ইন্টারনেট সেবা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদনের উদ্যোগ, শঙ্কায় দেশি বিনিয়োগকারীরা
ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং আন্তর্জাতিক কল টারমিনেশন খাত বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগে বাধা থাকায়, এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে নীতিমালা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
এ উদ্যোগের ফলে শঙ্কায় পড়েছেন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা, ইন্টারনেট গেটওয়ে ও আন্তর্জাতিক কল টারমিনেশন খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হলে তাদের ব্যবসা ঝুঁকির সম্মুখীন হবে এমনটাই আশঙ্কা তাদের।
তবে বিটিআরসি এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে করছে না। এ খাতে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে ও প্রবৃদ্ধি হবে এমন ইতিবাচক ফলাফলের আশাই করছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার টেলিযোগাযোগ সেবা (আইএলডিটিএস) নীতিমালা-২০০৭ অনুযায়ী বিদেশি নাগরিক ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ), জাতীয় ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স), ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) ও আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল কেবলে (আইটিসি) বিনিয়োগ করতে পারবে না।
গত বছরের অক্টোবরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে নীতিমালা সংশোধনের ব্যাপারে প্রস্তাবনা পাঠায় বিটিআরসি।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সম্মতি পাওয়ার পর বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে প্রস্তাবনাটি।
তবে এ উদ্যোগকে আসন্ন বিপদের সংকেত হিসেবে দেখছেন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন তারা ইতোমধ্যে এ খাতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছেন এবং এখনো লাভ উঠিয়ে নিতে পারেননি তারা।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি লি. (বিএসসিসিএল) এবং আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) অপারেটরদের থেকে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের কার্যকর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যস্ত আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) ওপর।
২০০৮ সাল থেকে এপর্যন্ত ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে আইআইজি লাইসেন্স দিয়েছে বিটিআরসি। এরমধ্যে বর্তমানে ৩৪টি প্রতিষ্ঠান আইআইজি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সবগুলো আইআইজি অপারেটরই বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল কেবল অপারেটরদের থেকে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে।
ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ২০২০ সালের শেষদিকে এসব অপারেটরদের সর্বোচ্চ ১,৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হয়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আইআইজি অপারেটর লেভেলথ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুনায়েদ বলেন, এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লাইসেন্স দেওয়া হলে বিদ্যমান অপারেটররা সমস্যায় পড়বেন।
"বেশিরভাগই আইআইজি অপারেটরই সীমাবদ্ধ লাইসেন্সের কারণে প্রত্যাশিত লাভ পাননি। বেশিরভাগ কোম্পানিই টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে," বলেন তিনি।
আইআইজি খাতে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়ার চেয়ে কর্তৃপক্ষ সাবমেরিন কেবলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথা ভাবতে পারে এমন পরামর্শ দেন তিনি।
"বর্তমানে আমাদে মাত্র দুটি সাবমেরিন কেবল আছে। যে কোনো কারণে একটি সাবমেরিন ক্যাবলে অকেজো হয়ে গেলেই দেশের ইন্টারনেট সিস্টেম বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে," যোগ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) খাতেও বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করার কথা ভাবছে বিটিআরসি।
বিটিসিএল সহ বর্তমানে দেশে ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটর আছে, যদিও এপর্যন্ত এ খাতে ২৯টি অপারেটরকে লাইসেন্স দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
আইজিডব্লিউ খাতের বাজারের আকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
অপারেটরদের মধ্যে শুধু বিটিসিএল, বাংলা ট্রাক কমিউনিকেশন লিমিটেড, নভোটেল লিমিটেড এবং মারটেল লিমিটেড- এ চারটি অপারেটর বাজারে অধিপত্য বিস্তার করেছে।
নভটেল লিমিটেডের ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার রিলেশনস প্রধান হাসিবুর রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অ্যাপ্লিকেশন ভিত্তিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের কারণে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও বিকাশের কারণে ইতোমধ্যে এটি ডুবতে বসা ব্যবসা খাতের তকমা পেয়ছে। একারণে এ খাতের সম্প্রসারণের সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি।
প্রত্যেক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে হয়। তবে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবারের মতো অ্যাপগুলোর কারণে আইজিডব্লিউ খাত ইতোমধ্যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।
বিটিআরসি'র তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল ছিল মোট ৮৪.৮ কোটি মিনিট, ২০২০ সালের জুনে এসে তা কমে ৭১ কোটি মিনিটে দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালে জুলাইতে মোট আন্তর্জাতিক আউটগোয়িং কলের পরিমাণ ছিল ০.৯৪ কোটি মিনিট, যা ২০২০ সালের জুনে কমে ০.৬৫ তে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ কল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ২৬টি আইসিএক্স অপাএরটরদের ব্যবসায়ও ধস নেমেছে।
তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানিয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করে এমন জাতীয় বিনিয়োগ নীতিমালার আওতায়ই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
"জাতীয় বিনিয়োগ নীতিমালার আলোকে গাইডলাইন তৈরি করাই আমাদের দায়িত্ব।টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের বিদ্যমান গাইডলাইন জাতীয় নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় আমরা এটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি," বলেন মোস্তফা জব্বার।
"এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি না দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। পৃথিবী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। প্রতিযোগিতায় জিতেই কোম্পানিগুলোকে টিকে থাকতে হবে। সুরক্ষাবাদ পৃথিবীর কোথাও কাজ করেনি," যোগ করেন তিনি।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশই কীভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায় সে চিন্তা করে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
বিদেশি বিনিয়োগের ইতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারে তিনি বলেন, "বেশিরভাগ বিশ্বখ্যাত মোবাইল ব্র্যান্ডগুলো বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল সেট উৎপাদন করছে। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।"