যেভাবে ফিরিঙ্গিদের থেকে আজকের ফিরিঙ্গি বাজার
আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। কর্ণফুলী তখন প্রশস্ত এক নদী। উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত তীরে। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ নদীর দুকূলে তখন বড় বড় জাহাজ এসে নোঙর ফেলত। সে-সব জাহাজে চড়ে আসতেন ভিনদেশী সাহেবরা, আরও সহজ করে বললে ইউরোপীয় বণিকের দল।
এদের মধ্যে প্রথম কর্ণফুলীর বন্দরে পা রাখে পর্তুগিজরা। শুরুর দিকে জাহাজেই বাস করত তারা। পরে নদীর তীরে বসবাসের আস্তানাও গড়ে তোলে। অন্যদের উচ্ছেদ করেই এসব বসতবাড়ি তৈরি করে তারা। ব্যবসা-বাণিজ্য করার নিয়তে এলেও, কতটুকু তা করেছে সে বিষয়েও রেখে গেছে অস্পষ্টতা। বরং তাদের নামে অপহরণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো কাজের সিলমোহরই বেশি।
চট্টগ্রামের সে ফিরিঙ্গিদের আদ্যোপান্ত জানতে বেরিয়ে পড়লাম এক অপরাহ্নে। ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার বড় এক রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি। একটু সামনে এগোতেই কাঁচাবাজার মোড়। দেশি ফলের বড় বড় আড়ত আর কিছু সবজির দোকান চারপাশে। বেশ কয়েকটা মুদির দোকানেরও দেখা মিলল এখানে। শত বছরের পুরোনো এ বাজারের রূপ অনেকটাই পাল্টেছে।
লোকমুখে শুনতে পাওয়া যায়, দিনব্যাপী মানুষের আনাগোনা, দরাদরি, শোরগোলে মুখর ছিল এ বাজার। এখন অবশ্য বাজারের হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপারটা আর নেই। তাই বলে মানুষের ভিড় একেবারে নেই এমনটা বলা যাবে না। এখনো পুরোনো ক্রেতারা এসে কিনে নেন পছন্দের ফলমূল।
কাঁচাবাজার মোড় থেকে মিনিট দুয়েক সামনে এগোতেই ফিরিঙ্গি বাজার। বিখ্যাত এ বাজারের নাম নিয়ে আছে কত শত কাহিনি, কত ইতিহাস। দিনরাত হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা এ বাজার এখন প্রাণহীন। কোনো হট্টগোল নেই, নেই ক্রেতাও। বাজার বলতে যেমনটা বোঝানো হয় তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পুরো বাজার এলাকা ঘুরে কয়েকটা মুদির দোকান, সঙ্গে কিছু খাবারের হোটেলের দেখা মেলে কেবল।
বাজারের মোড় থেকে ডানদিকে খানিকটা হাঁটতেই সুরেলা কণ্ঠ কানে এসে লাগল। একটু স্পষ্ট হতেই বোঝা গেল বাকিটা। সামনেই অভয়মিত্র ঘাট। অলস বিকেলে গলা ছেড়ে গান ধরেছেন মাঝিরা।
পশ্চিম আকাশে ততক্ষণে সূর্য ঢলে পড়েছে। সোনালি আলো আরও সোনালি হয়ে মিশেছে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে। যেন নদী আর আকাশ মিশেছে এক রঙে। নৌকায় করে সে সৌন্দর্য উপভোগে মেতেছেন শত-শত মানুষ। নদীর এপার-ওপারজুড়ে সে এক ব্যস্ত দৃশ্যপট। ঘোরাফেরার জায়গা হিসেবে অভয়মিত্র ঘাট এখনো বেশ প্রসিদ্ধ নাম। সন্ধ্যা নামতেই এ ঘাটের চারপাশে জ্বলে উঠে লাল, নীল, হলুদ বাতি। আর সে-সব আলোর মিশে গিয়ে ঝিলমিলিয়ে ওঠে নদীর পানি।
ফিরিঙ্গি বাজার থেকে মেরিনার্স ড্রাইভ রোড ধরে এগোলেই ব্রীজঘাট। কর্ণফুলি নদীর অন্যতম ব্যস্ততম ঘাট এটি। অনেকের কাছে নদীর দক্ষিণকূল হিসেবেও পরিচিত। সকাল-সন্ধ্যা মানুষের আনাগোনা থাকে এখানে। দিন বা রাত—সাম্পান করে মানুষ আর মালামাল পারাপারে ব্যস্ত সময় কাটান মাঝিরা।
এ অভয়মিত্র ঘাট, ব্রীজঘাট, ফিশারিঘাট এবং কাঁচাবাজার নিয়েই পুরো ফিরিঙ্গি বাজার। একসময় ইউরোপীয় বণিকদের বড় বড় জাহাজ এসে নোঙর ফেলত অভয়মিত্র ঘাটে। এখনো ছোট ট্রলার, নৌকা, লঞ্চ এবং জাহাজের চলাচল চোখে পড়ে। নগরের কর্মব্যস্ত মানুষরা ছুটির দিনে প্রায়ই বেড়িয়ে যান এ এলাকা। ব্রীজঘাটের সাম্পান বা অভয়মিত্র ঘাটে নৌকায় করে কর্ণফুলীর বুকে নদী পারাপার তাই নিত্যকার চিত্র।
