সাবাংগী: আদিবাসী নারী উদ্যোক্তাদের নির্ভরতার জায়গা
পাহাড়ি নারীদের অনেকেই ছোট থেকে পরিবারের অন্যদের দেখে হাতের তৈরি নানা কারুকার্য ও কাপড় বুনতে শিখে। আদিবাসীদের ব্যবহৃত বেশিরভাগ তৈজসপত্র থেকে পরিধেয় কাপড় তারা নিজেরাই হাতে তৈরি করে থাকে। অনেকে আবার শখের এই কাজকে পেশায় পরিণত করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চাইতেন, কিন্তু তৈরিকৃত পণ্য কোথায় নিয়ে বিক্রি করবেন এবং ক্রেতা কোথা থেকে পাবেন এই চিন্তা করে তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বারবার পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল।
বর্তমানে ফেসবুকে আদিবাসী নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে 'সাবাংগী' নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে পণ্য কেনাবেচা চলছে। চাকমা ভাষায় 'সাবাংগী' শব্দের অর্থ, 'একসঙ্গে এক ছায়াতলে কাজ করা'। শব্দটিই বলে দিচ্ছে 'সাবাংগী' শুধুমাত্র একটি অনলাইন গ্রুপ না, এটির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করে যাওয়া। বর্তমানে গ্রুপটিতে ৩০০ জন নারী উদ্যোক্তা এবং সব মিলিয়ে ৩২ হাজার সদস্য যুক্ত রয়েছেন। এটিই প্রথম আদিবাসী নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া প্রথম কোন সুসংগঠিত গ্রুপ ও প্লাটফর্ম।
আদিবাসী নারী উদ্যোক্তাদের মিলনমেলা
অনলাইন গ্রুপটিতে ঢুকলেই চোখে পড়বে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে স্বত্বাধিকারীদের একদিনেই দেওয়া অর্ধশতাধিক পোস্ট। কেউ দিয়েছেন পোশাক-গয়নার ছবি, কেউবা দিয়েছেন মাস্ক ও ডিজাইন করা টি-শার্টের ছবি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে ঘিরে এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই গ্রুপটি ক্রেতা ও উদ্যোক্তাদের মাঝে বেচাকেনায় সরগম হয়েছিল। উৎসবের জন্য দ্রুত ক্রেতাদের নিকট পণ্য পৌঁছে দিতে উদ্যোক্তারা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে বাঙালিরাও 'সাবাংগী' গ্রুপ থেকে নিজেদের পছন্দের পোশাক কিনেছেন। 'সাবাংগীর' ক্রেতাদের বিশাল একটা অংশই বাঙালি। হাতে বোনা পোশাকগুলোকে প্রকৃতির চিত্রে সাজিয়ে তুলে বাঙালীর সংস্কৃতিকে ধারণ করা হয় বিধায় বাঙালি ক্রেতাদের কাছেও এই পোশাকের কদর রয়েছে।
এপ্রিল মাসব্যাপী চলে 'সাবাংগীর' অনলাইন ও অফলাইন মেলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক জায়গায় চলে এই মেলার আয়োজন। কিন্তু অনলাইন মেলার মাধ্যমে সারাদেশে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও 'সাবাংগীর' উদ্যোগে বেইলি রোডে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় উদ্যোক্তারা ব্যাপক সাড়া পেয়েছিল এবং তাদের আনা পণ্যের ভালো বিকিকিনি হয়েছিল। মেলায় ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করা উদ্যোক্তারা একত্রিত হয়েছিল নিজেদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে।
গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা বিপলি চাকমা বলেন, "আদিবাসী নারীদের অনেক গুণ রয়েছে, তারা হাতের কাজে বেশ পারদর্শী। এতোদিন নারীরা পরিবারের জন্য ও ঘর সাজাতে পোশাক, গয়না, ফুলদানি ইত্যাদি বানিয়ে থাকলেও, তারা ভাবতো বিক্রির উদ্দেশ্যে একসাথে একাধিক পণ্য বানাতে গেলে সংসারের কাজের চাপে সময় পাবে না। কিন্তু 'সাবাংগীর' অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের দেখে তারাও একই পথে হাঁটতে শুরু করে। আর এভাবেই আমাদের 'সাবাংগী' গ্রুপ একজন দুজন করে তিনশোর ওপরে উদ্যোক্তা নিয়ে এখন এগিয়ে যাচ্ছে।"
শুরুর গল্প
২০১৯ সালে 'সাবাংগীর' যাত্রা শুরু হয় বিপলি চাকমা ও ত্রিশিলা চাকমার হাত ধরে। বিপলি চাকমা পুরনো উদ্যোক্তা। ঢাকার মিরপুরে আদিবাসী খাবারের তার একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, তারও আগে থেকে তিনি পোশাক বিক্রি করতেন। শুরুর দিনগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে তাকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। তাই তিনি সবসময় নতুন উদ্যোক্তাদের ভোগান্তি কমিয়ে কীভাবে তাদের কাজকে সহজে এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতেন।
আদিবাসীদের রক্তদান সংগঠন 'যুদ্ধার' একটি প্রোগামে বিপলি চাকমার পরিচয় হয় ত্রিশিলার সাথে। ত্রিশিলা চাকমা তখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে টি-শার্ট ডিজাইন করতেন। তিনি চাইতেন পোশাকের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে। ত্রিশিলাও একজন উদ্যোক্তা জানার পর বিপলি চাকমা তাকে নিজের রেস্টুরেন্টের খালি জায়গায় একটি শোরুম দিয়ে ব্যবসা শুরু করার প্রস্তাব দেন। অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো আরও পাঁচজন নারীকে নিয়ে 'সাবাংগী' নামের শোরুম চালু করা হয়। ছোট পরিসরে শুরু করা হলেও ক্রেতাদের মাঝে ভালো সাড়া পেয়েছিল 'সাবাংগী'। প্রথম দিকে অনলাইনে খোলা গ্রুপটিকে উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করতেন, তখন মাত্র আটজন আদিবাসী নারী উদ্যোক্তা ছিলেন।
