ক্ষুদ্র পতঙ্গের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার রহস্য কী?
ছোট প্রাণীরা সাধারণত খুব বেশিদিন বাঁচে না। সবসময়ই তারা অন্য প্রাণীর খাবার হয়ে যাওয়ার ভয়ে দিন কাটায়। এ কারণে পৃথিবীতে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজেদের জিন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রেখে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো জীবদ্দশার প্রথমদিকেই যতো দ্রুত সম্ভব বেশি সন্তান জন্ম দেওয়া। পোকা-মাকড়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বেশি খাটে। বেঁচেই থাকে মাত্র কয়েকদিন, সপ্তাহ বা মাস। তবে সিকাডাসের মতো কিছু ব্যতিক্রমী পতঙ্গও আছে।
অন্যদিকে, মানুষ বা হাতির মতো প্রাণীরা জীবদ্দশায় অল্প সন্তানের জন দেয়। বেশ কয়েক দশক বেঁচে থাকে, দেহের আকার আর জীবনধারণের কারণে পর্যাপ্ত সুরক্ষা মেলায় সময়ও পাওয়া যায় অনেক।
সন্তান জন্মদান আর এই পুরো প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনা বেশ কষ্টসাধ্য হওয়ায় প্রাণীরা দুটি একসঙ্গে সামলাতে পারে না। একারণে, একটি প্রাণীর সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ার যতো শক্তি আর পুষ্টি খরচ হয়, সম্ভবত তার জীবদ্দশাও ততো ছোট হয়ে আসবে।
তবে, পিঁপড়া, মৌমাছি, ভিমরুল আর উইপোকার মতো সামাজিক পতঙ্গের কলোনির রানিরা নিজেদের দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার উপায় খুঁজে নিয়েছে।
অনেক কলোনিতে যে সব রানিরা দিনে শতশত ডিম পাড়ে তারা কয়েক বছর এমনকি দশক পর্যন্তও বেঁচে থাকতে পারে। অন্যদিকে শ্রমিক পতঙ্গরা কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যায়। এই প্রজাতিগুলো এমন এক উপায় খুঁজে পেয়েছে যার মাধ্যমে তাদের প্রজাতির কিছু সদস্যকে অগুনতি সন্তান জন্মদানের জন্য দ্রুতই পৃথিবী ছাড়তে হয় না। এসব প্রাণীগুলোর মধ্যে কীভাবে এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে কয়েক বছর আগে জীববিজ্ঞানীদের একদল গবেষণা শুরু করেন।
শ্রমিক পতঙ্গদের তুলনায় রানিদের জীবদ্দশা বেশি হওয়ার বিষয়টি জেনেটিক কোডের পার্থক্যের মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। সব শ্রমিক পতঙ্গই রানির মেয়ে, অনেক ক্ষেত্রে রানির মেয়েদেরই কেউ বড় হয়ে নিজেরা রানি হয়ে যায়।
জেনেটিক্যালি এত কাছের সম্পর্কের হওয়ার কারণেই রানি আর তার সন্তানদের পরিচর্যায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বাকিরা। রানির নিরাপত্তা, বাসস্থান রক্ষণাবেক্ষণ আর খাবারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে শ্রমিক পতঙ্গদের নিজেদের জিন ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও হয়ে যায়।
কলোনিতে শুধু রানি ডিম পাড়ায়, যে সব কলোনির রানিরা অনেক দিন বেঁচে থাকে, সে সব কলোনী বড় হতে থাকে। এসব কলোনি থেকেই তরুণ রানি পতঙ্গদের নতুন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, বংশবিস্তারের জন্য সাথে যায় পুরুষ পতঙ্গও।
কিন্তু কীভাবে একটি প্রজাতির কিছু সদস্য বেশিদিন বেঁচে থাকার ক্ষমতাটি পায়? অন্যান্য পতঙ্গের দিকে তাকালে এর কিছু উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