এ ফিরিঙ্গি বাজারে পর্তুগিজদের অপকর্মের গালগল্প জানতে কথা হলো এলাকার 'সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা' মকসুদ আহমেদের সঙ্গে। অনেকভাবে চেষ্টা করে তার সন্ধান মেলে। বয়স নিরানব্বইয়ের কোঠায়। মূল ফিরিঙ্গি বাজার থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটেই তার বাড়ি। বর্তমানে এলাকার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাকেই বিবেচনা করা হয়।
অমায়িক আর আন্তরিক ব্যবহার তার, এ কারণে আশেপাশের সবাই বেশ সমীহ করে চলেন তাকে। সৌম্য চেহারার এ বৃদ্ধের দেখা পেয়ে নির্ভার লাগল বেশ। মনে হলো, তিনিই কিছুটা হলেও পর্তুগিজদের নিয়ে জানাতে পারবেন।
ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা হলো তার সঙ্গে। 'আমি তখন খুব ছোট। বয়স বারো-কি-তের হবে। প্রায়ই চাঁদনী রাতে বাড়ির উঠোনে বসতাম সবাই। দাদা এসে মোড়া নিয়ে বসতেন আমাদের মাঝে। হুক্কা টেনে তিনি গল্প বলা শুরু করতেন। ওইভাবে গল্পের মাঝে প্রথম দাদার মুখে ফিরিঙ্গিদের নিয়ে জানি। তবে কেউই ভালো কিছু বলতেন না। সবাই শুধু তাদের নিয়ে ভয়ের কথাই বলতেন।'
শৈশবে বাবা-দাদাদের মুখে প্রায়ই ফিরিঙ্গিদের নিয়ে কিচ্ছা-কাহিনি মকসুদ। সেসব শুনে কখনো ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন, আবার কখনো ঘৃণায়-রাগে ফেটে পড়তেন। নিজে কিছু প্রত্যক্ষ না করলেও বড়দের কাছ থেকে শোনা গল্পই ফিরিঙ্গিদের চেনায় তাকে।
'দাদির মুখেও কত শুনেছি। আব্বাও বলতেন অনেক কিছু। তারা না-কি এখানের মানুষদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন করতেন। এও শুনেছি, তখন না-কি মায়েরা তাদের জেদি বাচ্চাদের পর্তুগিজের ভয় দেখিয়ে খাওয়াতেন, ঘুম পাড়াতেন। আমাদের কাছে তখন তাদেরকে দৈত্য মনে হতো। অবশ্য তাদের রেখে যাওয়া বংশধরদের অনেককে দেখেছি আমি। তারা আবার ভালো ছিলেন। সবার সঙ্গেই মিলেমিশে থাকতেন।'
গুরিবাজার থেকে ফিরিঙ্গি বাজার
সিটি কর্পোরেশন ছিল না তখন। পুরো চট্টগ্রাম শহর বিভক্ত ছিল ২২টি মহল্লায়। এ মহল্লাগুলোর ছিল সরদার কমিটি। সে কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারির পদ থাকত। মকসুদ আহমেদ ছিলেন সেই ২২ মহল্লার সরদার কমিটির সেক্রেটারি। তাই এলাকাজুড়ে তার বেশ নামডাক।
দেশভাগের আগে মকসুদের বাড়ির আশপাশ ছিল গাছগাছালিতে ভর্তি। বন-জঙ্গল বললেও ভুল হবে না। রাস্তা বলতে যা ছিল, তা কোনোরকম হাঁটা যায় এমন। জঙ্গল সাফ করে আইলের মতো করে বানানো। বিকেল হতেই মানুষের হাঁটাচলাও কমে যেত। রাত আটটার মধ্যেই মানুষের শোরগোলের শব্দও থেমে যেত।
মকসুদ আহমেদের বড় ছেলে ফরহান আহমদে বলেন, 'এ যে আমাদের বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন, এটা জঙ্গলের মতো ছিল। আমিও এমনটাই দেখেছি। এ ফিরিঙ্গি বাজার ছিল বিশাল বড়। সবসময় রমরমা। এখন তো সেভাবে আর কিছুই নেই। এখন বাজার প্রায় মৃত।'
তবে ষোলো শতকের দিকে পরিবেশ এমনটা ছিল না। ছিল না ফিরিঙ্গি বাজার বলেও কিছু। মকসুদ আহমদের কাছ থেকে জানা যায়, পর্তুগিজরা আসার আগে এ বাজার পরিচিত ছিল 'গুরিবাজার' নামে। পর্তুগিজরা আসার পরে প্রথমে ফিরিঙ্গি বন্দর বলে এটি পরিচিত ছিল। পর্তুগিজদের ভাষায় যা ছিল 'পোর্তো গ্রান্দে দ্য বেঙ্গলা'। পরে এটি পরিচিত হয়ে ওঠে ফিরিঙ্গি বাজার হিসেবে।
