হাসপাতালের জন্য চট্টগ্রাম রেলওয়ের এক টুকরো সবুজ নষ্ট করা কি বুদ্ধিমানের কাজ! যৌক্তিক?
১৮৭২ সালে ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি ভবন। ১২৫ বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ এলাকাটি ছায়ায়–মায়ায় ঘিরে রেখেছে কয়েক হাজার গাছ; যার মধ্যে রয়েছে ৬৪টি শতবর্ষী গর্জন, সেগুন ও শিরীষ। পাশের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণির আবাস।
একটু বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে এখানে ছুটে আসেন নগরবাসীরা। বৃক্ষশোভিত টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা মনোরম প্রকৃতির এই জায়গাটিকে বলা হয় বন্দরনগরীর ফুসফুস।
সেই প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করে সিআরবি এলাকার ছয় একর জমিতে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করছে রেলওয়ে। যা বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড।
অথচ একই জায়গায় রেলের একটি হাসপাতাল রয়েছে, করোনার এই দুঃসময়েও ওই হাসপাতালের ৮০ শতাংশ বেড খালি পড়ে আছে।
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পুরোটাই জুড়ে ছিল ডিসি হিল। কিন্তু জেলা প্রশাসনের বাঁধায় পাঁচ বছর ধরে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সিআরবি এলাকা বন্দনগরীর প্রধান সাংস্কৃতিক বলয় হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর এখানে পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন ও রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীর মতো অনুষ্ঠান হয়। সকাল এবং বিকেলে জমে প্রকৃতি ও সংস্কৃতি প্রেমীদের আড্ডা।
ইতিমধ্যে রেলওয়ে প্রস্তাবিত জমিতে সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে। ছয় একরের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি শতবর্ষী শিরীষ ও সেগুন গাছ। এছাড়া পুরো এলাকায় মাঝারি ধরনের পাহাড় ও টিলা ঘিরে রয়েছে সেগুন, কড়ই, মেহগনিসহ নানা জাতের তিনশর বেশি গাছ।
গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে রেলওয়ের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাঁচা-আধাপাকা কয়েকশ ঘর। ইতোমধ্যেই ওই এলাকা থেকে আটটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, অপেক্ষা রয়েছে আরও অন্তত তিনশ পরিবার। কেটে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েকটি গাছ। প্রায় একশ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে তৈরী করা হয়েছে রাস্তা। উচ্ছেদের আওতায় রয়েছে মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, কবরস্থান এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভবনও।
এ হাসপাতাল করতে গেলে কমপক্ষে তিন শতাধিক গাছ কাটা যাবে। কাটা যাবে একটি পাহাড়। সাংস্কৃতিক কর্মী ও সুশীল সমাজের দাবি হাসপাতাল হলে এ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা ইতোমধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হাসপাতাল তৈরী বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১৮৭২ সালে যখন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো বৃটিশ সরকার এই উপত্যকার একটি টিলা বা পাহাড় কাটেনি। প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরোপুরি অক্ষুণ্ণ রেখেই সব স্থাপনা তৈরী করেছিলো। আর এখন হাসপাতালের নামে চট্টগ্রামের ফুসফুসে কোপ বসানোর চেষ্টা হচ্ছে। শুধু হাসপাতালই নয়, এখানে কোনো ধরনের স্থাপনাই হওয়া উচিত হবে না।"
রেলওয়ের সাবেক চিফ কমান্ডেন্ট এম কে রায় বলেন, "সিআরবিতে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি হাসপাতাল আছে। কিন্তু সেখানে কোনো সেবা নেই। হাসপাতালের ৮০ শতাংশ বেড খালি। এ অবস্থায় পাশেই সরকারি জায়গায় বেসরকারি একটি হাসপাতাল হওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হবেনা।"
প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির বলেন, "শিরীষতলায় হাসপাতাল হচ্ছে না। হাসপাতাল হবে গোয়ালপাড়ায়। সেখানে একটি মাত্র শতবর্ষী গাছ রয়েছে। আর পাহাড়-টিলা অক্ষত রেখেই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। কর্মচারীদের জন্য বিকল্প আবাসন ব্যবস্থা হয়েছে। এ প্রকল্প নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত"।
গণ-সংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা হাসান মারুফ রুমি বলেন, "চট্টগ্রাম নগরে দিনদিন খেলার মাঠ, উন্মুক্ত পার্ক ও সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই সিআরবি কেবল বিনোদনের জায়গা না, নগরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে সাথে তার শত বছরের ঐতিহ্যও চট্টগ্রামের সাথে জড়িত। আমাদের হাসপাতাল প্রয়োজন, তবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে নয়। "
পাশের শিরীষ তলায় খেলায়রত কিশোর সাকিব হাতে ক্যামেরা দেখেই প্রতিবেদকের কাছে ছুটে আসে। সে বলে, "রেলওয়ে কলোনিতে আমাদের বাসা। ছোটবেলা থেকে এখানে খেলে আমরা বড় হয়েছি। এখানে যদি হাসপাতাল হয় আমরা খেলবো কই? আমর ভাইরা খেলবে কই?"
রেলের সাবেক কর্মচারী আমেনা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই কলোনীতে আমার জন্ম। ৭১ এর যুদ্ধেও এলাকা ছেড়ে যাইনি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদেরা, আমার বাবা-দাদা সবাই পাশের গোরস্থানেই শুয়ে আছেন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল এই সিআরবি মোড়ে পাক হানাদারেরা শেখ নজির আহমদ সাহেবকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক জি এস আবদুর রব, মুক্তিযোদ্ধা মোনোয়ার হোসেন, গঙ্গারামসহ অগণিত শহীদের সমাধি এখানে।"
চট্টগ্রাম নগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ বলেন, "পনের বছর আগে চট্টগ্রামের সকল মুক্তিযোদ্ধারা মিলে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরীর জন্য সিআরবি এলাকাকে প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু রেলওয়ে থেকে বলা হয়েছিলো স্মৃতিসৌধ হলে পরিবেশ নষ্ট হবে! স্মৃতিসৌধের জন্য যেখানে ১০০ ফুট জায়গা রেলওয়ে দেয়নি, সেখানে পাহাড় কেটে ছয় একর জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল করা হচ্ছে। যা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।"
বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর বলেন, "এখানে প্রকল্প নেওয়ার আগে রেলের শ্রমিক কর্মচারীদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল করতে চাইলে রেলের অনেক অব্যবহৃত জমি আছে। কুমিরা রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ৩৫ একর জমি অবহেলায় পরে আছে। সেখানেও হাসপাতাল করা যায়।"
তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই দৃষ্টিনন্দন সবুজ জায়গায়, পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে যেন অবকাঠামো নির্মাণ না হয়, এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। হাসপাতাল নির্মাণ এবং পরিবেশ ও বৃক্ষ সংরক্ষণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে শীঘ্রই আলোচনা করে এর একটি সমাধান করা হবে। কোনোভাবেই উন্মুক্ত জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না"।