সময়ের সাথে যেভাবে চলে যায় কমলাপুরের কুলিদের জীবন
নিজ বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদী থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মোঃ ফারুখের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। একদিন বিকেলে তিনি মাইজদী রেলস্টেশনে ট্রেনে চড়ে ঢাকার দিকে রওনা হন। তিনি যখন রাজধানীতে পৌঁছান তখন চারিদিকে অন্ধকার।
ওই রাতে ফারুখ কমলাপুর রেলস্টেশনের একটি প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়া করার মতো কিছুই তার কাছে ছিল না।
ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফারুখ বলেন, "আমার এখনও মনে আছে সেদিন আমার বাবা আমাকে মারধর করেছিলেন। কারণ আমি স্কুলে যেতে চাইনি। তাই আমি আর কখনো বাড়িতে ফিরে যাবো না ভেবে পালিয়ে গিয়েছিলাম।"
কিন্তু ফারুখ বহুদিন পর ঠিকই গ্রামে ফিরেছিলেন। তবে সেটা পালিয়ে চলে যাওয়ার ১০ বছর পর; ২২ বছর বয়সে। সাথে পরিবারের সকলের জন্য উপহার ও কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন।
ফারুখ হাসিমুখে বলেন, "আমার মা আমাকে দেখে কাঁদছিলেন। সবাই অনেক বেশি খুশি ছিল।"
বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার ২৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে ফারুখ ৩৯ বছর বয়সি এক যুবক। কাজ করছেন কমলাপুর স্টেশনের ইনওয়ার্ড সেকশনের লেবার সুপারভাইজার হিসেবে। যিনি এখন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না।
ফারুখ বলেন, "এত বছর পর আমি বুঝতে পারি যে, আমার বাবা আমার জন্য ভালোই চেয়েছিলেন। লেখাপড়া করে স্কুলে গেলে হয়তো সফল হতে পারতাম। কিন্তু এই স্টেশন এখন আমার বাড়ি। আর এখানকার লোকেরা আমার সহকর্মী। আমি এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার কথা এখন আর ভাবতে পারি না।"
কমলাপুর রেলস্টেশনে ফারুখের মতো আরও প্রায় ২৪৯ জন কুলি রয়েছে। যাদের বেশিরভাগের গল্পই একইরকম।
কুলিদের কেউ স্কুল বা মাদ্রাসায় যাতে না যেতে হয় তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আবার কেউবা তাদের বাবা বা বড় ভাইদের দেখাদেখি এই কাজে যুক্ত হয়েছেন।
কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলিরা মোটাদাগে তিন ভাগে কাজ করেন। একদল ইনওয়ার্ড সেকশনে, আরেকদল পার্সেল সেকশনে আর বাকিরা ট্রেনের যাত্রীরা যেখানে ওঠা-নামা করে সেখানে।
সবচেয়ে অভিজ্ঞ কুলিরা ইনওয়ার্ড আর পার্সেল সেকশনে কাজ করে। আর তুলনামূলক কম অভিজ্ঞরা ট্রেনের যাত্রীরা যেখানে নামে সেখানে কাজ করেন।
পার্সেল সেকশনের কুলিরা ঢাকা থেকে সারাদেশে পণ্য পাঠানোর কাজ করেন। আর ইনওয়ার্ড সেকশনের কুলিরা পুরো বাংলাদেশ থেকে ঢাকায় আসা পণ্য নিয়ে কাজ করেন।
পার্সেল ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার মোঃ আশরাফুল ইসলামের তথ্যমতে, বর্তমানে কমলাপুর রেলস্টেশনের পার্সেল সেকশনে ৪০ জন ও ইনওয়ার্ড সেকশনে ১৫ জন কুলি রয়েছে। আর বাকিরা প্রতিদিন যাতায়াত করা যাত্রীদের লাগেজ আনা নেওয়ার দায়িত্বে থাকেন। এক্ষেত্রে পার্সেল ও ইনওয়ার্ড সেকশনের কুলিরা ভারী মালপত্রগুলো লোড-আনলোডের দায়িত্বে থাকেন।
কমলাপুর কুলিদের নেতা মোঃ মোবারক বলেন, "আজকাল বেশিরভাগ আসবাবপত্র রেলওয়ে পার্সেল বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো হয়। যা খুব বেশি নয়। ইনওয়ার্ড সেকশনে ডেলিভারির সংখ্যা আরও কম। একটা সময় ছিল যখন একজন ইনওয়ার্ড কুলি দিনে ৪৫০-৫০০ টাকা আয় করত। কিন্তু বর্তমানে তা ২০০ টাকা বা তারও কমে নেমে এসেছে।"
তবে ঈদ, পূজা ও অন্যান্য ছুটির মৌসুমে কুলিরা তুলনামূলক বেশি উপার্জন করে। কারণ তখন তুলনামূলক বেশি লোক ট্রেনে ভ্রমণ করে। এছাড়াও গ্রীষ্মকালে যাত্রীরা আম, লিচু ও অন্যান্য মৌসুমি ফল আনা-নেওয়া করলে এবং শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমে কুলিদের আয় বেড়ে যায়।
যাত্রীদের কুলি হিসেবে কাজ করা মোঃ ইসমাইল বলেন, "আগে চামড়া ও স্টিলের ট্রাঙ্ক দিয়ে লাগেজ তৈরি করা হতো। আজকাল বেশিরভাগ লাগেজের সাথে চাকা লাগানো থাকে। সুতরাং যাত্রীদের তা বহন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় না।"