শত নিপীড়ন-নির্যাতন সত্ত্বেও এ বন্দর ছেড়ে যাওয়ার ৫০০ বছর পরেও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে এ নাম। কেনই বা থেকে গেল সেটি? মকসুদ আহমদ বলেন, 'আসলে কোনো একটা নাম হয়ে গেলে সেটা পরিবর্তন করা সেভাবে আর হয় না। কেউ না করলে যতই খারাপ নাম হোক, থেকে যায়। এখন আপনি কাউকে গুরিবাজার বললে চেনবে? কিন্তু ফিরিঙ্গি বাজার বলবেন, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে যে কেউ চেনবে।'
এ ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় পর্তুগিজদের নিয়ে জানতে চাইতেই বাসিন্দাদের চেহারার অভিব্যক্তি বলে দেয় অনেক কথা। কথাচ্ছলে ইতিবাচক কিছু শোনা যায় না তাদের কাছ থেকে। এমনকি বিরক্তির সুরে কেউ কেউ কথাও বলতে চাননি। আবার কেউ কেউ বলে বসেন, 'এল্লা জারগো মাইনশোর হতা কিল্লাই হওন ফরিবু?' (এমন বাজে লোকদের নিয়ে কেন কথা বলতে হবে?)
বলা বাহুল্য, তাদের এ বিরক্তি, রাগ বা ক্ষোভ নিতান্তই অকারণে নয়।
ফিরিঙ্গি এল দেশে
মূলত পর্তুগিজরা উপমহাদেশে প্রথম আসে ১৫০০ সালের দিকে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে একটি নৌবাণিজ্য পথ খুঁজে বের করা এবং মসলা বাণিজ্যে আধিপত্য স্থাপন করা। সে লক্ষ্যে তাদের আগমন ঘটে ভারতের গোয়ায়। পরে সেখান থেকে ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় তারা।
চট্টগ্রামে আসা এ পর্তুগিজদেরই ফিরিঙ্গি নামে ডাকা হতো। তবে বাংলা ভাষায় 'ফিরিঙ্গি' শব্দের তিনটি মূল অর্থ পাওয়া যায়—পর্তুগিজ ও ভারতীয় মিশ্রণজাত জাতি, ইউরোপীয় এবং বিদেশি খ্রিস্টান। ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগিজরাই একমাত্র এ নামে অভিহিত হতেন, কারণ তাদেরই প্রথম চট্টগ্রামে আগমন ঘটে।
তবে ফিরিঙ্গি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারও মতে, পর্তুগিজ শব্দ 'ফ্রান্সেস' থেকেই ফিরিঙ্গি শব্দের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি ফরাসি শব্দ থেকে উদ্ভূত। সাহিত্যিক এবং অভিধান প্রণেতা জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, ফরাসি 'franc' থেকে 'feringi', 'firingi', 'feringee' ও 'feringhee' শব্দের উৎপত্তি হয়। আবার অনেকের মতে, ফারসি শব্দ 'ফারাঙ' (সাদা মানুষ) থেকেই এ শব্দের উৎপত্তি।
জানা যায়, আরব ও পারসিকদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের ধর্মযুদ্ধের সময় ইউরোপের খ্রিস্টানগণ 'ফ্রাঙ্ক' নামে পরিচিত ছিলেন। সে সময় সবাই 'Lingua Franca' নামক একটি নতুন ভাষার সৃষ্টি করেছিলেন, যা ছিল ফ্রাঙ্ক ভাষা। পারসিক বা আরবগণ শব্দটিকে 'ফেরঙ্গ' উচ্চারণ করতেন, আর সেই 'ফেরঙ্গ' শব্দের অপভ্রংশই হলো ফিরিঙ্গি।
তবে অনেক লেখকের মতে, ফিরিঙ্গি বলতে শুধু পর্তুগিজদেরই বোঝানো হয়। যেমন আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরি' এবং ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের 'অন্নদামঙ্গল'-এও পর্তুগিজদেরই বোঝানো হয়।
অন্যদিকে বঙ্গদেশে এ শব্দের প্রচলন ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে হয়। সে সময় ব্রিটিশদেরও ফিরিঙ্গি বলে ডাকা হতো। মূলত 'ফিরিঙ্গি' শব্দটি সম্মানের অর্থে ব্যবহৃত হতো। চট্টগ্রামে আসা পর্তুগিজরা নিজেদের ফিরিঙ্গি বলে পরিচয় দিতেন। তারা চাইতেন তাদের সম্মান করে ফিরিঙ্গি বলা হোক। নামের শুরুটা এভাবেই।
তবে কতজন সম্মান করে এ শব্দটি উচ্চারণ করতেন, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। চট্টগ্রামের স্থানীয়রা এ নামের আভিধানিক অর্থ বুঝতে পারলেও এর প্রকৃত অর্থ অনুভব করা সম্ভব হয়তো কেবল তারাই করতে পারেন।
শুধু নাম নয়, গালিও!
