খিরু থেকে শীতলক্ষ্যা: ভালুকার শিল্পকারখানাগুলো যেভাবে নদী দূষণ করছে
ভালুকায় অবস্থিত শিল্পকারখানাগুলো সেখানকার নদী ও বাসিন্দাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে তা দেখতে আমরা প্রায় ৩০ কিলোমিটার ঘুরেছি। এই যাত্রায় মোট তিনটি উপজেলায় (ময়মনসিংহে দুটি ও গাজীপুরে একটি) যাওয়া হয়েছে।
যাত্রার এক পর্যায়ে দেখতে পাই, ময়মনসিংহের ভালুকা থানা মোড়ে ব্রিজের পাশে একটি গাছের নিচে আলম মাস্টার ও মঞ্জুরুল হক নামের দুই মধ্যবয়সী লোক গভীর আলোচনায় মগ্ন। এক্ষেত্রে পুরানো দুই বন্ধু ও সহপাঠীর কথায় বহু বিষয়ই উঠে আসে।
তখন এপ্রিলের প্রখর সূর্যে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। গরমের তীব্রতা কমানোর জন্য আশেপাশে খুব কমই বাতাস ছিল। এছাড়াও, সেতুর নিচ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। খিরু নামের একটি সরু নদী দিয়ে প্রবাহিত পিচের ন্যায় কালো পানি শিল্পবর্জ্যের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে বহুদূর।
একসময় আলম, মঞ্জুরুল ও তাদের বন্ধুরা এই নদীতে গোসল করত। গবাদি পশু পানি পান করত। গৃহিণীরা রান্নার কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতো।
মঞ্জুরুল বলেন, "এরকম গরমের দিনে আমরা সারাদিন এই নদীতে সাঁতার কাটতাম। এটি ছিল বড় ও পানিতে ভরা।"
অন্যদিকে আলম মাস্টার বলেন, "কিন্তু এখন এই পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পচে যাবে। এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদী।"
তিনি আরও বলেন, "গত ১৫ বছরে চোখের সামনে নদীটি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। এটি এলাকার শিল্পায়নের জন্য হয়েছে।"
আলম গভীর বিরক্তি নিয়ে বলেন, "হুয়াংহো যেমন চীনের দুঃখ, তেমনি আমাদের দুঃখ খিরু। হুয়াংহোকে এমনটা বলা হয় কারণ এটি অত্যন্ত বন্যাপ্রবণ নদী ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। নদীটি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ২৬ বার গতিপথ পরিবর্তন করেছিল এবং ১৫০০ বার প্লাবিত হয়েছিল।"
ভালুকা থানা মোড়ের দুই বন্ধু জানান, খিরু নদীর পুরোটা এখন এতটাই দূষিত যে, এর কালো জলের দুর্গন্ধের কারণে নদীর পাশ দিয়ে রাস্তা-ঘাটে হাঁটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মঞ্জুরুল বলেন, "আগে নদীর ধারে প্রচুর ধানক্ষেত ছিল। কিন্তু পচা পানি ফসলের ক্ষতি করে বলে আপনি আজকাল এমন অনেক ক্ষেত খুঁজে পাবেন না। এক্ষেত্রে নদীর ধারে যাদের বাড়ি তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।"
ভালুকায় ডাইং, কম্পোজিট, ওয়াশিং, সিরামিক, টাইলস ও ব্যাটারি তৈরির ৩০০টিরও বেশি ছোট, মাঝারি ও বড় কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার তরল বর্জ্য খাল-বিল ও নদীতে ফেলা হয়।
এই সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর ভালুকা জোনের সদস্য-সচিব কামরুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এর ফলে খিরু নদীর পানি বিষের চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। এই পানি পান করে গরু ও হাঁস মারা যাওয়ার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। এমনকি এই নোংরা পানির সংস্পর্শে এসে মানুষের পা (সংক্রমিত এবং) পচে যায়।"
