জমি অধিগ্রহণ সংকটে ত্রাহি অবস্থায় এলেঙ্গা-রংপুর ১৯০ কিলোমিটার চার লেন সড়কের কাজ
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুরের মডার্ন মোড় পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার চার লেন সড়ক বর্ধিত সময়েও শেষ না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে অধিগ্রহণ জটিলতাই সামনে এসেছে। এর মধ্যে বেশি সংকট তৈরি করেছে মাজার-মসজিদ অপসারণের বিষয়টি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সঠিক নথিপত্রের সাপেক্ষে মসজিদ-মাজারের অনুকূলে অধিগ্রহণের বা ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে।
তবে ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এই কাজে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দ্রুত সমাধান না হলে ফোর লেন সড়কটির কার্যক্রম ঝুলে যাবে। অর্থাৎ এই কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। ফলে বেড়ে যাবে নির্মাণ খরচও।
প্রকল্পের মুখপাত্র ও নির্বাহী প্রকৌশলী জয় প্রকাশ চৌধুরী জানান, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ও বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়ক যুক্ত হতে যাচ্ছে। এই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। ১৯০ কিলোমিটার সড়কটি এর একটি অংশ। এই সড়কের মাধ্যমে রংপুর-সৈয়দপুর-বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেও রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় এ কাজ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। উত্তরবঙ্গে শিল্প কারখানার প্রসারসহ ভারত-নেপালের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে চার লেন হচ্ছে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুর মহাসড়ক। রংপুর মহাসড়ক থেকে বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা হয়ে ভারত-নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মহাসড়কটি।
সাসেক কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, ফোর লেনের এই সড়কের কাজ ইতিমধ্যে ৫১ শতাংশ হয়েছে। তবে এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব অঞ্চলে সেভাবে কাজই শুরু হয়নি। আর জমি অধিগ্রহণের প্রাক্কলনই দেওয়া হয়নি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। গাইবান্ধায় গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে ফোর লেনের জন্য মোট ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, 'বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।'
১৯০ কিলোমিটার সড়ক নয়টি ভাগে ভাগ করে হচ্ছে। এই সম্প্রসারণ কাজে ২০১৬ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে কিছু সংযুক্তির ফলে বেড়েছে ব্যয়। এখন একই সড়কে নির্মাণ খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এই সড়ক মোট নয়টি ভাগে ভাগ করে উন্নয়ন কাজ চলছে। নতুন করে এই সড়কের সাথে কয়েকটি ফ্লাইওভার তৈরির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। প্রকল্পে এই বিষয়টি নতুন করে যুক্ত করলে আরও অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে।
তবে ফ্লাইওভারের বিষয়টি বাদ দিলেও মূল রাস্তার চার লেনে উন্নীতকরণের বিষয়টিই জটিলতার জালে আটকে আছে। বগুড়ার শেরপুর থেকে শাজাহানপুরের বনানী পর্যন্ত সড়কের চার লেন উন্নয়ন কাজ ৮ নম্বর প্রকল্পের (শেরপুরের মির্জাপুর থেকে বনানী) আওতায়। এই কাজ করছে সিপিসিএল তান্তিয়া জেভি কোম্পানি। প্রথমে নির্ধারিত সময়ে এই কাজ শতভাগ হওয়ার কথা থাকলেও ৮ নম্বর প্রজেক্ট অংশে হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।
সময়মতো কাজ করতে না পারার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার এই প্রকল্পে সরকার ৬ একর জমির অধিগ্রহণ জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই ৭৫ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধিগ্রহণের মধ্যে বেশি সংকট তৈরি করেছে কয়েকটি মসজিদ।
এর মধ্যে রয়েছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর বাজার পাড়া জামে মসজিদ, পার্ক মাঠ আহলে হাদিস জামে মসজিদ, মামলার জালে জটিলতা তৈরি করেছে শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল বাজার, শালুকাগাড়ী জামে মসজিদ, রহিমাবাদ উত্তরপাড়া জামে মসজিদ, নূরে এলাহী জামে মসজিদ, বেতগাগী জামে মসজিদসহ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দোকানপাট ও বাড়িঘর। অধিগ্রহণ মূল্য দিয়েও প্রকল্প শুরুর পর থেকে তাগাদা দিয়েও সরানো যাচ্ছে না এই প্রতিষ্ঠানগুলো।
কেন মসজিদ সরানো হচ্ছে না জানতে চাইলে পার্ক মাঠ আহলে হাদিস জামে মসজিদের সভাপতি শেখ সাদী বলেন, 'আমাদের মসজিদ দানের সম্পত্তিতে গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় এক ব্যক্তি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি মসজিদে দান করেছে। ডিসি অফিস বলছে, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া জমি কোনো ব্যক্তি ২৫ বছরের আগে বিক্রি করতে পারবে না। অথচ এমন জমি ১২ বছরের মধ্যে মসজিদে জমি দান করা হয়েছে। এই গোলমেলে পরিস্থিতির কারণে আমরা অধিগ্রহণের কোনো টাকা পাইনি। এ কারণে মসজিদ সরানো হয়নি।'
মসজিদের স্থাপনার টাকা পেলেও জমি অধিগ্রহণের কোনো টাকা পায়নি শাজাহানপুরের শালুকগাড়ী জামে মসজিদ। দোতলা এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জাহিদুল হক আরজু বলেন, 'অবকাঠামোর জন্য ২ কোটির কিছু বেশি টাকা পাওয়া গেছে। তবে জমির জন্য কোনো টাকা পাইনি। মসজিদ সরানো হচ্ছে।'