দেখা গেছে, কিছু প্রজাতি পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের জীবনধারণ আর প্রজননের কোনো একদিকে পরিবর্তন আনতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফলের মাছিদের মধ্যে ড্রসোফিলা মেলানোগাস্টার পরিমিত খাদ্যাভ্যাসে থাকলে তাদের আয়ুষ্কাল বেড়ে যায়, কিন্তু ডিম পাড়ার সংখ্যা কমে আসে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অ্যামিনো এসিড আর কার্বোহাইড্রেটের মতো উপাদানের উপস্থিতি টের পায় এমন জিনের নেটওয়ার্কই এই প্রভাবের জন্য দায়ী। খাদ্যের অভাব তৈরি হলে এই নেটওয়ার্ক সেই সিগন্যাল পাঠিয়ে দেয়। এর প্রভাবে প্রজনন দেরিতে হয়, উল্টোদিকে আয়ুষ্কাল বেড়ে যায়। কিছু বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, নিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি টের পায় এরকম প্রধান কিছু জিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও মাছিদের জীবদ্দশা বেড়ে যেতে পারে।
ফলের মাছিদের এই প্রবণতা নির্দেশ করে, কতো দ্রুত কোনো প্রাণী মারা যাবে তা একেবারেই অপরিবর্তনীয় না। সর্বোত্তম উপায়ে সহজলভ্য রিসোর্স ব্যবহার করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এর পরিবর্তন আসতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্রিবোর্গের এভোলিউশনারি বায়োলজিস্ট থমাস ফ্ল্যাট বলেন, বার্ধক্যজনিত পুরো পদ্ধতির আলোচনায় আমরা শুধু যে সব দিক খারাপের দিকে যায় তা নিয়েই কথা বলি। আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই, এর অন্য একটি দিকও আছে। যে সব অবনতির মাধ্যমে প্রাণীরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় সেটি।
সামাজিক পতঙ্গরা হয়তো আয়ুষ্কাল বাড়াতে ওই মাছিটির মতো একই জিন ব্যবহার করেছে। তবে তা শুধু রানিদের ক্ষেত্রেই । এসব পতঙ্গের রানিদের জীবদ্দশা পর্যবেক্ষণও বেশ কঠিন। কারণ প্রতি কলোনিতে মাত্র একটি রানি থাকে। তাদের বয়স হতে কয়েক বছর, অনেক সময় দশকেরও বেশি সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে গবেষকরা রানিকে সরিয়ে নিলে প্রতিক্রিয়ায় অনেক শ্রমিক পতঙ্গ আবার নিজেরা ডিম দেওয়া শুরু করে। এর মাধ্যমে শ্রমিকরা রানি হয়ে যায় না, কিন্তু পরীক্ষা-নীরীক্ষা করে দেখা গেছে, শ্রমিক পতঙ্গরা এর মাধ্যমে রানি পতঙ্গের মতো স্বাস্থ্যগত সুবিধা পেয়ে যায়।
২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা গ্রিনসবোরোর গবেষকরা দেখেছেন নিজেদের প্রজনন ক্ষমতা চালু করা শ্রমিক মৌমাছিদের মরণঘাতী সংক্রামক ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
তিনটি পিঁপড়ার প্রজাতিতে একই জিনিস লক্ষ্য করেছেন জার্মানির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। দুটি প্রজাতির থেকে রানি পিঁপড়া সরিয়ে নেওয়ার পর তাদের মধ্যে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের প্রতিরোধ বেড়ে যায়। এর মধ্যে একটি প্রজাতির শ্রমিক পিঁপড়ারা নিজেদের ডিম্বাশয় সক্রিয় করে তোলে। অন্য প্রজাতির পিঁপড়ারা আবার এটি করেনি। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবদ্দশা বেড়ে যাওয়ায় আরেকটি রানি গড়ে তোলার বেশি সময় পাবে বলে যুক্তি দেন জার্মানির ইয়োহানেস গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি অব মাইনের ইভোল্যুশনারি বায়োলজিস্ট রোমেইন লিব্রেক।