কামরুল হাসান আরও বলেন, "যদিও এখন অনেক কারখানায় ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) আছে। কিন্তু বেশিরভাগই তাদের খরচ কমানোর জন্য তা বন্ধ রাখে।"
"যদি আপনার ইটিপি চালু থাকত, তাহলে পানির রঙ এতটা কালো হতো না এবং এমন দুর্গন্ধও থাকত না। আমাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ এবং বড় কারখানার ছবি আছে যেগুলো কি-না তাদের ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে বর্জ্য এবং রঙিন পানি ছেড়ে দিচ্ছে (খাল ও নদীতে)", যোগ করেন তিনি।
নদী ও ব-দ্বীপ গবেষণা কেন্দ্রের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান নদী বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আজাজ বলেন, "এসব ওয়াশিং, সিরামিক, টাইলস, রাসায়নিক ও ব্যাটারি কারখানায় উৎপাদিত বর্জ্য খুবই ক্ষতিকর। তবুও মনিটরিং বডির অনুপস্থিতিতে এই সমস্ত উপাদানগুলি অবশেষে খিরু হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে।"
দূষণকারীদের প্রশ্ন করা যখন 'ধৃষ্টতা'
ভালুকায় বহু কারখানা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের নিচে অবস্থিত। এগুলো আবার স্থায়ীয় খাল লাউতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে; যা খিরু নদীতে প্রবাহিত হয়েছে। এসব কারখানার তরল বর্জ্য বিভিন্ন পথ দিয়ে এই খালে আনা হয়; যা পরে নিচের নদীতে প্রবাহিত হয়।
আমরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সীডস্টোর বাজার থেকে হবিরবাড়ি গ্রাম পর্যন্ত এই খালটি অনুসরণ করি। এটি খনন করা হয়েছিল; যার ফলে শিল্প কারখানা থেকে বের হওয়া পানি সহজেই খিরুতে প্রবাহিত হয়। সেক্ষেত্রে ক্ষীরুর মতো লাউতির অবস্থাও বেশ বীভৎস। ভয়ংকর গন্ধের সাথে পিচের ন্যায় কালো পানি দেখা যাচ্ছিল৷
মানুষ সেতুর নিচের জায়গাটিকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করে। যা স্বাভাবিকভাবেই দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। কিন্তু খালের দুর্গন্ধ সহজেই অন্য দুর্গন্ধকে কাবু করে ফেলে।
খালের কাছাকাছি হাঁটতে হাঁটতে আমরা হঠাৎ একটা মৃত ছাগল দেখতে পেলাম। একদম কালো পানিতে ব্রিজের নিচে ছাগলটির পচনশীল দেহ আটকে ছিল; যা স্বাভাবিকভাবেই অসহনীয় দুর্গন্ধ তৈরি করেছিল। কিন্তু পানির দুর্গন্ধ আরও শক্তিশালী, এমনকি মৃত ছাগলের পচনশীল গন্ধকেও তা হার মানায়।
লাউতির খালের পরে আমরা দেখতে পাই এক্সিলেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (টাইলস এবং সিরামিক) নামের শিল্প কারখানাটিকে। তাদের তরল বর্জ্য বেশ কয়েকটি ড্রেনের মাধ্যমে খালে ফেলা হচ্ছে। সেখানে বুদবুদ করা পানি ও দুর্গন্ধ আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন কাবু করে ফেলে।
কিছু ছবি তোলার পর আমরা তাদের অফিসে গেলাম। সেখানে জানতে পারলাম, তাদের কর্মক্ষেত্রে ইটিপি নেই।
এক্সিলেন্স ইন্ডাস্ট্রিজের এইচআর এন্ড অ্যাডমিনের ম্যানেজার হাসিবুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের ইটিপি চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। কাজ শেষ। আমরা শীঘ্রই ইটিপি উদ্বোধন করব।"
হাসিবুল ইসলাম জানান, ফ্যাক্টরিটি ঐখানে প্রায় ১০ বছর ধরে উৎপাদন করছে।
এত বছর তারা কেন ইটিপি স্থাপন করেননি জানতে চাইলে হাসিবুল আমাদের দিকে পাল্টা অভিযোগ করেন, "আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন আমরা ইটিপি স্থাপন করিনি? এমনকি কোনো সরকারি সংস্থাও আমাদের এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে না।" এরপর তিনি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।
