৬০ বছর অপেক্ষার পর উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে রাঙামাটির স্বপ্নের সেতু
রাঙামাটি শহর লাগোয়া পুরানপাড়াবাসীদের কপাল পোড়াই বলতে হবে। ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে যখন নদীতীরের শহর রাঙামাটি পানিতে ডুবে যায়, তখন শহরবাসী অনেকেই ছুটে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে, কেউবা বাঘাইছড়ি, কেউ পানছড়ি, মহালছড়ি কিংবা নানান জায়গায়।
কিন্তু কিছু মানুষ ঠিক শহরের পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেন, যাকে 'পুরানপাড়া' নামেই অভিহিত করা হয়; নতুন রাঙামাটি শহর সম্প্রসারণের প্রাককাল থেকেই।
নিয়তির নির্মম পরিহাস, শহর রাঙামাটি রূপে রসে আয়তনে আকারে বেড়েছে নানা দিকে, হয়েছে আধুনিক, নান্দনিকও; কিন্তু শহরের ঠিক লাগোয়া পুরানপাড়াবাসী, যারা মূল রাঙামাটি শহরেরই প্রাচীন নাগরিক, তারা মাত্র একটি সেতুর অভাবে সেই ১৯৬০ সাল থেকে গত ৬১ বছর বিচ্ছিন্ন শহর রাঙামাটি থেকে!
এই বিচ্ছিন্নতার বোধকে নৈকট্যে আনার প্রয়াসে ওই এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি ছিল একটি সেতু। এই সেতুর দাবিতে নানা সময় নানা কর্মসূচীও পালন করেছেন তারা। অবশেষে ২০১৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে শুরু হয় সেই স্বপ্নের সেতুর নির্মাণ কাজ।
কিন্তু যথাসময়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অভাব, আবার অর্থ বরাদ্দ পেলেও পানির প্রবাহ কাজের পক্ষে না থাকার জটিলতায় দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে সেতু নির্মাণ কাজটি। তার ওপর একেবারেই ভিন্ন ধারণার এই সেতুতে শুধু পুরানপাড়াই নয়, আরেকটি অংশের মাধ্যমে একই সেতু দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে ঝুলইক্যা পাহাড় নামে ছোট্ট একটি এলাকাকেও।
আশার কথা, সেতু নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে। এখন চলছে চূড়ান্ত পর্যায়ের ফিনিশিং ওয়ার্ক।
সেতুটির নির্মাণ কাজে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত থাকা উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম বলেন, 'আমার খুব ভালো লাগছে, এই সেতুর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নির্মাণ কাজের সাথে আমি সম্পৃক্ত আছি, এটি খুবই আবেগের একটি জায়গা। এই কারণেও ভালো লাগছে, শহরের খুব কাজের দুটি এলাকার মানুষ এই সেতুর মাধ্যমে শহরের সাথে সম্পৃক্ত হবে।'
'মাসখানেকের মধ্যেই সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেয়া যাবে,' এমন আশার কথা জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা বলেন, 'অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর সেতুর কাজ একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন কিছু মাটি ভরাট ও বারপোল নির্মাণের কাজ চলছে, এসব একমাসের মধ্যেই শেষ হবে আশা করছি। তারপরই সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।'
প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪২০ মিটার, প্রস্থ ৪.৫ মিটার।
নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা জানান, এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের দ্বিতীয় বৃহৎ সেতু। 'এর আগে আমরা প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে লংগদুর মাইনী-গাঁথাছড়া সেতুটির নির্মাণ কাজ করেছিলাম। এটা আমাদের একটা ভালোলাগার অনুভূতিও কাজ করছে।'
সেতু নির্মাণের দাবিতে স্থানীয়দের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আব্দুল মান্নান বলেন, 'এটা ভাষায় বোঝাতে পারব না, কী যে আনন্দ লাগছে আমাদের! কত আন্দোলন, কত মিছিল, মানববন্ধন। আমরা পুরানপাড়াবাসী সবার কাছে ঋণী, যারা এই সেতু নির্মাণকাজে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।'
'এই সেতুর মাধ্যমে পুরানপাড়ার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ এবং ঝুলক্যাপাহাড়ের কয়েক শত মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে,' যোগ করেন তিনি।
সেতুটির সংযোগ সড়ক কাজের ঠিকাদার মোঃ শাওয়ালউদ্দিন বলেন, 'আমি এই এলাকার সন্তান হিসেবে চেষ্টা করেছি কাজটি দ্রুতলয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কোয়ালিটি ঠিক রেখে শেষ করার জন্য, এবং আমি সেটা পেরেছি। এটা আমার জন্যও আনন্দের যে, আমাদের প্রতিবেশি একটা এলাকা বহু বছর পর মূল শহরের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হচ্ছে।'
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সেতুটিকে 'রিজার্ভবাজার থেকে পুরানপাড়া-ঝুলক্যাপাহাড় সংযোগ সেতু' হিসেবে কাজ শুরু করলেও স্থানীয়রা দাবি করছেন,এটির যেন একটি নাম দেওয়া হয়। ইতোমধ্যেই একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে সেতুটির নামকরণের দাবিও উঠেছে।
সম্প্রতি সেতু সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, কাপ্তাই হ্রদের বুকে ছিঁড়ে যাওয়া সেতুটির উভয়পাশ যেনো অপরূপ সৌন্দর্য্যের আধার। একদিকে সুভলং ভ্যালি এবং অন্যদিকে ফুরোমন ভ্যালির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সেতুটিকে দিয়েছে যেন ভিন্ন এক মাত্রা। সম্ভবত আসছে দিনগুলোতে আসামবস্তি সেতুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে চলেছে পুরানপাড়া সেতুটি!