দুই সিটির কমিউনিটি সেন্টারের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না নগরবাসী
ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের কমিউনিটি সেন্টারগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না নগরবাসী। প্রায় অর্ধেক কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজে কিংবা সংস্কারের অভাবে নগরবাসী ব্যবহার করতে পারছে না।
কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে নগরবাসীরা অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতেন কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এবং ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে প্রাইভেট কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে তাদের অনুষ্ঠানের কার্যক্রম সারছেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন কমিউনিটি সেন্টারগুলো মেরামত না করে এবং বিভিন্ন সংস্থার কাছে ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে নগরবাসীর অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে এবং এভাবে কোনো সংস্থার দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া দেওয়ার অধিকার সিটি কর্পোরেশনের নেই।
বিয়ে, ওয়ার্ড পর্যায়ে সমাজকল্যাণ, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদনমূলক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ভাড়া দিতে নগরীতে কমিউনিটি সেন্টারগুলো নির্মিত হলেও মূল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৬টি কমিউনিটি সেন্টারের মধ্যে অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের জন্য যে উদ্দেশ্যে সেন্টারগুলো তৈরী করা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে ধারণা নগর পরিকল্পনাবিদদের।
এর মধ্যে আবার ৮টি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ২৮টির মধ্যে ১০টি ঝুকিপূর্ণ থাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে না, ৫ টি সংস্কার করা হয়েছে। বাকি ১৩টির মধ্যে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও মাঝে মাঝে মানুষ ভাড়া নিয়ে বিয়ে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করছে।
আজিমপুরের বাসিন্দা সোহরাব উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের বিয়ে কিংবা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য চড়া মূল্যে প্রাইভেট কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে হয়। যেখানে আমাদের আশপাশের সিটি কর্পোরেশনের সবগুলো কমিউনিটি সেন্টারই ব্যবহার অনুপযোগী'।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাসিমা খানম লকডাউনের আগে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে বুকিং না পেয়ে স্থানীয় একটি প্রাইভেট কমিউনিটি সেন্টারে তার মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেন। এতে তার সেন্টারের ভাড়া বাবদই প্রায় দেড় লাখ টাকা দিতে হয়।
নাসিমা খানম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আশেপাশে ডিএনসিসির সূচনা কমিউনিটি সেন্টারটিই ভালো আছে তবে মানুষের চাহিদা থাকায় এবং এটির ভাড়া কম হওয়ায় আমাদের ভোগান্তি হয়। বাধ্য হয়ে প্রাইভেটগুলোতে অনুষ্ঠান করতে হয়। এ সমস্যা সমাধানে মেয়র আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো সমাধান নেই'।
অধিকাংশ কমিউনিটি সেন্টারের ভবনগুলো পুরাতন হওয়ায় ব্যবহার অনুযোযোগী হয়ে পড়েছে। অঞ্চলভিত্তিক ডিএসসিসিতে অঞ্চল-১ এ ২টি, অঞ্চল-২ এ ৬টি, অঞ্চল-৩ এ ১২টি, অঞ্চল-৪ ও ৫ এ ৮টি করে কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারগুলোর মধ্যে ৭টি তে এসির ব্যবস্থা থাকলেও সবগুলোই অচল রয়েছে।
ডিএসসিসি'র অঞ্চল-২ এর কমিউনিটি সেন্টারগুলোর কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা মাসুদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারটি কিছুদিন সংস্কার হওয়ার কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮টি অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও বৈদ্যুতিক পাখা, লাইটে সমস্যা রয়েই গেছে। বাকিগুলো মাসে ৫-৮টি অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া হয়েছিল। কোনটিরই অবস্থা ভালো না'।
ডিএসসিসি'র অঞ্চল-৩ এর কমিউনিটি সেন্টারগুলোর কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা সাজেদুল করিম টিবিএসকে বলেন, নবাবগঞ্জ সাত শহীদ কমিউনিটি সেন্টার সংস্কার হওয়ায় মানুষ ভাড়া নিতে আগ্রহী হচ্ছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা তেমন হচ্ছে না। ফেব্রুয়ারিতে ২৫টি অনুষ্ঠান হয়েছে এ সেন্টারে। বাকিগুলোর মধ্যে ২/৩ টি তে ৫-৭টি করে অনুষ্ঠান হয় মাসে।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী ডিএসসিসি'র নিজস্ব অর্থায়নে ২ কোটি টাকা এবং প্রকল্প সহায়তায় ২৫৮.০৭ কোটি টাকার মোট ২৬০.০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
গত চার অর্থ বছরে এ অর্থবছরই সর্বোচ্চ বাজেট রাখা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ও সংস্কারে। কিন্তু অর্থবছর শেষ হয়ে গেলেও কমিউনিটি সেন্টারগুলোর চেহারায় পরিবর্তন আসেনি।
গত ৪ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী ডিএসসিসির কমিউনিটি সেন্টার মেরামত ও নতুন করে তৈরি বাবদ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল, ২০১৯-২০ এ ১৩০.৫ কোটি, ২০১৮-১৯ এ ৩৭ কোটি, ২০১৭-১৮ এ ১২ কোটি এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্ধ ছিল ৩৫ কোটি টাকা।