পর্তুগিজদের কাছে ফিরিঙ্গির অর্থ ছিল 'সম্মানিত ব্যক্তি', কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এর অর্থ একেবারেই উল্টো। এখানে 'ফিরিঙ্গি' শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিদ্রুপ বা ঠাট্টা করার জন্য। এমনকি এ শব্দ আরও বেশি জনপ্রিয় গালি হিসেবে। শহরের অলি-গলির নিত্যকার গালিগালাজে এ শব্দের ব্যবহার শোনা যায়। কেউ কোনো বড় অন্যায় করলেই শুনতে হয়, 'তুই তো দেখি একটা আস্ত ফিরিঙ্গি!'
তবে এ শব্দের অর্থ বিদ্রুপ বা ঠাট্টার রূপ ধারণ করার পেছনে কারণও রয়েছে। পর্তুগিজরা তাদের সময়কালে যে অত্যাচার এবং গর্হিত কাজ করেছে, তার প্রতিফলন হিসেবে এ ব্যবহার গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের পাতায় তাদের অত্যাচারের বিবরণ এতটাই ভয়ঙ্করভাবে উঠে এসেছে যে, তা যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তিকেও অসুস্থ করে দিতে পারে।
তারা শুধু লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং নারী অপহরণ, ধর্ষণ এবং বিক্রি করার অপবাদও তাদের ওপর রয়েছে। বাণিজ্যের অনুমতি নিয়ে এলেও তারা ক্রমে দস্যু হয়ে ওঠে। নিরীহ মানুষদের খুন করার মতো অপরাধেও তাদের নাম জড়িয়ে আছে।
মকসুদ আহমেদের স্মৃতিতেও এমন কিছু গল্পের উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেন, 'শুনেছি তারা মানুষের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট করত। জোর করে মেয়ে, ছেলে-মেয়ে যাকেই পেত, ধরে নিয়ে যেত। তাদের বিক্রি করত ফিরিঙ্গি বাজারে। সেখানে নিলামে তোলা হত। এসব বেশ আয়োজন করেই চলত।'
তিনি আরও বলেন, ফিরিঙ্গিদের ভয়ে একসময় মানুষ দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকত। দিন বা রাত যেকোনো সময় তাদের ভয়ে সবাই আতঙ্কিত থাকত। এমনকি অনেক বাড়ির দরজা-জানালা বড় করে বানানো হত না, যাতে পর্তুগিজদের নজরে না পড়ে। তাদের পায়ের আওয়াজ পেলেই চুপচাপ দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকত সবাই। এমনকি অনেকে রাতের বেলা আলো না জ্বালিয়েই বসে থাকত।
চট্টগ্রামে ফিরিঙ্গিদের আগমন
১৫২৮ সালে পর্তুগিজদের প্রথম আগমন ঘটে চট্টগ্রামে। ১৫৩৪ সালের দিকে তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এরপর ১৫৩৭ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ তাদের চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি ও বন্দরের শুল্ক আদায়ের অনুমতি দেন। তখন থেকেই তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের শুরু। কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে তারা বিভিন্ন স্থানে বসতবাড়ি তৈরি শুরু করে।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটা, কাঁচা বাজার মোড়, ফিরিঙ্গি বাজার এবং অভয়মিত্র ঘাটের আশেপাশেই ছিল তাদের ঘরবাড়ি। এসবের পাশাপাশি ব্যবসার সুবিধার্থে তারা বড় বড় আড়তও স্থাপন করে।
শুরুতে পর্তুগিজরা জাহাজেই বসবাস করত। পরে জাহাজ ছেড়ে যখন তারা স্থলে বসবাস শুরু করে, তখন নদীর পাড়ে থাকা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের জমি দখল করে সেখানে ঘরবাড়ি বানানো এবং লুটপাটের কারণে অনেকেই তাদের আবাস ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। সে সময় কর্ণফুলীর এপারে বিশাল একটি জেলে পাড়া ছিল। পর্তুগিজদের অত্যাচারে সেখানকার মানুষও আর থাকতে পারেনি, পালিয়ে যেতে হয় নদীর ওপারে।
ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে বসবাস করা মো. রফিকও একই কথা বলেন। ষাটোর্ধ্ব এ বৃদ্ধ তিন পুরুষ ধরেই এ এলাকায় বাস করছেন। তিনি বলেন, 'আম্মার কাছে শুনসি ফিরিঙ্গি বাজারের এ পাড়ে অনেক জেলে থাকত। জেলেদের একটা পল্লীই ছিল। সে পল্লীও নাই, মানুষগুলোও নাই। ফিরিঙ্গিদের ভয়ে তারা সব ছেড়ে নদীর উপারে চলে যায়।'