করোনার ধাক্কা
২০১৯ সালে বিক্রয়কেন্দ্রটি চালু করার কয়েকমাসের মাথায় করোনা মহামারি আঘাত হানলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সবকিছু বন্ধ রাখতে হয়। সে সময় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মাসিক ভাড়া, ট্যাক্স পরিশোধ করে টিকে থাকা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সেটা আরও কঠিন ছিল। করোনার কবলে পড়তে হয়েছিল 'সাবাংগী'কেও।
'সাবাংগীর' আয়ের মূল উৎস ছিল পণ্য বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থ। কিন্তু সেসময় বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হলে তাদের পক্ষে বিক্রয় ব্যতীত মাসে মাসে ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রতিষ্ঠানের ৮ জন উদ্যোক্তা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা বিক্রয়কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিবেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ৫জনের উদ্যোগতা মানসিকতা তখনো ছিল প্রখর থেকে প্রখরতর, তারা হার মানতে চায়নি।
বিপলি চাকমা ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গঠিত 'উই' গ্রুপের সাথে অনেক আগের থেকেই যুক্ত ছিলেন। গ্রুপটির কার্যক্রম দেখে তিনি ভাবলেন তাদের বিক্রয়কেন্দ্রটি যেহেতু বন্ধ হয়ে গেছে, তারাও তাদের সব কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমেই করবেন। ফলস্বরূপ তিনি তার সহকর্মী ত্রিশিলাকে তাদের প্রাইভেট গ্রুপটিকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বলেন।
বিপলি চাকমা উচ্ছ্বাসের সাথে বলেন, "আমরা গ্রুপটিকে পাবলিক করে দেওয়ার সাথে সাথেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০০ জন আমদের গ্রুপে যুক্ত হতে চেয়ে রিকোয়েস্ট পাঠালো। তারপর করোনার জন্যে সবাই যখন ঘরবন্দি সময় কাটাতে শুরু করলো, সে সময় আমাদের গ্রুপে অনেক নারী উদ্যোক্তা যুক্ত হয়ে বেচাকেনা শুরু করলেন। এভাবেই আজ আমাদের গ্রুপটি ৩২ হাজার সদস্যের পরিবার হয়ে গেছে"।
"সাবাংগীর কার্যক্রম এখন নির্দিষ্ট পরিসরে আটকে নেই। আগে যেখানে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের দূরদূরান্তে গিয়ে প্রয়োজনীয় বাজার করে আনতে হতো, এখন সেখানে সাবাংগীর কার্যক্রম চালু হওয়ার পর ডেলিভারি দেওয়ার জন্য একদল ছেলে রয়েছে। এদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল তাই তারা মোটরসাইকেল নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। তার ফলে যেটা হলো কেউ অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে পৌঁছে দেওয়া হতো ফুচকা, কেকসহ অন্যান্য সামগ্রী- যা একসময় সহজলভ্য ছিল না।"
ভবিষ্যত ভাবনা
'সাবাংগী' গ্রুপটি অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করার পরবর্তী ধাপে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিক্রয়কেন্দ্র চালু করে। ত্রিশিলা চাকমা পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত 'সাবাংগীর' বিক্রয়কেন্দ্রের দেখাশোনা ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিপলি চাকমা বলেন, "ভবিষ্যতে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে 'সাবাংগী' গ্রুপের জন্য ঢাকায় একটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা। বৈসাবি, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ উৎসব কাছাকাছি সময় অনুষ্ঠিত হবে বিধায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঈদের সময় ঢাকায় 'সাবাংগী' গ্রুপের পক্ষ থেকে মেলার আয়োজন করার। এছাড়াও অনলাইন ও রাঙামাটিতে আমাদের সাবাংগীর মেলা মাসব্যাপী চলবে"।
গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা বিপলি চাকমা ও ত্রিশিলা চাকমা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষ ও পারদর্শী করে তুলতে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন ও সহায়তা করেন। তাদের গ্রুপে সদস্য হতে ও উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রি করতে কোনরকম ফি প্রদান করতে হয় না, ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই উদ্যোক্তা হওয়ার পথে হাঁটতে পারছেন। আর এভাবেই 'সাবাংগী' হয়ে উঠেছে আদিবাসী নারী উদ্যোক্তাদের নির্ভরযোগ্য একটি প্লাটফর্ম।