সংক্রমিত ধানগাছের শিকড়, ফসল কমে অর্ধেক
লাউতির নীচে খালের পানিতে আমরা একটি সেলো পাম্প (একটি জল পাম্পিং ডিভাইস) দেখতে পেলাম। খালের পানি কোথায় নেওয়া হচ্ছে তা যাচাই করতে প্লাস্টিকের পাইপটি অনুসরণ করলাম।
তখন ধান ক্ষেতে লোবনকোটা গ্রামের কৃষক সোহরাব হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানান, তার ধান ক্ষেতে খালের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সোহরাব বলেন, "এই পানি বিষাক্ত। কিন্তু আমি কী করব? আমরা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ পাই না। তাই আমরা এই খালের পানি ব্যবহার করি। যদিও এতে মাটি দূষিত হয় এবং ধান সংক্রামিত ও দুর্বল হয়ে যায়।"
কৃষক সোহরাব আরও বলেন, "ধানের বেঁচে থাকার জন্য আমাদের বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। তবে যা-ই করি না কেন, (এলাকার শিল্পায়নের) আগে আমাদের যা উৎপাদন হতো সেই তুলনায় উৎপাদন অর্ধেক কমে এসেছে।"
গরমের মধ্যে হবিরবাড়ির একটি দোকানে বেশ কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিল। সেখানে লিটন নামের এক কৃষক বলেন, "এই খালটি দীর্ঘ; আপনি এটিকে মাওনা (লোবনকোটা গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে) এবং তার পরেও খুঁজে পেতে পারেন। এই পথের সমস্ত কারখানার বর্জ্য খালটির পানিতে ফেলা হয়।"
দোকানদার শেখ ফরিদ বলেন, "এখন যেহেতু প্রখর রোদে দেখা যাচ্ছে, খুব শীঘ্রই বেশ খারাপ গন্ধে পুরো এলাকাটি ভরে যাবে। কাছাকাছি বসবাস করা কঠিন। কিন্তু আমরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে যেতে পারি না।"
খিরু থেকে শীতলক্ষ্যা; এক দূষিত নদী বলয়
আমরা কাওরাইদের কাছে ত্রি মোহনা সেতু হয়ে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এই সেই জায়গা যেখানে খিরু নদী অন্য নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। স্থানীয়রা একে সুতিয়া নদী বলে।
গুগল ম্যাপ ব্যবহার করলে নদীটির নাম আসে বানার। কিন্তু স্থানীয়রা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, "শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হওয়ার আগে খিরু বানার নয়, সুতিয়ার সাথে মিলিত হয়। নদীর দুর্গন্ধের উৎস খোঁজ করার পাশাপাশি আমাদের নামের বিভ্রান্তির বিষয়টিকেও বিবেচনায় আনতে হয়েছিল।
ত্রি মোহনা সেতুর সাথেই উরহাটি গ্রাম; যেখানে খিরু ও সুতিয়া নদী মিলিত হয়েছে। এখানে ময়মনসিংহের ভালুকা ও গফরগাঁও উপজেলা এবং গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পৃথক হয়েছে।
গ্রামের বৃদ্ধ আবুল কালাম জানান, শরতের কয়েক মাস ছাড়া সব সময় নদীর পানিতে দুর্গন্ধ লেগেই থাকে।
দোকানদার উজ্জ্বল তখন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "এখন যদি আমরা আমাদের গবাদি পশুকে এই পানিতে গোসল করাই, তবে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। আমরা যদি এই পানি ফসলের জন্য ব্যবহার করি তবে গাছগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ এই পানি স্পর্শ করলে অসুস্থ হয়ে যায়। এমনকি কোনো মাছও এখানে বেঁচে থাকতে পারে না।"