প্রকল্পের এই অংশে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৯ মাস বসে ছিল। এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মামুন কায়সার বলেন, 'বিভিন্নভাবে নোটিশ করে এলাকার অধিকাংশ স্থাপনা অপসারণ করা গেছে। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। তাদের বার বার করে বোঝানো হচ্ছে এই মহাসড়ক চার লেন হলে দেশের মানুষের লাভ হবে। আশা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই এসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা সরিয়ে নিবেন। আর কিছু জায়গা নিয়ে মামলা হয়েছে, সেগুলোরও সমাধান দরকার। নইলে প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা কঠিন হবে।'
প্রকল্প-৮ এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিপিসিএল তান্তিয়া জেভি কোম্পানি। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বেড়াজালে আটকে আছে তারা। এই প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক শামসুজ্জোহা বলেন, 'জমি অধিগ্রহণের টাকা নিয়ে ঠেলাঠেলি চলতে থাকলে ফোর লেনের নির্মাণ অগ্রগতি দেখা যাবে না। কবে কাজ শেষ হবে তাও বলা যাবে না। খরচও বেড়ে যাবে।'
প্রকল্প (প্রজেক্ট) এলাকা-৯ (বানানী থেকে মোকামতলা) এ কাজের অগ্রগতি ভালো। তবে এখানেও সংকট মসজিদ মাজারের অধিগ্রহণের টাকা নিয়ে। এখানে ১২টি প্রতিষ্ঠান অপসারণ করা হয়নি; এর মধ্যে ৫টিই মসজিদ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথি বলছে, শাজাহানপুরের গণ্ডগ্রাম জামে মসজিদ, বগুড়া সদরের জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা একাডেমীর জামে মসজিদ, নওদাপাড়া গরের বাড়ি জামে মসজিদ, ঠেঙ্গামারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, বাঘোপাড়া হাট বায়তুন নূর মসজিদ। আর মাজার রয়েছে চারটি। কবরস্থান রয়েছে একটি। স্কুল ও কলেজ রয়েছে একটি। এগুলোর বেশিরভাগই কমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। সংগত কারণে অপসারণ করা যায়নি এসব প্রতিষ্ঠান।
নওদাপাড়া গরের বাড়ি জামে মসজিদের সভাপতি শহীদুল ইসলাম নান্টু বলেন, 'মসজিদের জমিদাতা ও কমিটির মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এই সংক্রান্ত একটি মামলা আদালতে চলমান। আদালতের রায়ের পর বিষয়টি সমাধান হবে।'
যদিও সাসেক কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব প্রতিষ্ঠান বা জমি অধিগ্রহণ করার সব টাকা জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের উপ ব্যবস্থাপক আফিফ রহমান চৌধুরী বলেন, 'আমরা এখন এই প্রকল্পে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করছি। কিন্তু মসজিদ-মাজারের জমি নিয়ে জটিলতার কারণে কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে নির্মাণ কাজ সময়মতো করা সম্ভব হবে না।'
আরও সাত ফ্লাইওভার
'এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ' প্রকল্পের কাজ ২০২১ সালের আগস্টে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৪৬১ মিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি সেতু, ৪১১ মিটারের একটা রেলওয়ে ওভারপাস ও ১১টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু ইপিজেড ও গোবিন্দগঞ্জ-পলাশবাড়ী এলাকায় নতুন করে দুটি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ হবে।
সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) সড়ক সংযোগ প্রকল্পে আরও অন্তত সাতটি ফ্লাইওভার স্থাপনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এগুলো এই মহাসড়কের বাজার এলাকায় নির্মাণ করা হবে। এগুলো হবে শেরপুর, মাঝিরা, দ্বিতীয় বাইপাস, বনানী, মাটিডালি, চান্দাইকোনো ও রংপুরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব স্থানে ফ্লাইওভারের জন্য নকশাসহ সব রেডি করা হয়েছে। ফ্লাইওভার হলে যানজট ও দুর্ঘটনা কমবে।
এই বিষয়টির সাথে অবশ্য একমত পোষণ করেছেন দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, 'এটি আন্তর্জাতিক মানের সড়ক হচ্ছে। চীন, ভারত, নেপালসহ অন্যান্য দেশ থেকে বড় বড় গাড়ি যাওয়া-আসাকালে রাস্তার পরিবেশও সেই মানের হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, বাজার এলাকায় লোকজন রাস্তার উপরে হাটাহাটি করেন। ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করে। এতে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই কারণে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে অবশ্যই ফ্লাইওভার দিতে হবে। এতে জনসাধারণের উপকার হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন ফ্লাইওভার করলে নতুন করে রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করতে হবে না। আরেক দফায় বিনিয়োগও করতে হবে না। একসাথে জনভোগান্তির অবসান হবে।'
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এই সাসেক প্রকল্পের পরিচালক ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, 'অধিকাংশ মসজিদগুলো ওয়াকফর সম্পত্তি। এ কারণে তাদের টাকা দেওয়া হয়েছে। মসজিদ কমিটিকে নয়। তবে এই বিষয়টি সমাধানের জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।'
নতুন ফ্লাইওভারের বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ালিউর বলেন, 'এই প্রকল্প ২০১৪-১৫ সালে ডিজাইন করা। আগের প্রকল্পে ফ্লাইওভার ধরা ছিল না। এখন দিন বদলেছে, চিন্তা বদলে গেছে; এ কারণে ফ্লাইওভারের প্রস্তাব নতুন করে সচিব স্যারের কাছে উপস্থাপন করা হবে।'