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, শুরুর দিকে পর্তুগিজরা এমন কাজে লিপ্ত ছিল না। সুলতানি শাসনামলে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই পর্তুগিজরা তাদের কার্যক্রম চালায়। এছাড়া, চট্টগ্রামে তাদের কুঠি স্থাপনের অন্যতম কারণ ছিল এর প্রাকৃতিক গঠন। শহরটি অনেকটা পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের মত ছিল। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর সঙ্গে পর্তুগালের দ্যুরো ও ট্যাগু নদীর মিলও ছিল। এ মিল থাকার কারণে তারা চট্টগ্রামকে বসতি এবং বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়।
অবশ্য, বাণিজ্য ও শুল্ক আদায়ের যে অনুমতি তারা সুলতানের কাছ থেকে পেয়েছিল, সেটার কোনো ভালো ব্যবহার তারা করেনি। বরং শুরু থেকেই তারা এ অনুমতির অপব্যবহার করেছে। বাণিজ্য সেখানে ছিল কেবল নামমাত্র। এর আড়ালে জলদস্যুবৃত্তি, অপহরণ, লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধই হয়ে দাঁড়ায় তাদের মূল পেশা। এমনকি দ্রুত লাভবান হওয়ার নেশায়, পর্তুগিজরা দাস ব্যবসাকেও পেশা হিসেবে বেছে নেয়।
ফিরিঙ্গিদের দস্যুবৃত্তি ও দাস ব্যবসা
দস্যুবৃত্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, যে পর্তুগিজরা এখানে এসেছিল, তাদের অনেকেই নিজ দেশে বিভিন্ন অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিল। এ দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরাই দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আসে, এবং সেখান থেকে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। সে সময় আরাকানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে ঘরে ঘরে চলতে থাকে ডাকাতি, চুরি, লুণ্ঠন, ছিনতাই এবং অপহরণ। তাদের কৃতকর্মের প্রতিফলন পাওয়া যায় বিভিন্ন সাহিত্যকর্মেও। যেমন, পূর্ববঙ্গ গীতিকার 'নুরুন্নেহা ও কবরের কথা' পালায় দেখা যায়:
'ঘরের পরবেশিলো ডাকু, খুলিলো সিন্দুক
টাকা কড়ি ছিল যত সব লইলো লুডি
নূরুন্নেহা কাইনত লাগিলো মাথা কুডি কুডি
দুরন্ত হার্মাদ্দ্যার ডাকু কিনা কাম করে
কৈন্যারে বাধিয়ে লইলো মাথার উপরে।'
পালাগানের এ অংশে পর্তুগিজ দস্যুদের কর্মকাণ্ডের কিছু দিক স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পর্তুগিজ এবং আরাকানি জলদস্যুদের 'হার্মাদ' বলা হতো, এবং পালাগানের উল্লেখিত অংশে এ শব্দের উপস্থিতি সেটাই নিশ্চিত করে। এছাড়া এ পালাগানে পর্তুগিজ দস্যুদের পোশাকের বর্ণনাও পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, তারা পরত লাল কোর্ট, কালো ছোট প্যান্ট এবং রঙিন টুপি। 'নাছর মালুম' পালায় তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রেরও উল্লেখ পাওয়া যায়—দেশীয় অস্ত্র যেমন লাঠি, বল্লম, তলোয়ারের পাশাপাশি বন্দুক ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে।
বিখ্যাত পর্যটক মানুচির লেখায়ও পর্তুগিজ দস্যুদের বর্বরতার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লেখেন:
'এ পর্তুগিজরা বাংলার ভূখণ্যে এসে ব্যাপকভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। নৌকোয় করে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেঘুরে নারী-পুরুষ, শিশু, সোনা-রূপা যা কিছুই পেত, সব লুট করে নিয়ে যেত। তাদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের এখানেই শেষ নয়। রাতের বেলায় অনেক সময় জিম্মি করে রাখা মায়েদের কোলের দুগ্ধশিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে মাঝ নদীতে ফেলে দিত তারা। এ নির্মম-নিষ্ঠুর কাজটি তারা করত কেবল বাচ্চাগুলো কান্না করত বলে।'
তাদের এ নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের আরও কিছু দিক উঠে আসে শিহাবুদ্দিন তালিশের 'ফাতিয়া-ই-ইব্রিয়া' গ্রন্থে। তিনি লেখেন:
'আরাকান থেকে ফিরিঙ্গিরা প্রতি বৎসর জলপথে বাঙ্গালায় ডাকাতি করিতে আসিত; হিন্দু, মুসলমান, স্ত্রী, পুরুষ, ধনী, দরিদ্র যাহাকেই পাইত বন্দী করিত এবং তাহাদের হাতের পাতা ফুটা করিয়া তার মধ্যে পাতলা বেত চালাইয়া দিত এবং এভাবে তাহাদিগকে নৌকায় ডেকের নিচে বাধিয়া একটির ওপর একটি রাখিয়া স্তুপীকৃত করিয়া লইয়া যাইত। যেমন খাঁচার মধ্যে মুর্গীকে দানা ফেলিয়া দেওয়া হয়, তেমনি তাদের জন্য প্রাতে ও সন্ধ্যায় অসিদ্ধ চাউল দেওয়া হইত। এত কষ্ট ও অনাচারে অনেকে মরিয়া যাইত। শক্ত প্রাণ লোক বাঁচিয়া থাকিত। তাহাদিগকে চাষবাস ও ওলন্দাজ বণিকদের নিকট দাক্ষিণাত্যের বন্দরে বিক্রয় করা হইত।'
সতের শতকের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চলে দাস ব্যবসার জন্য কয়েকটি বাজার গড়ে উঠে। এসব বাজারে শুধুমাত্র দাস কেনাবেচার কাজ করত পর্তুগিজরা।
বাজারগুলো হলো, পূর্বে চট্টগ্রামের দেয়াঙ্গ (কর্ণফুলী নদীর মোহনার অপর পারে ছিল, অর্থাৎ চট্টগ্রামের দক্ষিণে), অঙ্গারখালি (বাঁশখালী থানার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অঙ্গারখালি নামক একটি পর্তুগিজ শহর ছিল, যা শতাধিক বছর আগে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়) ও আরাকান বন্দর। এসব দাস কিনে নিতেন ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং ফরাসি বণিকরা। চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের সবচেয়ে বড় বসতি ছিল এসব বাজারকে কেন্দ্র করে। তাদের বেশিরভাগ বাস করত দেয়াঙ্গ, অঙ্গারখালি, ফিরিঙ্গি বাজার, পাথরঘাটা এবং জামালখান এলাকায়।
এতে ব্যবসার কাজে যেমন তাদের সুবিধা হতো, তেমনি যাতায়াতেও। এক সময় চরমে পৌঁছায় এ দাস ব্যবসা। এভাবে চলতে থাকার ফলে ধীরে ধীরে জনমানবহীন হয়ে পড়ে এসব এলাকা। এমনকি দস্যুদের উৎপাতে নদীর দুপারও হয়ে উঠেছিল বসতিশূন্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদল বাংলা অঞ্চলে বর্গি নামর পরিচিত থাকলেও চট্টগ্রামের লোকজন আরাকানিদের বর্গি বলে জানতেন। পরে তাদের সঙ্গে মিলে পর্তুগিজরাও যখন দস্যুবৃত্তি শুরু করে, তখন তাদেরও এ নামে ডাকতে শুরু করে মানুষ।
স্থানীয় অনেকের মতে, এ দস্যুরা মানুষকে যতভাবে কষ্ট দেওয়া যায়, তার সবটাই করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৬২১ সাল থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার নারী-পুরুষকে পর্তুগিজ দস্যুরা দাস হিসেবে বিক্রি করে।
এর মধ্যে বন্দি করা সুন্দরী নারীদের কেউ কেউ স্ত্রী বা উপপত্নি হিসেবে রাখত। ফলে চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের অনেক বংশবিস্তার ঘটতে শুরু করে। স্থানীয়রা তাদের এ বংশধরদের 'কালা ফিরিঙ্গি' বা 'মেটে ফিরিঙ্গি' বলে অবহিত করতেন।
ফিরিঙ্গিদের সন্দ্বীপ দখল
তবে শুরুর দিকে এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা তাদের। অন্যান্য সব ইউরোপীয়দের মতোই বাণিজ্য করতে এসেছিল পর্তুগিজরা। ভাগ্য ফেরানোর আশায় বাংলায় আসা পর্তুগিজ অনেক নাবিকই ব্যবসা শুরু করেন। বাড়তি আয়ের লোভে কেউ কেউ বর্গি জলদস্যুদের দলে ভিড়তে থাকেন। আবার অনেকেই আরাকানরাজের সেনাদলে ভাড়ায় কাজ করতেন।
এমন সময় শুরু হয় সন্দ্বীপ দখল নিয়ে টানাপোড়েন। মেঘনার মুখে থাকা সন্দ্বীপ তখন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রতীরে যাওয়ার অন্যতম জলপথ। জানা যায়, জাহাজ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের যোগান আসত সন্দ্বীপ থেকে। এছাড়া বাংলার জন্য লবণের যোগানও আসত সেখান থেকে।
সবকিছু মিলিয়ে সন্দ্বীপ ছিল একটি শক্তিশালী ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলার উপকূলে প্রভাব বিস্তার করতে হলে পর্তুগিজদের সন্দ্বীপকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে হতো। ফলে অনেক পর্তুগিজ দখলের উদ্দেশ্যে সন্দ্বীপে ভিড়তে থাকে।
