সংস্কার হয়নি শচীন দেব বর্মণের পৈতৃক বাড়ি, থমকে আছে কালচারাল কমপ্লেক্সের কাজ
হাতে বীনা। দরজা খুলে বসে আছেন মীরা দেবী। দখিনা হিমেল হাওয়া দেহমনে দোল দিচ্ছে। তিনি সুর তুলেছেন। গান ধরেছেন শচীন দেব বর্মণ। 'শোনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি/ লেগেছে চোখেতে নেশা, দিক ভুলেছি আমি…'।
কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণ চর্থায় অবস্থিত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ, দ্য সান অব সয়েল, প্রিন্স অব মেলোডি খ্যাত শচীন দেব বর্মণের বাড়ির ফটক খুলে পশ্চিম দিকের সীমানা প্রাচীরে আঁকা ছবিতে দখিনের জানালা খুলে বীণা হাতে কোনো নারীর প্রতীক্ষার দৃশ্যটি যেন ১৯২০-২৪ সালেরই প্রতীক। ছবির নারীটি শচীনের স্ত্রী প্রখ্যাত গীতিকার মীরা দেবীর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শচীন পরিবারের সবাই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। এর পর থেকেই বেদখল হতে থাকে তাদের সম্পত্তি। এতবছর স্থায়ী হলেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটির এখন মিতপ্রায় অবস্থা।
শচীন দেব বর্মণের পিতা নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মণ বাহাদুর ত্রিপুরার রাজবংশ থেকে বিতাড়িত হয়ে কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণ চর্থায় প্রায় ৬০ একর জায়গায় বাড়ি গড়ে তোলেন। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর এ বাড়িটিতেই জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেব বর্মণ।
১৯৬৫ সালে শচীনের পৈতৃক ভিটার সামনের অংশে গোলপুকুর পাড়ে স্থাপিত হয় সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। আরও অন্ধকারে পড়ে যায় শচীনের বাড়ি। ১৯৮২ সালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমান কুমিল্লায় নজরুলের বিচরণস্থল আবিষ্কার করতে গিয়ে শচীন দেব বর্মণের বাড়ির বিষয়ে সন্ধান পান। ওইসময়েও খামারটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলেন কুমিল্লার সংস্কৃতি কর্মীরা। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
২০১২ সালে ত্রিপুরা সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শচীন দেবের পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৩ সালে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন। ২০১৪ সালে সাবেক জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল বাড়ির সীমানার মূল অংশ (০.৮৩ একর) চিহ্নিত করে লাল পতাকা টানিয়ে দেন।
২০১৫ সালে তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর বাড়িটি সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেন। পুরাতন কাঠামো ঠিক রেখে এর ওপর চুন-সুরকির প্রলেপ দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় উৎসবের আয়োজন হয় কুমিল্লায়। জাতীয় উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২৫ মে কুমিল্লায় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করেন তিনি। যার একটি ছিল শচীন দেব বমর্ণের বাড়ি সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
এরপর টেন্ডার আহ্বানের মাধ্যমে এর কাজ শুরু হয়। বরাদ্দ হয় এক কোটি দশ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে শচীন দেব বর্মণের মৃত্যুবার্ষিকীতে ২৯ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার অনুষ্ঠানে ঘোষণা আসে বাড়িটিকে কালচারাল কমপ্লেক্স করার। ওই অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের হাতে একটি হারমোনিয়াম তুলে দেন নবাব হোচ্ছাম হায়দার বংশধর সৈয়দ জুলফিকার হায়দার। নবাব বাড়িতে গান করা কালে এ হারমোনিয়ামটি বাজাতেন শচীন দেব।
২০১৫ সালের পর কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জোয়ার আসে। ২০১৬ সালেও মেলা হয়। শচীনের বাড়ি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে সে বাতি আবার নিভে যায়। বাড়িটির দায়সারা সংস্কার কাজ শেষ হবার পর গেটে তালা পড়ে। কমপ্লেক্স তো দূরের কথা আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় বাড়িটি।
জেলা প্রশাসন ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি সংরক্ষণ করে টিকিট ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু এ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমানের বদলির পর সেটিও আর আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, গেট টপকে স্থানীয় যুবকরা প্রবেশ করছেন। মূল ঘরে যুবকদের গাঁজা ও জুয়ার আড্ডা।
বাড়িটির সদর দরজার সাথে ঘরের মাঝামাঝিতে বারান্দা আকৃতির তিনটি কক্ষ। বাড়ির পূর্ব ও পশ্চিমাংশে আরও তিনটি করে ছয়টি কক্ষ। পূর্ব-দক্ষিণাংশে পূজা ও ঠাকুরঘর। বারান্দার মতো কক্ষগুলোর পলেস্তারা খসে পড়ছে। ঘরে কিছুই নেই। বাড়ির সীমানা প্রাচীরে অঙ্কিত আলপনা মুছে যাচ্ছে।
কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবির বলেন, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লাবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে বাড়িটিকে পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স করা হোক। শচীন কর্তার স্মৃতি রক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জোর দাবি জানাই।"
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, "কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও এনজিওগুলো প্রোগ্রাম করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা খুঁজে পায় না। বাড়িটিকে আধুনিকায়ন করে এখানে কর্মসূচির আয়োজন করা গেলে কমপ্লেক্সটি জমজমাট থাকতো। আর অনুষ্ঠানে অর্জিত অর্থ দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যেতো। আমি মনে করি, ভালো ওয়াশব্লক থাকলে এটা করা সম্ভব। মানুষের আনাগোনা থাকলে এখানে বখাটেদের উৎপাত কমতো।"
নাট্যকর্মী শাহজাহান চৌধুরী বলেন, "হাঁস-মুরগির খামারটি এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ বেতার কুমিল্লার স্টুডিওটি এখানে সরিয়ে আনা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ বসে তথ্য ও সম্প্রচার, প্রাণিসম্পদ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বললে এটা সম্ভব হবে।"
"বেতারের স্টুডিও এখানে সরিয়ে আনা গেলে শিল্পীর বাড়িতে আবারও সংগীত ফিরে আসবে। যেহেতু বাড়ির সম্মুখ অংশে খামার, সৌন্দর্য রক্ষার্থে এটা সরিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সংস্কৃতি কর্মীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করছি বাড়াটিকে রক্ষার জন্য, কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। সবাই জন্মদিনে ফুল দেওয়া ও মৃত্যুবার্ষিকীতে মেলা আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আমি জেলা প্রশাসন ও তথ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছি। দেখা যাক, তারা কী করেন।"
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এ এম সাইফুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, "আমাদের দায়িত্ব বাড়িটিকে সংস্কার ও সংরক্ষণ করা। এর বেশি কিছু নয়।"
বাড়িটির পলেস্তারা খসে পড়ছে জানানো হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি জানেন না।
এ কর্মকর্তা জানান, ভবিষ্যতে টিকিটের আওতায় এনে বাড়িটিকে সংরক্ষণের চিন্তা আছে তাদের।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাহাদাত হোসেন জানান, "এখানে জেলাপ্রশাসন নিযুক্ত কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে।"
শচীন কমপ্লেক্স ও উন্নত সংগীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো চিঠি আমরা পাইনি।"