সেতুর নিচে একটি রাবার ড্যামের দায়িত্বে রয়েছেন ফিরোজ খান। এটি কৃষিজমিতে ব্যবহারের জন্য পানি ধরে রাখতে ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন, "আপনার (সাংবাদিকের) সাথে কথা বলে লাভ নেই। অনেকেই এসেছে, কথা বলেছে, পানির স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছে। যদি রমজানের সময় আসতেন, তখন দুর্গন্ধের কারণে নদী থেকে এই দূরত্বে দাঁড়াতেও পারতেন না।"
স্থানীয়রা জানান, তারা একাধিকবার মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। একইসাথে স্থানীয় সংসদ সদস্য ভালুকার পানি যাতে আর দূষিত না হয় তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
পানির প্রবাহ গফরগাঁও-মাওনা সড়কের ত্রিমোহনী সেতুর কাছে আরেকটি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে বানার নামে পরিচিত। কিন্তু গুগল ম্যাপে একে শিলা নদী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এরপর এই মিলিত প্রবাহ শীতলক্ষ্যায় প্রবেশ করে।
আমাদের সেতুতে রতন নামে একজন স্থানীয় জেলের সাথে দেখা হয়। তিনি বলেন, "এখানকার পানি পচা ও বাজে। নদীর পানি কমে আসছে; নদী সংকুচিত হয়ে আসছে। একসময় মানুষ এর গভীরতার কারণে পানিতে নামতে ভয় পেত। আর এখন আপনি চাইলে নদীর জলের কচুরিপানার উপর দিয়ে হাঁটতে পারবেন।"
রোটন জানান, এখানকার জেলেরা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য এলাকায় মাছ ধরার জন্য যায়।
ভালুকা নদী যেখান থেকে প্রবাহিত হয়েছে সেখান থেকে শুরু করে শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত শীতের সময়ের মতো কচুরিপানার স্তূপে ভরপুর। আমাদের শীতলক্ষ্যা পাড়ের বর্মী বাজার ঘাটে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে।
আলমগীর ১১ বছর ধরে এখানে নৌকা চালায়। এই মাঝি বলেন, "প্রতি বছর পানি আরও কালো হচ্ছে। মাছগুলো অক্সিজেনের অভাবে নদীতে মারা যাচ্ছে।
এই সম্পর্কে বর্মি বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, "মাছ অক্সিজেনের অভাবে অনেক সময় উপরে উঠে আসে; এমনকি মারাও যায়। ভালুকার পানি এই নদীকে ময়লা করছে।"
বাপার কামরুল হাসান বলেন, "আজকের দূষিত খাল লাউতি সিএস রেকর্ডে একটি নদী ছিল (দেশে প্রথম জেলাভিত্তিক মানচিত্র ও জমির রেকর্ড)।"
এ সব নদী কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নিয়ে কামরুল হাসান হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "সরকারি সংস্থাগুলো আমাদের চাপের মুখে যখন কিছু কারখানা পরিদর্শন করে, তখন তারা সরাসরি কারখানায় প্রবেশাধিকার পায় না। তারা তখনই ইটিপি চালায় যখন তারা খবর পায় যে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন গেটে আছে।"
এই সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম বলেন, "ভালুকা থেকে এখানে দূষণ আসছে। প্রতি বছর এই এলাকা আরও দূষিত হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় বর্জ্যও শীতলক্ষ্যায় ফেলা হচ্ছে। এগুলো ধীরে ধীরে নদীটিকে মেরে ফেলছে।"
কামরুল জানান, ভালুকা থেকে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে এক্সপেরিয়েন্স নামের একটি কম্পোজিট কারখানা রয়েছে। তাদের পানি নিষ্কাশনের জন্য কাছাকাছি কোনো খাল নেই। তাই তারা দূষিত পানি কৃষি জমিতে ছেড়ে দেয়। ফলে কৃষি জমির এমন ক্ষতি হয়েছে যে, পাঁচটি ইউনিয়ন ও ১৮টি গ্রাম ফসলি জমি শূন্য হয়ে পড়েছে।
এর ফলশ্রুতিতে সেখানে বিক্ষোভ হয়েছিল। সাময়িকভাবে কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। শেষমেশ কারখানাটি প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে খিরু নদীতে বর্জ্য ফেলার মাধ্যমে ফের উৎপাদন শুরু করে। তখন প্লাস্টিকের পাইপ ভেঙ্গে আবারও কৃষি জমিতে বর্জ্য পড়তে থাকে। তারপর তারা স্টিলের পাইপলাইন তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে কামরুল জানান, এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
যদিও ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মেজবাবুল আলম জানান, তারা নিয়মিত কারখানাগুলো পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন করেন এবং ফাঁকফোকর পাওয়া গেলে জরিমানা করেন। এমনকি তারা অনলাইনেও ১৮টি কারখানা পর্যবেক্ষণ করছেন।
ইটিপি চালু থাকলে পানির অবস্থা কেন এমন প্রশ্ন করা হলে মেজবাবুল আলম বলেন, "ইটিপি চালু থাকলে পানির এই অবস্থা হতো না। যদি কিছু কারখানা তাদের ইটিপি বন্ধ রাখে, তাহলে তা দূষণ সৃষ্টি করতে পারে।"
উপ-পরিচালক আরও বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি যাতে ইটিপি সার্বক্ষণিক চালু থাকে। আমরা অনেক কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।"
কামরুলের যে অভিযোগ ছিল অর্থাৎ কারখানাগুলোতে ইটিপি থাকলেও বন্ধ রাখা হয়, এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মেজবাবুল বলেন, "আমাদের অফিস থেকে আমরা ১৩টি উপজেলা মনিটরিং করি। এই এলাকায় অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে। কারখানায় নীতি-নৈতিকতা না থাকলে আমাদের পক্ষে সারাক্ষণ বসে থাকা সম্ভব নয়।"
আরডিআরসি-এর মোহাম্মদ আজাজ বলেন, "খিরু নামটি খির থেকে এসেছে। কারণ এটি প্রচুর পলি বহন করত। যার ফলে নদীটিকে খিরের মতো বাদামি দেখায়। এর পানি ছিল খুবই পরিষ্কার ও সুস্বাদু।"
তিনি আরও বলেন, "খিরু, শিলা ও বানার নদীর উপরের দিকে থাকা অনেক টাইলস, সিরামিক, রাসায়নিক ভিত্তিক ওয়াশিং প্ল্যান্ট ও ব্যাটারির কারখানায় কীভাবে রাসায়নিক নিঃসরণ করে তা মনিটরিং করা হয় না। এখন ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে শুধু মাছই নয়, কাঁকড়াও পানি থেকে পাড়ে চলে আসে। কারণ পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে থাকে।"
"আমরা দেখেছি যে, নদী জুড়ে এক থেকে তিন/চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধে বিভিন্ন লুকানো লাইন এবং খালের মাধ্যমে তাদের নিষ্কাশন লাইনগুলি এই নদীগুলিতে স্থাপন করা হয়েছে।"
আজাজ এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিসের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, "এরকম একটি ছোট অফিস দিয়ে এত বড় অপারেশন, জরিপ, মনিটরিং কীভাবে করতে পারবেন? ক্ষমতা ও জনবল ছাড়া তারা কী মনিটরিং করতে পারবেন? পরিচালক নিয়োগ ও জনবল বাড়াতে হবে।"
আজাজ বলেন, "স্মার্ট মনিটরিং নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।" এক্ষেত্রে তিনি এই পর্যবেক্ষণে নাগরিকদের অংশগ্রহণও আহ্বান করেন।
"আমরা এই তথ্যটি জনসাধারণকে জানাতে চাই। যাতে কোনও কারখানা ইটিপি চালাচ্ছে কি না; স্থানীয় লোকেরা সেই সম্পর্কে সচেতন হয়। এক্ষেত্রে আমাদের জনগণের অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। বাংলাদেশে অনেক প্রকল্পই ফলাফল আনছে না। কারণ সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নেই", যুক্ত করেন আজাজ।