গ্রাহকদের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ
চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকার পোষাক শিল্প শ্রমিক শাহিনা আক্তার। মেয়ের বিয়ের জন্য মাসে দুই হাজার করে ১০ বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ইপিজেড এলাকার প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে জমা রেখেছিলেন।
১০ বছর পর লভ্যাংশসহ মূল টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার চুক্তি থাকলেও মেয়াদপূর্ণ হওয়ার পাঁচ মাসেও এখনো তার পাওনা বুঝে পাননি তিনি। পরের মাসে টাকা দেওয়ার কথা বলে তিন মাস ধরে সময় নেওয়ার পর গত দুই মাস আগে অফিসটি বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। জীবনের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাবেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় আছেন শাহিনা আক্তার।
শাহিনা আক্তারের মতো দেড় হাজার শ্রমিকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভের মালিক। পাওনা টাকা ফেরত পেতে এখন প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে ধর্না দিচ্ছে গ্রাহকরা।
এর আগে নগরের ইপিজেড এলাকায় ২০২০ সালে দেড় লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় রূপসা কো-অপারেটিভ মাল্টিপারপাস। এরপর থেকে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি (রেজি-১২১২০/১৪) গ্রাহকদের টাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। মেয়াদ পূর্ণ হলেও গ্রাহককে তাদের জামানত ফেরত দিতে গড়িমসি করতে থাকে। গত ২২ জুলাই অফিসে তালা ঝুলিয়ে অন্যান্য কর্মকর্তারাও হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান।
২০০১ সালে নগরীর ইপিজেডে কার্যক্রম শুরু করে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ওই এলাকার চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়। ইপিজেড নিউমুরিং সড়কের ভেতরে আরেকটি কার্যালয় রয়েছে। আশেপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টস শ্রমিকদের দ্বিগুণ লাভের আশ্বাস দিয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করে। সঞ্চয়ের উপর দ্বিগুণ টাকা প্রদানের লোভ দেখিয়ে প্রায় শত কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
এছাড়া প্রায় এক যুগ আগে চান্দগাঁওয়ের কাপ্তাই রাস্তার মাথার কাজীর বাজার এলাকায়ও অপর একটি শাখা অফিস গড়ে তোলে তারা। সেখানকার হাজারের অধিক গ্রাহক থেকেও শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। ইপিজেড ও কাপ্তাই—দুই ইকোনোমিক জোন থেকে আড়াই হাজারের অধিক গ্রাহক থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গত ২২ জুলাই থেকে সমিতির কার্যালয় বন্ধ করে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাকসুদসহ তার সহযোগীরা।
গত দেড়মাস ধরে ভুক্তভোগীরা সমিতির চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বুঝে নিতে চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসের পরিদর্শক (দায়িত্বপ্রাপ্ত অবসায়ক) সাজ্জাদ হোসেনকে অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিস।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসার মুরাদ আহম্মেদ টিবিএসকে বলেন, 'গ্রাহকরা একসাথে তাদের টাকা ফেরত চাইলে বিপাকে পড়ে যায় প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ। গ্রাহকদের টাকা যাতে ব্যাংক থেকে সরাতে না পারে সেজন্য স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে একজন অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে। আমরা প্রতিষ্ঠানটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।'
জেলা সমবায় অফিসের পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি কর্তৃপক্ষকে সকল হিসেবে বুঝিয়ে দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। পরে তাদের স্থাবর সম্পত্তি যেন বিক্রি করতে না পারে এজন্য প্রতিটি ভূমি অফিসে আমরা চিঠি দিয়েছি।'
সুমন নামের গার্মেন্টসকর্মী বলেন, 'স্ত্রী রোজিনা বেগমসহ আমরা দুজনই গার্মেন্টসে চাকরি করি। দশ বছর মেয়াদে লভ্যাংশসহ দ্বিগুণ পাওয়ার আশায় নিজের নামে ১ লাখ ও স্ত্রী রোজিনার নামে ১ লাখ এফডিআর করি। মেয়াদ শেষে ৪ লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও এখন মূল টাকাটা পাওয়া নিয়েই চিন্তায় আছি।'
প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা বাসিন্দা মাকসুদুর রহমান। টেলিফোনে তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে টাকা না পেয়ে ইপিজেড থানায় প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা দায়ের করেছে গ্রাহকরা।
ইপিজেড থানার অফিসার ইনচার্জ (ইনভেস্টিগেশন) আবুল বাশার টিবিএসকে বলেন, 'প্রাইম স্টার অপারেটিভের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মামলার তদন্তে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে।'