উইপোকাদের একটি প্রজাতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ফ্রেইবার্গের ইভোল্যুশনারি বায়োলজিস্ট জুরিথ করবের করা গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রিপ্টোতারমেস সেকুন্দাস নামের উইপোকা কখনো তাদের বাসস্থান ছেড়ে যায় না। মৃত গাছের মধ্যে গর্ত করে বাসা বানায় পোকাটি। একারণে প্রজাতিটির শ্রমিকদের কাজও বেশি না। তাদের প্রজননের ক্ষমতাও থাকে। খাদ্য সংকট হলে অন্যত্র গিয়ে নিজেদের কলোনি গড়তেও প্রস্তুত থাকে তারা।
গবেষক করব আর তার সহকর্মীরা দেখতে পান, শ্রমিক পোকারা যখন কম বয়সে প্রজনন করে না, সে সময় যে জিন অক্সিডেটিভ ড্যামেজ মোকাবিলা করে সেটি বেশি সক্রিয় থাকে। বয়স বাড়লেই এ ধরনের জিনের সক্ষমতা কমে আসে।
এ প্রজাতির পতঙ্গের শ্রমিকরা কয়েক বছর বেঁচে থাকতে পারে। রাজা-রানিরা এক দশকের বেশি সময় বেঁচে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ উইপোকা প্রজাতির সামাজিক কাঠামো আরও জটিল। শ্রমিকরা কখনোই ডিম পাড়তে পারে না। এসব ক্ষেত্রেই রানি আর শ্রমিক পতঙ্গদের জীবদ্দশায় বিরাট পার্থক্য দেখা যায়।
সামাজিক পতঙ্গদের মধ্যে রানিরা কেন বেশিদিন বেঁচে থাকে তা নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে করব, লিব্রেক আর ফ্ল্যাটসহ একদল গবেষক উইপোকা, পিঁপড়া আর মৌমাছির বিভিন্ন জিনের তুলনা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিটি প্রাণীর ২টি প্রজাতির ১৫৭টি পোকা নিয়ে গবেষণা করেন তারা।
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজননে ভূমিকা রাখে এমন জিনগুলো কাজের প্যাটার্ন রানি আর শ্রমিক পতঙ্গদের মধ্যে আলাদা। ভিটেলোজেনিনস নামের প্রোটিন উপাদানের সংকেত বহনকারী জিনগুলো সব প্রজাতির রানিদের মধ্যে উপস্থিত ছিল।
ভিটেলোজেনিনসের প্রধান কাজ ডিম তৈরিতে ভূমিকা রাখা। কিন্তু, কিছু বিজ্ঞানীর মতে, এর আরও গুরূত্বপূর্ণ কাজ আছে। মৌমাছিদের নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে।
গবেষক দল আরও দেখতে পান, অক্সিডেটিভ ড্যামেজ প্রতিরোধ বা এ ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যে জিন কাজ করে, রানি বা ডিম দেয় এমন শ্রমিক আর শ্রমিক পতঙ্গের মধ্যে এমন জিন আলাদাভাবে কাজ করে। তবে একেক প্রাণীতে একেক জিন এ ভূমিকার জন্য দায়ী। কারণ প্রত্যেক প্রজাতিই রানিকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়ে এ পর্যায়ে এসেছে।
গবেষকদের মতে, বার্ধক্য আর আয়ুষ্কালের প্রশ্নে বিভিন্ন প্রজাতির এই ভিন্নতার একটি অর্থ আছে। প্রাণীদের জীবনধারণ আর প্রজননে পরিবর্তন আনার কোনো স্বয়ংক্রিয় কোনো সুইচ নেই। এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। প্রতি প্রজাতির এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। একটি প্রজাতির ওপর গবেষণা চালিয়ে একারণে বাকিদের বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য বলে দিলে ভুল হবে।