কিউ জি সামদানীই কি ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প?
ঢাকার প্রথম সবকিছু নিয়ে মুনতাসীর মামুনের যে বই, তাতে প্রথম স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মন্দির, পানির ট্যাংকি, বৈদ্যুতিক বাতি, কবরস্থান, সংবাদপত্র— এসব নিয়েই ইতিহাস লেখা আছে। কিন্তু অনেক খুঁজেও পেলাম না ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প নিয়ে কোনো বইপত্তর বা লেখাজোখা। অথচ, সেদিন একজনের ফেসবুক পোস্টে দেখলাম, ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প নাকি ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংকির পাশেই অবস্থিত।
নাম, 'কিউ জি সামদানী অ্যান্ড কোম্পানি'। গুলিস্তান থেকে সদরঘাটে যেতেই বাহাদুর শাহ পার্কের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে এই পাম্প। তাতে লেখা আছে, ষাট বছর ধরে ঢাকাবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে পাম্পটি।
পাম্পটির ঠিক পশ্চিমে শাঁখারিবাজার, পেছনে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ এবং পাশে বাহাদুর শাহ পার্ক, অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া পার্ক। অন্যান্য পাম্পের তুলনায় এই পাম্প স্টেশনটি একটু ছোটোই। দেশভাগের পরপর পঞ্চাশের দশকেই স্থাপিত হয়েছিল এই পাম্পটি কাজী গোলাম সামদানীর হাত ধরে। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পৈর্তৃকভিটে কুমিল্লাতে হলেও, ব্যবসার জন্য ত্রিশের দশকেই সামদানী চলে আসেন ঢাকার সূত্রাপুরে। সেখানেই ব্যবসা শুরু করেন।
তখন ঢাকাও ছিল ছোটো, জনসংখ্যাও ছিল কম। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান এই এলাকার চারদিক নিয়ে ছিল ঢাকা শহর। আর যানবাহন বলতে পালকিই ছিল ঢাকার আদি বাহন। ইঞ্জিনচালিত গাড়ি রাস্তায় নামার আগে পরে ঘোড়ার গাড়ি চলেছে দীর্ঘকাল। ঘোড়ার গাড়িতে ইঞ্জিন জুড়ে দিয়েই বাংলার প্রথম দিককার মোটরগাড়ির উদ্ভব।
বিশ শতকের প্রথম থেকেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদাররা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি কেনা শুরু করেছিলেন। তবে সাধারণ জনগণ তখনই পারেননি। মোটরগাড়ির সাথে তারা পরিচিত হন ত্রিশের দশকে জনসাধারণের জন্য ট্যাক্সি সার্ভিসের শুরু হওয়ার মধ্য দিয়েই। আর ঢাকায় প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। বাসের মধ্যে মওলা বখসের মুড়ির টিনের বাস ছিল জনপ্রিয়। এই বাস চলত ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নয়ারহাট, ঢাকা-মিরপুর, ঢাকা-ডেমরা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে।
১৭৯০ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া রেজিস্ট্রার থেকে সারা বাংলায় মাত্র ১০ জন ঘোড়ার গাড়ি নির্মাতার সন্ধান পাওয়া যায়। আর মোটরগাড়ি ঢাকায় প্রথম এসেছিল নবাবদের হাত ধরেই। বিংশ শতকের প্রথম থেকে ধনী ব্যক্তিরাও নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মোটরগাড়িকে। সেকালের ঢাকার বড় মোটর কোম্পানির নাম ছিল মোমিন মোটর ওয়ার্কস, লোকে যাকে মোমিন কোম্পানি বলত। (ঢাকার জনপরিবহন, কালেকন্ঠ, ২০১৪, ২২ অক্টোবর)