১৬০২ সালে সন্দ্বীপ প্রথম পর্তুগিজদের দখলে আসে। তবে এর পেছনের গল্পটি বেশ মজার। সিরিপুরের রাজা মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সাহায্য চান ভাড়াটে পর্তুগিজ সৈন্যদলের ক্যাপ্টেন ডমিঙ্গোস কারভালহোর। কারভালহোর মাথায় অন্য চিন্তা। তিনি সন্দ্বীপ দখলের ফন্দি আঁটেন।
সে মোতাবেক সিরিপুরের রাজাকে হটিয়ে দিয়ে নিজেদের জন্য ঘাঁটি করার পরিকল্পনা করেন। সে সময়ে দিয়াঙ্গের দুর্গের প্রধান ছিলেন মানুয়েল দ্য মাত্তোস। তিনি ৪০০ জনকে সঙ্গে নিয়ে কারভালহোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। দুজনে মিলে সহজেই সন্দ্বীপ দখলে নেন। তারপর চুক্তি মোতাবেক সন্দ্বীপ ভাগ করে নেন নিজেদের মধ্যে।
তবে তাদের এ খুশি স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। ১৬০৪ সালের দিকে কারভালহোকে দাওয়াত দিয়ে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন চণ্ডীকানের রাজা। মাত্তোস হয়ে যান সন্দ্বীপের একমাত্র অধিপতি। তিনি সন্দ্বীপ ও দিয়াঙ্গাকে একাই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।
বছর তিনেক সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। তবে ১৬০৭ সালে ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি। দুই জায়গায় আরাকান বাহিনীর আক্রমণে প্রায় ৬০০ পর্তুগিজ মারা যায়। মাত্তোসও মারা যান এ আক্রমণে। হাতেগোনা কয়েকজন পর্তুগিজ কোনোরকমে পালিয়ে আশ্রয় নেন পাশের বন-জঙ্গল-সমুদ্রে। তাদের একজন ছিলেন সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস তিবাউ।
ছোট্ট গ্রাম সান্তো আন্তোনিওতে জন্মেছিলেন তিবাউ। প্রথম ভারতে আসেন ১৬০৫ সালে। তিনি সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, কিন্তু বেশিদিন মনোযোগ দিতে পারেননি সে কাজে। ছেড়ে চলে আসেন সন্দ্বীপে এবং শুরু করেন লবণের ব্যবসা।
আরাকান বাহিনী যখন আক্রমণ করে, তখন তিবাউ আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিজেদের জাহাজে ছিলেন। আক্রমণে ৮–১০টি বেঁচে যাওয়া জাহাজ নিয়ে তিবাউ তার সহযাত্রীদের নিয়ে আস্তানা গাঁড়েন মেঘনার মোহনায়।
অবশ্য বাকলার রাজার সঙ্গে তার বেশ খাতির ছিল। ফলে তেমন কোনো ঝামেলার মুখে পড়তে হয়নি তাকে। বরং সেখান থেকে শুরু হয় জলদস্যুনেতা হিসেবে তিবাউয়ের উত্থান। বাকলার রাজার সাহায্য নিয়ে ১৬০৯ সালে তিবাউ জলদস্যুদল নিয়ে সন্দ্বীপে আক্রমণ করে বসেন।
এ সময় দিয়াঙ্গায় এক স্প্যানিশ জাহাজের আগমন ঘটে। তাদের সাহায্যে সন্দ্বীপ দখল করে তিনি সন্দ্বীপের সকল মুসলমানকে হত্যা করে নিজেকে সন্দ্বীপের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন তিবাউ।
স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে সন্দ্বীপ থেকে রাজত্ব চালাতে থাকেন তিবাউ। তার অধীনে তখন প্রায় এক হাজার পর্তুগিজ, দুই হাজার স্থানীয়, সঙ্গে ২০০ ঘোড়া আর ৮টি জাহাজ ছিল। তিনি বাকলার রাজাকে অগ্রাহ্য করে সন্দ্বীপ থেকে স্থানীয় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও নিজের মতো শাসনভার চালাতে থাকেন।
১৬১৬ সালের দিকে ওলন্দাজদের সাহায্য নিয়ে সন্দ্বীপে আক্রমণ করেন আরাকানরাজ। এবার পরাজয় হয় তিবাউয়ের। হারার পরে তিনি বাংলার মূল ভূখণ্ডে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই থেকে যান পরবর্তী জীবন। তবে তিবাউ বেশ শক্তিশালী রাজা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন সবার নিকট।
১৬১৭ সালের দিকে চট্টগ্রাম এবং দিয়াঙ্গকে কেন্দ্র করে আরাকান ও পর্তুগিজদের যৌথ জলদস্যুতা শুরু হয়। লুটপাট করে যা মিলতো, তা সমানভাগে ভাগ হতো নিজেদের মধ্যে। দাস হিসেবে যাদের ধরে আনা হতো, তাদের আরাকানরা কাজে লাগাতো কৃষিজমিতে, অন্যদিকে পর্তুগিজরা তাদেরকে যেকোনো বন্দরে চড়া মূল্যে বিক্রি করত।
এসব করার লক্ষ্যে সাতশরও অধিক পর্তুগিজ ততদিনে দিয়াঙ্গায় ঘর বেঁধেছে। তাদের বেশিরভাগ সময় কাটাত জলদস্যুতার পরিকল্পনা করে। ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মানরিকের ভাষ্যানুযায়ী, গোয়ার গভর্নরের অলিখিত সম্মতিও ছিল এর পেছনে।