গত ৫ অর্থবছরে ৪৭৪.৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তেমন কোনো কাজ দৃশ্যমান হয়নি কমিউনিটি সেন্টার সংস্কার কিংবা নির্মাণে।
ডিএসসিসি'র কমিউনিটি সেন্টারগুলো থেকে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রায় ২ কোটি ৯ লাখ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা আয় করে।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে ১৩টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি সেন্টার মেরামত এবং সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের কাজে ব্যবহার হওয়ায় ৮টি কমিউনিটি সেন্টার থেকে নাগরিকগণ কতৃক সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে।
ডিএনসিসির ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে কমিউনিটি সেন্টার মেরামত বাবদ বাজেট ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা।
ডিএনসিসি'র ৫ নং অঞ্চলের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার ও মরহুম আব্দুল হালিম কমিউনিটি সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আব্দুল হাই তালুকদার টিবিএসকে বলেন, 'করোনার কারণে বর্তমানে সবগুলো কমিউনিটি সেন্টারই বন্ধ আছে। এর মধ্যে সূচনা কমিউনিটি সেন্টার একটি স্ট্যান্ডার্ড মানে এসেছে তবে মরহুম আব্দুল হালিম কমিউনিটি সেন্টারের সংস্কার প্রয়োজন'।
ডিএনসিসির প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান টিবিএসকে বলেন, 'করোনার কারণে আমাদের কমিউনিটি সেন্টারের বুকিং বন্ধ রেখেছি আমরা। আমাদের ২টি সেন্টার বন্ধ আছে আর ৩টি র্যাবের কাছে ভাড়া দেওয়া আছে'।
২০২০ এর জুলাই মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত (৯ মাসে) ৯টি কমিউনিটি সেন্টার থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা। এ আয়ের পরিমাণ আরও বেশি হতো যদি লকডাউন না থাকতো। ডিএনসিসির সচল সবগুলো কমিউনিটি সেন্টারই মানুষ স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করছে।
নগরবাসীর অধিকার ক্ষুণ্ণ করে কমিউনিটি সেন্টারগুলো সরকারী সংস্থা কিংবা সিটি কর্পোরেশনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা কতটুকু যুক্তিসংগত এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসির এ কর্মকর্তা বলেন, 'সরকারী সিদ্ধান্ত আছে বলেই আমাদের এ সেন্টারগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অন্য কাউকে তো দেওয়া হয়নি, র্যাবকেই দেওয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। ঐ কমিউনিটি সেন্টারগুলোর আশপাশে আরও সেন্টার রয়েছে সেগুলো চাইলে তো ব্যবহার করতে পারে'।
থানা-পুলিশ, র্যাব কিংবা রাজস্ব বিভাগের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সে জন্য সিটি করপোরেশনের কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহার করা যৌক্তিক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসির প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'গত এক বছরে নতুন করে কোনো কমিউনিটি সেন্টার কোনো সংস্থার কাছে ভাড়া দেওয়া হয়নি। আগে ভাড়া দেওয়া ছিল সেভাবেই চলছে আর এগুলোও তো সরকারের সেবাদানকারী সংস্থা। এখানে উর্ধ্বতন মহল থেকে নির্দেশনা আছে বলেই ভাড়া দেওয়া হয়েছে'।
তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিকল্প স্থান নির্বাচনের চন্য ডিএসসিসি মেয়রের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) মহাসচিব আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের কমিউনিটি সেন্টারগুলো নগরবাসীদের ব্যবহার তাদের অধিকার, সেক্ষেত্রে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া একেবারেই অযৌক্তিক। এতে নগরবাসীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছ। এছাড়া যেসব কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহার অনুপযোগী রয়েছে সেগুলোকে দ্রুত সংস্কার করা জরুরি'।
'কমিউনিটি ভিত্তিক কর্মকান্ড আমাদের সমাজ থেকে মোটামুটি উঠেই গিয়েছে। আমরা কমিউনিটি সেন্টার বলতেই বুঝি বিয়ে কিংবা কোনো অনুষ্ঠান। আসলে এখানে সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠান করার মতো সুযোগ থাকতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যাতে সবাই অনুষ্ঠান করতে পারে সেই সুযোগ রাখতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশনের টাকা আয়ের ব্যবস্থা না করে কিভাবে এলাকাবাসীকে একত্র করা যায় সেদিকে খেয়াল দেওয়া উচিত'।
কমিউনিটি সেন্টারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের জন্য স্ব স্ব এলাকার সকল শ্রেনীর মানুষের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়ারও আহবান জানান এ নগর পরিকল্পনাবিদ।
ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, 'আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডেই একটি করে সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। পাঁচ তলাবিশিষ্ট নতুন আরও ৪৩টি সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করে আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। সে সকল সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রের মধ্যেই আমাদের কাউন্সিলরদের কার্যালয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, ব্যায়ামাগার, পাঠাগার সুবিধা থাকবে। যাতে করে ঢাকাবাসী একটি কেন্দ্র থেকেই তাদের সেবাগুলো পেতে পারেন'।