বেশিরভাগ কুলি ও শ্রমিকরা রাতে স্টেশনের ভেতরে থাকে। ৮ নং প্ল্যাটফর্মে একটি ক্যান্টিন রয়েছে। সেখানে তারা ৬০ টাকায় মোটামুটি মানের খাবার পেয়ে থাকেন। খাবারের মধ্যে থাকে ভাত, ডাল, সবজি ও এক টুকরো মাছ।
কিশোর থেকে শ্রমিক নেতা
মোবারকের বয়স যখন চার বছর তখন তার বাবাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করা হয়। তার বড় ভাই ঢাকায় দিন মজুরের কাজ করতেন। তার দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় মোবারক ১৯৭৮ সালে ঢাকায় চলে আসেন ও কমলাপুর রেলস্টেশনে কাজ শুরু করেন।
মোবারক বলেন, "আমরা যাত্রীদের কাছে টাকার জন্য গেলে মাঝেমধ্যে পুলিশ আমাদের মারধর করত। আমি আজও সেই লাঠির কালো ছোপ দাগ দেখাতে পারবো।"
গত ৪৬ বছর ধরে মোবারক কখনও অন্য কিছু করার বা অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেননি। এই স্টেশনেই তিনি থাকছেন।
কিন্তু এত বছরে স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অনেক কিছুই বদলে গেছে। আগে এখানে শুধু শহরতলী প্ল্যাটফর্ম ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আরও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে এবং এগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করতে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
মোবারক বলেন, "তবে ইনওয়ার্ড ও পার্সেল গোডাউন এখনো আগের মতোই রয়েছে। এগুলোর দেয়াল, মেঝের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিছুদিন আগেও গোডাউনগুলো প্যাকেজ ও পার্সেলে ভর্তি ছিল। এখন এখানে সেখানে কিছু প্যাকেজ বাদে জায়গাটি প্রায় খালি।"
মোবারক আরও বলেন, "একজন গ্রাহককে দেখেই আমাদের বুঝতে হয় যে, সে আমাদের বকশিশ দেবে কি-না। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল। আমরা যাত্রীদের ধরতে ও তাদের মানাতে যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়ে যেতাম। যাতে আমরা তাদের লাগেজ বহন করতে পারি। এভাবেই আমরা জীবন পার করেছি।"
যদিও কয়েক বছর ধরে কিছু কুলি স্টেশন ছেড়ে গেছে। কিন্তু মোবারক তা করেননি। স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে এখানকার আশেপাশের সবাই তাকে চেনেন।
মোবারক বলেন, "যদিও আমার বয়স ৫০ বছর, তবে আমাকে দেখতে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মনে হয়। আমার ইতিমধ্যে একবার হার্ট সার্জারি হয়েছে। ভারী প্যাকেজ বহন করতে করতে আপনার শক্তি ও যৌবন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে সবাই আমাকে চেনে; এমনকি স্টেশন মাস্টাররাও। তাই তারা সবাই আমাকে কুলি নেতা বা সর্দার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
দৈনিক মজুরি যেভাবে ভাগ করা হয়
কুলিদের প্যাকেজ ও লাগেজের ওজন অনুযায়ী অর্থ প্রদান করা হয়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কুলিদের মূল্য তালিকার একটি চার্ট রয়েছে।
চার্ট অনুযায়ী, ২৮ কেজির নিচে লাগেজের চার্জ ১৫ টাকা থেকে শুরু হয়। সর্বোচ্চ ৫৬ কেজির লাগেজ ৩৫ টাকা পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়।
মোঃ রায়হান নামের এক যাত্রী বলেন, "কুলিরা চার্ট অনুসরণ করে না। কখনও কখনও কুলিরা ১০০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ দাবি করে। এরচেয়ে রেলওয়ে থেকে দেওয়া ৩০ টাকায় ট্রলি দিয়ে নিজের লাগেজ বহন করা ভালো।"
তবে কুলি সর্দার মোবারকের অবশ্য এমন পরিস্থিতি নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন, "অনেক সময় যাত্রীরা কুলিদের খুশি হয়েই একটু বেশি টাকা দেন। আসলে যখন ভিআইপি ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা ভ্রমণ করেন তখন তারা আমাদের খুশিমনেই অতিরিক্ত টিপস দিয়ে থাকেন।"
ইনওয়ার্ড ও পার্সেল বিভাগে একজন কুলি প্রতিটি ভারী প্যাকেজে ২০ থেকে ৩০ টাকা পায়। দিনশেষে তাদের মজুরি গণনা করা হয় এবং মোট পরিমাণটি ৫৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ভাগ করা হয়।
মোবারক বলেন, "তাদের সর্দার হিসাবে আমি দুটি ভাগ (অংশ) পাই। আর অন্যরা একটি ভাগ পায়।"
সাধারণ যাত্রীদের মালামাল পরিবহণ করা কুলিদের তাদের আয় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে হয় না। যদিও এর একটি নির্দিষ্ট অংশ সর্দারের কাছে যায়।