কারণ উপমহাদেশের ক্ষমতার টানাপোড়েনে মুঘলরা পর্তুগিজদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তাদের চাপে রাখতেই এমনটি করা।
এখন আর ফিরিঙ্গিদের কেউই নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাদের বংশধরদের। সে সময়ে নদীর পাশে আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন যারা, তাদের কারও কারও সমাধি আছে পাথরঘাটার ক্যাথেড্রাল গির্জায়। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের হাত ধরে এটি তৈরির কাজ শুরু হয়।
পাথরঘাটার বান্ডেল রোডে এ গির্জাটি এখনও রয়ে গেছে। গীর্জার আশেপাশে বাস করেন ফিরিঙ্গিদের বংশধরেরা।
তেমনই একজন হলেন ফাদার রেগান ক্লেমেন্ট ডি কস্তা। তিনি আওয়ার লেডি অব দ্য হলি রোজারি ক্যাথেড্রাল গির্জায় পাদ্রী হিসেবে কর্মরত আছেন বর্তমানে। তিনি বলেন, 'আমার জানামতে, পুরো বাংলাদেশে ১৫টি প্রাচীন গির্জা রয়েছে। তার মধ্যে প্রাচীনতম হলো বান্ডেল রোডের এ হলি রোজারি গির্জা।'
তার ভাষ্যে, পর্তুগীজদের অনেকের কবর এ গীর্জায় আছে। কিন্তু পূর্বপুরুষদের সমাধি এ গির্জায় থাকলেও, বংশধরদের কেউ আসেননা সেভাবে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ফাদার রেগান। কিন্তু এ সময়কালে কাউকে তিনি দেখেননি।
তবে তার ধারণা, অনেকে হয়তো জানেনই না তাদের পূর্বপুরুষদের সমাধি রয়েছে চট্টগ্রামে। ফাদার রেগান নিজের পরিচয় দেন পর্তুগিজদের বংশধর হিসেবে।
ফাদারের স্পষ্ট জবান হলো, তার পূর্বপুরুষ ছিল পর্তুগিজ। তিনি বলেন, 'শুধু আমি নই, এমন হাজারখানেক বংশধর বাস করছেন ফিরিঙ্গি বাজারের এলাকায়। তবে বেশিরভাগের বসবাস পাথরঘাটায়। অনেকের কাছে শুনেছি, পর্তুগিজদের বহু সংখ্যক বংশধর নাকি এ এলাকা ছেড়েছেন অনেক আগে। কেন ছেড়ে গেছেন, সেটা জানি না।
'এ চার্চের প্রথম যে ফাদার ছিলেন তিনিও একজন পর্তুগিজ ছিলেন বলে শুনেছি। মারা যাওয়ার পরে তাদের নিয়ে স্মৃতিশোধও করা হয়েছে এখানে। উনার নাম ছিলফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ। বলা হয়, গির্জার নিচেই না-কি তার সমাধি। অর্থাৎ সমাধির ওপরেই গির্জা নির্মাণ করা হয়েছিল।'
যখন পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে, তখন তাদের সঙ্গে আসে যাজকরা। তখন ২৫০০ এর মতো পর্তুগিজদের এখানে বসবাস করার কথা শুনেছি। এখন সরাসরি কোনো পর্তুগিজ নেই। তবে তাদের বংশধর বা টাইটেলধারী অনেকেই আছেন।
১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের ধর্মযাজক ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ ও ফাদার দোমিঙ্গো দ্য সুজা এ দুজন মিশনারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থেকে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও দিয়াঙ্গে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ফ্রান্সিসকো ছিলেন হলি রোজারি ক্যাথেড্রাল চার্চের প্রথম ফাদার।
ফাদার রেগানের মতে, ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় পর্তুগিজদের সেভাবে কোনো নিদর্শন নেই। ব্রিটিশ শাসনামলে এ গির্জায় নাকি পর্তুগিজদের বসতি থাকলেও পরে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় তারা। কেউ কেউ ফিরে যায় নিজ দেশে।
রেগানের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন মকসুদ আহমেদও। তিনিও জানান, 'পর্তুগিজদের পুরাতন কোনো নিদর্শন নেই। শুনেছিলাম, বাড়ির পাশে একটা রঙমহল ছিল। সে সময় পর্তুগিজরা এসে নাচ-গানের আসর জমাতো। বিভিন্ন নর্তকীদের ধরে নিয়ে আসা হতো। তারা গান গাইতো, নাচতো। এখন সে রঙমহলও আর নেই।
আমাদের বাসার এ রাস্তার আশেপাশে অনেক পর্তুগিজরা থাকত। তারপর তাদের বংশধরেরা। এখন তারাও নেই। ঘরবাড়ি যা ছিল, সেগুলোও বিক্রি করে চলে গেছে। ওসব ভেঙে নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে এখন।'