দূষণকারীকেই জরিমানা দিতে হবে: নতুন নীতিমালা আসছে
শিল্পখাতের পানি ব্যবহার ও লাগামহীন পরিবেশ দূষণ কমাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত বর্জ্য পানির জন্য অর্থ পরিশোধ ও পরিবেশগত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ নীতিমালা অনুযায়ী শিল্পখাতে পানি দূষণ কমাতে পানি ব্যবহারের রূপরেখা নির্ধারণ করে দেয়া হবে এবং শিল্পখাতে বিদ্যমান শুল্ক ছাড়াও পানি ও বর্জ্য পানি শুল্ক আরোপের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সেইসাথে শিল্পখাতের কর্মকান্ডের জন্য পরিবেশ দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে 'দূষণকারীর জরিমানা' আরোপের প্রস্তাবনা রাখা হয়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়য়ের পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) প্রণীত এ খসড়া অনুযায়ী, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়ের বিবেচনায় শিল্প খাতে পানির মূল্য নির্ধারন করে দেয়ার প্রস্তাবনা রাখা হয়।
'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াটার ইউজ পলিসি' শীর্ষক এ নীতিমালার মন্ত্রনালয়ের সম্মতি পেয়েছে এবং শীঘ্রই অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় পেশ করা হবে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত পানির কারণে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার মতো আরও অনেক নদী আজ হুমকির মুখে। নদীর দূষিত পানির কারনে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্যও। এর প্রেক্ষিতে সরকার প্রথম বারের মতো শিল্পখাতে পানি ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, ফ্যাক্টরিগুলো কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পানি ব্যবহার করছে। দুর্বল পরিকল্পনা ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়তই পানি বর্জ্য ও দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিল্প খাতে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, পানি দূষণ কমিয়ে আনা ও নীতিমালা পালনে কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা- এ তিনটি বিষয়ের ওপর কেন্দ্র করে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ারপো।
ওয়ারপো'র পরিচালক মো আলমগীর হোসেন জানান, শিল্পখাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির সরবরাহ বজায় রাখার জন্য পানি সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ওয়ারপোর কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, পানি সম্পদ অফুরন্ত নয়। এর সংরক্ষণের জন্য একে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দুষ্প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে সকল ব্যবহারকারীকে সে পরিমাণ মূল্য বহন করতে হবে।
পানি সরবরাহকারী ও বাকি জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই দাম নির্ধারণ করা হবে। খাবার পানির দাম কম থাকলেও বাণিজ্যিক কাজে ও শিল্পখাতে ব্যবহারে জন্য বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, 'যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত পানির মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। পানির দুষ্প্রাপ্যতা আছে এমন অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করতে, পানির সহজলভ্যতা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা যায়।'
নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে পানির সহজলভ্যতার ওপর ভিত্তি করে শিল্পখাতে ব্যবহৃত পানির দাম নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয় এ নীতিমালায়। পানি ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণের প্রস্তাবও রাখা হয়। এ নীতিমালার ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পানি ব্যবহারে আরও সচেতন হবে এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
ওয়ারপো জানিয়েছে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ধরনের ওপর ভিত্তি করে তাদের পানির চাহিদা ভিন্ন হয়, তবে সব ধরনের খাতই তাদের প্রয়োজন বিবেচনা ছাড়াই একই মানসম্পন্ন পানি পাচ্ছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ধরন ও তাদের পানি ব্যবহারের ধরন বিবেচনায় রেখে পানি বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয় এ নীতিমালায়।
ওয়ারপো'র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিল্পখাতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্জ্যপানির নিষ্কাষণ কমাতে পানি ও বর্জ্যপানি শুল্ক এবং দূষণকারীর জরিমানা আরোপের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। শুল্ক ও দূষণের জরিমানা নির্ধারনী কমিটি গঠন ও নির্দেশনা প্রণয়ন করা হবে বলেও জানান তারা।
