করোনা চিকিৎসায় নিয়ম না মেনেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার
গত বছরের এপ্রিলে কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউ এবং এই বছরের জুলাই-আগস্টে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যেসকল গুরুতর রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের বেশিরভাগের দেহেই তীব্র জ্বর এবং ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়। এ অবস্থায় তাদের চিকিৎসায় কোনো ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন না মেনেই অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছে চিকিৎসকেরা। দেশে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৮০ শতাংশই অ্যান্টিবায়োটিকই অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতে একটি গবেষনা চালায় মুগদা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধের ৭০ শতাংশই ছিল অ্যান্টিবায়োটিক। আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ।
এছাড়াও হাসপাতালে ভর্তির আগে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন ৩৩ শতাংশ রোগী। হাসপাতালে ভর্তি না হলেও মাইল্ড ও মিডিয়াম লক্ষণে ভোগা অনেক রোগীও অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেছেন। এছাড়া ওষুধের দোকান থেকে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওষুধের নাম দেখে বাসায় চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের হার অনেক বেশি। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার না কমলে করোনার মতো আরেকটি মহামারির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান এবং গবেষক ড. রুবিনা ইয়াসমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন,"৮০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলেও হতো। হাসপাতালে ভর্তি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন ছিলো কারণ তাদের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছিলো। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীকে একটি বা দুটি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে।"
তবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড বিষয়ক ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত জাতীয় নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে সেকেন্ডারি ইনফেকশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবেনা।
নির্দেশিকা অনুসারে, সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক (অ্যামোক্সিসিলিন এবং ক্লাভুল্যানিক অ্যাসিড) শুধুমাত্র পরামর্শদাতার বিবেচনার ভিত্তিতে এবং সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলেই প্রেসক্রাইব করা উচিত। গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে অর্থাৎ, সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা যেতে পারে। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এ গাইডলাইন মেনে চলা হয়নি।
ড. রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, "কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত সবাইকে অনলাইনে ট্রিটমেন্ট গাইডলাইনের ওপর ট্রেনিং দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা কতটা মেনে চলা হয়েছে সেটি ফলো করা হয়নি। আমাদের দেশে প্রেসক্রিপশন লেখার ক্ষেত্রে কখনোই স্ট্রিক্ট গাইডলাইন মানা হয়না, তাই কোভিড চিকিৎসায়ও কালচার না করে, বা রোগীর ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন আছে কিনা তা যাচাই না করে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে।"
গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পার্টনারশিপের বাংলাদেশ বিভাগের ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশে যক্ষা ছাড়া আর কোন চিকিৎসায় ট্রিটমেন্ট প্রোটকল মানা হয়না। কোভিড নতুন রোগ হওয়ায় প্রোটোকল মানার চেয়ে রোগীর জীবন বাঁচানোর দিকে চিকিৎসকেরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে কোভিডে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩ থেকে ৬ শতাংশ রোগী। বাকী ৯০ শতাংশ রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছে।"
"বাংলাদেশে গত দুই বছরে অ্যাজিথ্রোমাইসিন নেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পরবর্তী স্বাস্থ্য সংকট হতে চলেছে,"বলেন তিনি।
এদিকে হাসপাতালগুলোতে ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল মেনে চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়টি শিকার করেছেন ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন কমিটির বোর্ড মেম্বার এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, "আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু অনেক জায়গায় প্রোটকল ঠিকমত মানা হয়নি। কোভিড নতুন রোগ হওয়ায় এ রোগ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কনফিডেন্সের অভাবে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে।"
হাসপাতালে ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটির অভাব
কোনো কোভিড রোগীর ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছে কিনা তা কালচার করে দেখে তারপর অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতালে কালচার করার জন্য ল্যাবরেটরি সুবিধা নেই। সে কারণে চিকিৎসকেরা রোগীর ফুসফুসে ইনফেকশন দেখার পরই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে।
ড. রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, "মুগদা হাসপাতালে ল্যাবরেটরিতে কালচার করার সুবিধা নেই। কোভিড রোগীকে বাইরে পাঠিয়ে কালচার করে আনারও উপায় ছিলোনা তাই অপ্রয়োজনেও অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে।"
অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি কোথায়?
কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের যার যেমন মেডিকেল নলেজ, সে সেভাবেই এটি ব্যবহার করেছে। কোন নির্দিস্ট অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি না থাকায় অপ্রোজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে।
রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, "আবার কোভিডের আউটেব্রক আসার আগেই অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি তৈরি করতে হবে এবং তা যাতে সবাই মেনে চলে সেটি তদারকি করতে হবে।"
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, "এখন সংক্রমণ কম থাকায় এই সময় ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটি উন্নত করতে হবে, যাতে কোভিড বাড়লে কালচার করে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায়। এছাড়া চিকিৎসক ও রোগী সবার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।
আহমেদুল কবির বলেন,"অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ন্যাশনাল গাইডলাইন তৈরির কাজ চলছে। আবার কোভিড সংক্রমণ বাড়লে সেই গাইডলাইন যেনো ফলো করা হয় সে বিষয়ে এবার তদারকি করা হবে।"