ঢাকায় ইঞ্জিন গাড়ি আসার বহু বছর পর এর যাত্রা শুরু হয় এই মেসার্স কিউ, জি, সামদানী অ্যান্ড কোম্পানি পেট্রোল পাম্পের। ১৯৫০-এর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ঢাকার প্রথম পেট্রোল পাম্প কিউ. জি. সামদানী অ্যান্ড কোং। তৎকালীন ঢাকা শহর বলতে গুলিস্তান ও সদরঘাটের এই এলাকাকেই বোঝানো হতো। তাই কাজী গোলাম সামদানী এখানেই প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা শহরের প্রথম পেট্রোল পাম্প।
এই পেট্রোল পাম্পের আগে লোকেরা তেলের ক্যান নিয়ে নিয়ে গাড়িতে তেল ভরতো। ত্রিশের দশকেরও আগে, যখন দেশভাগ হয়নি তখন ব্রিটেন থেকে জাহাজে করে টিনের ড্রামে পেট্রোল আসত কলকাতায়। সেই পেট্রোলই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করতেন অমৃতলাল দাঁ। পরবর্তীতে তার ছেলে জটাধারী দাঁ'র হাত ধরে কলকাতায় প্রথম পেট্রোল পাম্প গড়ে ওঠে ১৯২৯ সালে। বাংলাদেশে পেট্রোল পাম্প গড়ে ওঠে তারও অনেক পরে সেই পঞ্চাশের শুরুতে। তার আগে এখানে পেট্রল বিক্রি হতো গ্যালন হিসেবে।
পাম্পের দ্বিতীয় শাখা ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে স্থাপন করা হয়। দুটি শাখাই পেট্রোল পাম্পটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী গোলাম সামদানীর নামে নামকরণ করা হয়।
বর্তমানে পাম্পটির মালিক সামদানীর চতুর্থ ছেলে কাজী ফিরোজ সামদানী, ডাকনাম পাবলু। তার তত্ত্বাবধানেই বর্তমানে পাম্পটি পরিচালিত হচ্ছে। যদিও তিনি বেশিরভাগ সময়ই দেশের বাইরে অবস্থান করেন এবং তার অনুপস্থিতিতে পাম্পটি পরিচালনা করছেন দায়িত্বরত ম্যানেজার।
পাম্পটির ইতিহাস সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে কাজী ফিরোজ সামদানী জানান, "আমি আমার বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান এবং লম্বা একটি সময় আমি কাটিয়েছি দেশের বাইরে। আমরা প্রায় সব ভাইবোনই বাইরেই থেকেছি। সত্যি বলতে কখনো এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা বা আগ্রহবোধ করিনি। পাম্পটি দেখাভালো করার দায়িত্ব এখন আমার উপর। ফলে এখন অনেকেই আসে ঢাকার প্রথম পাম্প সম্পর্কে জানতে। তখন আফসোস হয়।"
"ঠিক কী কারণে আব্বা সেই সময়ে এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন জানিনা। তবে তিনি ছিলেন খুব সুদূরপ্রসারী। হয়তো ঢাকায় উত্তরোত্তর মোটরগাড়ির বৃদ্ধিই তাকে পেট্রোল পাম্পের অভাব উপলব্ধি করিয়েছিল," যোগ করেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকে আমরা জ্বালানি তেল সংগ্রহ করতাম স্টয়ান্ডার্ড ভেকুউস ওয়েল কোম্পানি থেকে। পরবর্তীতে ষাটের দশকে এই কোপানির নাম বদলে রাখা হয় 'এসো ওয়েল কোম্পানি'। কাজী গোলাম সামদানী ঢাকা শহরে প্রথম পেট্রোল পাম্প স্থাপন করায় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের 'এসো অয়েল কোম্পানি' থেকে গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিলেন বলে জানান ছেলে ফিরোজ।
অতীতে যতটুকু জায়গাজুড়ে ছিল এখনো তাই আছে। আয়তনে পরিবর্তন না হলেও, আকৃতিগত কিছু পরিবর্তন তারা করেছেন বলে জানান কাজী ফিরোজ। আগে পাম্পে একতলা সমান একটি কাচের ঘর ছিল। এখন তা দোতলা ভবন করা হয়েছে। কর্মচারী যেখানে ছিল এক কি দুইজন, তা বেড়ে হয়ে গেছে সাত-আটজন। অতীতে হ্যান্ড অপারেটেড ম্যানুয়াল গ্যাস পাম্প দিয়ে তেল ভরা হত। আর বর্তমানে অটোমেটিক মেশিনের সাহায্যে পেট্রল দেওয়া হয়— বললেন কাজী ফিরোজ।
তেলের দাম এবং গাড়িঘোড়ার ভিড় দুটোই কম ছিল। সেই পঞ্চাশ–ষাটের দশকে শুধু ধনী হলেই না, একইসঙ্গে যারা ছিলেন শৌখিন তাদেরই গাড়ি ছিল। ফলে গাড়িঘোড়ার ভিড় ছিল না। এখনকার মতো চব্বিশ ঘণ্টা পাম্প খোলা রাখার নির্দেশও ছিল না। রাত নয়টা-দশটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যেত। তবে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকতো মওলা বখসের মুড়ির টিনের বাসগুলো।
শেখর চন্দ্র থাকেন পোগোজ স্কুলের পাশের গলিতেই। তিনি জানান, এই পাম্পটি যে দেশভাগের পর থেকে আছে তা তিনিও শুনেছেন। পাম্পের সাথে তার তেমন স্মৃতি নেই; শুধু জানান, পাম্পের ডান পাশে সন্ধ্যার পর থেকে সুস্বাদু বিট লবণ মিশ্রিত কাগজী লেবু আর গুড়ের চা পাওয়া যেত একসময়। যেটা খাওয়ার লোভে সন্ধ্যার পর প্রায়ই বন্ধুরা মিলে জড়ো হতেন পাম্পের পাশে।
তবে সামদানী পাম্পটি সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রথম পাম্প— বিষয়টি নিয়ে আছে কিছু মতনৈক্য। যদিও তারা পাম্পের ভেতরেই বড় করে সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছেন 'ওয়েলকাম টু দ্য ঢাকা সিটি ফার্স্ট পেট্রোল পাম্প'। আবার অনেকের মতে, মৎস্য ভবনের উল্টো দিকের রমনা পেট্রোল পাম্পটি সবচেয়ে পুরোনো। যদিও স্বাধীনতার আগে ওই এলাকায় দিনেও শেয়াল দেখা যেত বলে দাবি স্থানীয়দের।
এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বখশ জানান, "সামদানী পাম্পটি বেশ পুরোনো; তবে সবচেয়ে পুরোনো কি-না নিশ্চিত নই। ঢাকার আরেকটি পুরোনো পাম্প ছিল চকবাজারে, যেখান থেকে মিরপুরের বাস ছাড়তো। সে পাম্পটি এখন আর নেই। টিকে থাকা পাম্পগুলোর মধ্যে রমনা পাম্পটিও অনেক পুরোনো।"
স্বাধীনতার আগে বেশ কয়েকটি পাম্প স্থাপিত হয়। এগুলো ছিল— পুরানা পল্টন মোড়ে, মাতিঝিলে পূবালী ব্যাংকের হেড অফিসের পাশে, রামকৃষ্ণ মিশনের মোড়ে, অভিসার হলের পাশে– যা এখন রাজধানি সুপার মার্কেট ও র্যাবের কার্যালয়ের বিপরীতে, নীলক্ষেত মোড়ে ইত্যাদি। আবার ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের পাম্পটি নাকি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের সবচেয়ে পুরোনো পাম্প, এমনটাও দাবি অনেকের।
এছাড়া, আসাদ গেট, রাজারবাগ, যাত্রাবাড়ি-দয়াগঞ্জ সংযোগ মুখ, আরমানিটোলার ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীদের জন্য নয়াবাজার ছিল একসময়, কলেজিয়েট স্কুলের সামনেও ছিল, যা নেই এখন। আরেকটি ছিল ফুলবাড়িয়ায়। সম্ভবত আরামবাগে নটরডেম কলেজের উল্টো দিকেও একটা ছিল। বিজয়নগর মোড় নয়া পল্টন যেতে হাতে ডানে পাম্প আছে এখন টিনের বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছে সেটিও পাকিস্তান আমলের।
ঐতিহ্যবাহী এই পেট্রোল পাম্পটি এখনও ঢাকা শহরের এই এলাকার মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, ওজনে কম এবং কারচুপির মামলায় ২০১৮ সালে পাম্পটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়।