস্টগার্ড সদস্য অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে।
ঐ সময়টায় সাংবাদিকদের জীবনসহ সবকিছুই যেন ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। জলদস্যুরাও পাল্টা-গুলি ছুড়তে থাকে। কোস্টগার্ড সদস্যরা একদিক থেকে গুলি ছুড়ছিল আর এদিকে জলদস্যু নেতা মোস্তফা তার শটগান থেকে পাল্টা গুলি করছিলেন।
এসময় জলদস্যুদের বড় গ্রুপটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট ছোট দলে পালায়। গোলাগুলি থেকে প্রাণ বাঁচাতে মোহসীন ও তার সহকর্মীরা মাটিতে শুয়ে ছিলেন। ঠিক কী ঘটছে বা এই শ্যুটআউট থেকে কে লাভবান হবে তা সাংবাদিকদের কাছে বোধগম্য ছিল না।
ঐ ঘটনার কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আত্মসমর্পণের আলোচনা চলতে থাকে। মোস্তফা ও তার দলবল ক্যামেরায় বলেন যে, তারা আত্মসমর্পণ করতে চান। তারা শান্তির ঘুম চান।
মহসীন দীর্ঘদিন ধরে জলদস্যুদের বিষয়ে খোঁজখবর নিলেও অতীতে তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। কিন্তু সংবাদ পরিবেশনের পর জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রশ্নে এই সাংবাদিককে সরকার গুরুত্ব-সহকারে নেয়।
ঐ সময়টাতে বহু শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা ঘটতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অংশ থেকে এমন উদ্যোগের জোরালো বিরোধিতা করা হয়। একইসাথে জলদস্যুদের মধ্যেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক পালা চলতে থাকে। অবশেষে ২০১৬ সালের মে মাসে মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
সরকার ও সুন্দরবনের জলদস্যুদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার মতো মোহসীন-উল হাকিমের জীবনে অভিজ্ঞতার এমন বেদনাদায়ক নানামুখী বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে তার বইয়ে। দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে প্রকাশিত 'সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ দস্যুদের রূপান্তরের গল্প' গত ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিশেষ করে লাখ লাখ ফলোয়ারসমৃদ্ধ সাংবাদিক মোহসীনের ফেসবুক পেইজ এক্ষেত্রে প্রোমোশনের ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
সিরিজের প্রথম এই বইটি ৪০০ পৃষ্ঠার। এতে যদিও প্রুফরিডিংয়ের কিছু ত্রুটি রয়েছে। একইসাথে অন্তত একটি জায়গায় উল্লেখযোগ্যভাবে বিশদ বিবরণকে আকস্মিকভাবে সংক্ষেপ করা হয়েছে।
বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে যে যথেষ্ট শ্রম দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও বইটি পড়ে বোঝা যায় না যে, পশ্চিম সুন্দরবনের মজনুসহ দুটি প্রধান জলদস্যু বাহিনী অবশেষে কীভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল।
লেখক হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে সামান্য বিশদ বিবরণও বাদ দিতে চাননি। কিন্তু বইটি বইমেলায় তাড়াহুড়া করে প্রকাশ করতে গিয়ে এমনটা হতে পারে। একইসাথে কিছু পাঠকের মনে হতে পারে, বইটিতে বিভিন্ন জায়গায় একই ধরনের কাহিনীর পুনরাবৃত্তি আছে। তবে এই সিদ্ধান্তটি একান্তই লেখকের; যেহেতু তিনি বাস্তব জীবনে কী ঘটেছিল তা বর্ণনা করেছেন।
সীমাবদ্ধতাগুলো বাদ দিলে বইটি পড়া একটি শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলারের মতো। এছাড়াও এটি বাস্তব জীবনের গল্পের সংকলন; যা সাংবাদিক মোহসীন প্রত্যক্ষ করেছেন, নিজে যুক্ত হয়েছেন ও সংবাদ কাভার করেছেন। একইসাথে জলদস্যুদের জীবন পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, তারা যেন আগের অবস্থায় ফিরে না যায়।
লেখক নিপুণভাবে একজন জলদস্যুর জীবনের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। তবে সেক্ষেত্রে অসহায় জেলেদের উপর তাদের পৈশাচিক অত্যাচারের বিষয়টি এড়িয়েও যাননি। খুলনা শহরের বড় সাহেব ও মাছ ব্যবসায়ীরা কীভাবে জলদস্যু ও জেলেদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তাদের পেয়াদা হিসাবে ব্যবহার করতেন ঐ গল্পও তিনি প্রকাশ্যে এনেছেন।
জলদস্যুরা জেলেদের কাছ থেকে যা চাঁদা আদায় করত তার একটি বড় অংশ পেত এই বড় সাহেবরা। একইসাথে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রির কাজটিও তারাই করতেন। তারা বিভিন্ন উপায়ে জেলেদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করত; যার মধ্যে উচ্চ সুদের দাদন অন্যতম। একইসাথে এই সাহেবরা নির্দিষ্ট শর্তে জেলেদের কষ্টার্জিত মাছ তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করতেন।
উদাহরণস্বরূপ, গুটগুটে বাবুর কথাই বলা যাক। একজন মহাজন তাকে ঋণের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর পর তিনি দস্যুদের জীবনে আসেন।
ঐ বইয়ে বাবুর একটি বক্তব্য আছে, তিনি বলেন, "এখানকার মহাজনরা জেলেদের পুঁজি তৈরি করতে দেয় না। চেক জালিয়াতির অভিযোগে আমি পলাতক হয়েছি। মহাজন একটা ব্ল্যাঙ্ক চেকে আমার সাইন নিল। আমি ২০ হাজার টাকা লোন নিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি চেকে ১০ লাখ টাকা লিখেছিলেন। সেই অভিযোগটি পরে আমার নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়। আমি আর ঘরে থাকতে পারলাম না। তারপর আমি জঙ্গলে পালিয়ে যাই এবং এই জলদস্যুদের দলে যোগ দিলাম।"
স্বাভাবিকভাবেই সকল জলদস্যুদের জীবনের গল্প এক নয়। কিন্তু দস্যুতার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার অভিপ্রায় তাদের সকলের মাঝেই দেখা গিয়েছিল। তারা সবাই একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়।
২০১৬ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর থেকে থেকে ৩২টি দলের ৩২৮ জন জলদস্যু ৪৭০টি অস্ত্র ও ২২ হাজার গুলিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রধানমন্ত্রী পরে জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দেন। তাদেরকে হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় সরকার।
'রূপান্তরের গল্প' হচ্ছে পর্দার পেছনের গল্পের একটি বই। যেখানে একজন সাংবাদিক কীভাবে সুন্দরবন ও সেখানকার জনগণকে কয়েক দশক ধরে আঁকড়ে ধরা জঘন্য ব্যাধিকে নির্মূল করে এই পার্থক্য তৈরি করেছেন সেটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বইটিতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয় কীভাবে মোহসীন জলদস্যুর দলকে বুঝিয়েছিলেন যে, জঙ্গলের বাইরেও তাদের একটা জীবন থাকতে পারে। যেখানে প্রতি রাতে তাদের অন্যকে শিকার করতে হবে না এবং নিজেরও শিকার হতে হবে না। তিনি বোঝাতে সক্ষম হন- সহিংসতা, হানাহানি পেছনে ফেলে নিরুদ্রুপে নিজ বাড়িতে শান্তির ঘুম তাঁদেরও হতে পারে।