অর্থায়নের অভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে জ্বালানি এবং শক্তি উৎপাদন নিয়ে একটি বিশেষ প্রস্তাবনা পৌঁছেছে। অনুমোদন মিললেই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পিছিয়ে আসবে বাংলাদেশ। পরিবেশ বিষয়ক সাইট 'দ্য থার্ড পোল' প্রস্তাবনাটি সম্পর্কে নিজস্ব সূত্রের বরাতে নিশ্চিত করে।
গত আগস্টে দেওয়া চিঠিতে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। থার্ড পোলের দেখা চিঠিটিতে; বর্তমানে পাইপলাইনে থাকা ১৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) চালিত কেন্দ্রে রূপান্তরের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
তার আগের মাসে বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রী নসরুল হামিদ এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে এব্যাপারে প্রথম ইঙ্গিত দেন।
তিনি জানান, অনুমোদন প্রাপ্ত ৩২টি কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্রের মধ্যে ২৯টির ব্যাপারে পুনঃপর্যালোচনা করে দেখা হবে। ২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে আবার বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে ১৮টি কেন্দ্র। নির্মাণাধীন কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি বাদে বাকি সবগুলো এলএনজি চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রূপদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
বাকি আছে নির্মাণের লাইসেন্স পাওয়া অন্য ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প। এগুলোর কাজ এখনও শুরু হয়নি। জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের বরাতে থার্ড পোল জানায়, আপাতত প্রকল্পগুলো অলস পড়ে আছে। এমনকি সরকার ধাপে ধাপে এগুলোর অনুমোদন বাতিল করে দিতে পারে।
কয়লা থেকে সরে আসার প্রস্তাবের পেছনে অর্থায়নের সমস্যাই প্রধান কারণ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো চিঠিটিতে তা উল্লেখ করা হয়।
জুলাই মাসেও নসরুল হামিদ জানান, ''কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র তৈরিতে অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দিক-নির্দেশনার ওপর এ রূপান্তরের বিষয়টি নির্ভর করছে।
২০১০ সালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জিকা) সহায়তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিল বাংলাদেশ সরকার। জাপান সরকারের দেওয়া তহবিল বাংলাদেশ-সহ উন্নয়নশীল নানা দেশে বিতরণের কাজ করে থাকে জিকা।
জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় যে ১৮টি কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র প্রথমেই অনুমোদন পায়, তারা দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৩৫ শতাংশ যোগান দেবে- এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সরকারি, বেসরকারি এবং যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে শক্তি উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ হচ্ছে চীন। কেন্দ্র নির্মাণেও দেশটি সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু, এখন মহাপরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্যকারী জাপান এবং বৃহৎ পুঁজি লগ্নীকারী চীন- কেউই আর কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্রে বিনিয়োগ করতে চায় না।
দেশের শক্তি উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বেশকিছু বিশেষজ্ঞ দ্য থার্ড পোলকে বড় দাতাদের এমন অনাগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সরকারি সূত্রগুলো গণমাধ্যমটিকে জানিয়েছে, যেসব কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প ইতোমধ্যেই অর্থায়ন পেয়েছে, তাদের কাজ শুরু হয়েছে এবং সেগুলো চালু করা হবে। এর বাইরে যারা অর্থায়ন পায়নি তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে।
কয়লায় যখন বাড়তি খরচ:
কয়লা আর সস্তা নয়। শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১০ সালে কম থাকলেও এখন কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশ ব্যয়বহুল। কারণ কয়লা আমদানি ও সংরক্ষণের খরচ। তাছাড়া, কয়লা রাখার জন্য বাড়তি ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়। এতে প্রকল্পের খরচ এবং বাস্তবায়নের সময় উভয়ই বাড়ে। তাছাড়া, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হওয়ায় মুনাফা হার কমে গেছে, বলে তারা দাবি করেন।
দূষণকারী জ্বালানির দর বেড়েছে বাংলাদেশে, সেই তুলনায় কমেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন খরচ।
মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি অবশ্যই কয়লার বিরুদ্ধে পরিবেশ সচেতন জনতার প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের কারণে নেওয়া হয়নি। মূল কারণ ছিল; কয়লার খরচ নিয়ে দাতাদের উদ্বেগ।
নাম গোপন রাখার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা এব্যাপারে এস আলম গ্রুপের ১,২৪৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুই ইউনিট ২০১৯ সালের নভেম্বরেই উৎপাদন শুরু করবে, এমন শর্তে সরকারি অনুমোদন পেয়েছিল। কিন্তু, এখনও অর্থায়নের অভাবে প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে পারেনি এস আলম গ্রুপ। জুলাইতে এজন্য তারা সরকারকে দুইশ' কোটি টাকা জরিমানা দেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, শক্তি উৎপাদনে সরকারের কয়লা নির্ভর বর্তমান মহাপরিকল্পনা বাস্তবসঙ্গত নয়। এবং তা আর্থিকভাবে বাস্তবায়নের অনুপযুক্ত। এমনকি নির্মাণাধীন কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে, বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এলএনজি'র দিকেই ঝুঁকছে সরকার:
কয়লা নিয়ে যখন আপত্তি, ঠিক তখন গ্যাস চালিত কেন্দ্রে অর্থায়নকারী দেশগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানিটির পড়তি দর এবং নতুন নতুন মজুদ আবিষ্কার তাদের এমন আগ্রহের কারণ। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ালে তুলনামূলক কম দূষণ হয় এবং তা অর্থায়নকারী দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করে না।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস এবং খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানকারী সংস্থা পেট্রোবাংলা'র মতে বর্তমানে দেশের চাহিদা মেটাতে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন কিউবিক ফিট এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। বিদ্যমান জ্বালানি মহাপরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ আমদানির এ পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।
- সূত্র: দ্য থার্ড পোল