বিদ্যমান পরিবেশ আইন অনুযায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ দূষণের জরিমানা আদায় করে থাকে। কোনো ফ্যাক্টরিতে নিষ্কাশিত ১ লিটার বর্জ্য পানির জন্য ৩১ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
তবে পরিবেশ দূষণের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছেনা এর মাধ্যমে। পরিবেশ দূষণের ক্ষতির যথাযথ মূল্যায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাজে নিয়োজিত করার প্রস্তাবনা রাখা হয়।
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এনামুল হক পানি ও বর্জ্য পানি শুল্ক সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে দূষণের জরিমানা সংগ্রহ করার কাজ সহজ হবেনা বলেও সতর্ক করেন তিনি।
"আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেও দূষণ বন্ধ করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। বর্তমানে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিমানা করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের বাইরে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের দেয়া উচিৎ," বলেন তিনি।
"শিল্প উদ্যোক্তারা স্বল্প সংখ্যক জরিমানা নিয়ে চিন্তিত নয়। এটি বিবেচনায় রেখেই জরিমানা নির্ধারণ ও আদায়ে আরও কঠোর হতে হবে।" যোগ করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো পোশাক শিল্পের ধৌতকরণ ও রঙের কাজে তৈরি বর্জ্য। প্রতি টন কাপড় তৈরিতে নদীতে ২০০ টন বর্জ্য পানি নিষ্কাশিত হয়। ইস্পাত ও কাগজ কারখানা থেকে নদীর পানিতে এক লাখ কোটি লিটার ও ৪৫ হাজার কোটি লিটার পানি নিষ্কাশিত হয়।
লেভি স্ট্রসের এক মূল্যায়নে দেখা যায়, একটি জিনস কাপড়ের ক্ষেত্রেই খরচ হয় ৩ হাজার লিটার পানি। এরমধ্যে ৪৯ শতাংশ খরচ হয় তুলা উৎপাদনে ও ৪৫ শতাংশ খরচ হয় গ্রাহকরা তাদের কাপড় ধোয়ার ফলে। বাকি ৬ শতাংশ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খরচ হয়।
অনন্ত অ্যাপারেলস প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উৎপাদনে পানির খরচ কমাতে লেভি স্ট্রসের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টারি রিসার্চ সার্ভিসের 'দ্য ইনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অফ দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লোদিং ইন্ডাস্ট্রি' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, টেক্সটাইল ও কাপড় শিল্পই ৭৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ব্যবহার, ১৭১৫ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন ও ৯২ মিলিয়ন টন বর্জ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। এ অবস্থা চলতে থাকতে এ সংখ্যা আরও ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থার মধ্যেই বিশ্বব্যাপী দূষণ ও পানির বিকল্প উৎসের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এ খসড়া নীতিমালায়ও পানি দূষণ কমিয়ে পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কিছু সুপারিশ রাখা হয়েছে।
'জিরো ডিসচার্জ' পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
নীতিমালায় ওয়ারপো আরও জানিয়েছে, জিরো লিকুইড ডিসচার্জ প্ল্যান কঠোর ভাবে বাস্তবায়নের বিবেচনায়, সম্ভাব্য নিষ্কাশিত বর্জ্যের ভিত্তিতে সরকার পানি সরবরাহ করবে।
জিরো লিকুইড ডিসচার্জ (জেডএলডি) এর মাধ্যমে সকল তরল বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা করা হয়।
সিইপিটি'র ব্যবহার নিশ্চিত করা
কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারকে সিইটিপির সক্ষমতা অনুযায়ী ইকোনমিক জোন গঠনে জমি বরাদ্দ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ওয়ারপো।
পানি ব্যবহারের ক্ষেত্র নির্ধারন
পানির সহজলভ্যতার ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধানের পরামর্শ দেয়া হয়েছে নীতিমালায়। ইকোনমিক জোন গঠনের পূর্বেই বর্জ্য নিষ্কাশনের সম্ভাব্য পরিমাণ যাচাইয়ের ব্যাপারে জোর দেয়া হয়।
পানির বিকল্প উৎসের ব্যবহার
দীর্ঘমেয়াদী পানি সুরক্ষার জন্য, যেসব প্রতিষ্ঠানের কাজে সুপেয় পানির প্রয়োজন নেই তাদের সুপেয় পানি সরবরাহ সীমাবদ্ধ করার লক্ষ্যে এগুচ্ছে সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের উৎপাদনের কাজে পানির বিকল্প উৎস খুঁজে নিতে হবে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মোতাবেক বৃষ্টির পানি সংগ্রহের পরামর্শ দেয়া হয়, সেইসাথে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পানি ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে।