মর্টার শেলের শব্দে কাঁপছে তুমব্রু, উখিয়া সীমান্তেও গোলাগুলি
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ছয়টা। পাহাড়ের ফাঁক গলে আলো পড়তে শুরু করেছে সীমান্তঘেষা জমিতে। কৃষক হামিদ হোসাইন তার ধানক্ষেতে নিড়ানি দেওয়া শুরু করেছেন মাত্র। ঠিক তখনই মর্টার শেলের বিকট শব্দে কেঁপে উঠে পুরো তুমব্রু সীমান্ত এলাকা। এভাবেই নাইংক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত জুড়ে থেমে থেমে পুরোদিন ছোড়া হয় (মিয়ানমার থেকে) মর্টার শেল ও আর্টিলারি গোলা। এদিন নতুন করে উখিয়া উপজেলার পালংখালী সীমান্তেও মর্টারশেল আর গুলির শব্দ শোনা গেছে।
তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় সরেজমিনে অবস্থান করে দেখা গেছে, ভোর থেকে ২০-৩০ মিনিট পর পর মর্টার শেল ও কামানের গোলা ছোড়ার শব্দ ভেসে আসছিলো তুমব্রুর মায়ানমার প্রান্ত থেকে। গোলাগুলির বিকট শব্দে কাঁপছে এপাড়ের তুমব্রু বাজার, পশ্চিমকুল, ক্যাম্পপাড়া, বাজারপাড়া, কোনারপাড়া, খিজারীঘোনা, ভূমিহীন পাড়াসহ আশপাশের ১৫ গ্রাম।
তুমব্রু বাজার ও পশ্চিমকুল এলাকায় মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার ওপাড়ে রাখাইন রাজ্যের তুমব্রুরাইট পাহাড়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা। একাধিক সীমান্তচৌকি বাঙ্কার তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে। সেখান থেকে পূর্বদিকে তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক মর্টারশেল।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল চারটা থেকে রাতভর একইভাবে দফায় দফায় মর্টারশেলে ও গোলা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন তারা।
এদিকে মিয়ানমার সীমান্তে উপর্যুপরি গোলা বিস্ফোরণের ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অপরিচিত কাউকে তুমব্রুসহ আশপাশের এলাকায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না, তল্লাশি করা হচ্ছে স্থানীয়দের বহনকরা গাড়িগুলোও।
পশ্চিমকুল এলাকার কৃষক হামিদ হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত একমাস ধরে সীমান্তে উত্তেজনার কারণে জমিতে লাগানো ধানের জমি আগাছায় ছেয়ে গেছে। আজ দুই সপ্তাহ পর জমিতে আসছিলাম নিড়ানি দিতে। কিন্তু, গোলাগুলির আতঙ্কে আর সেটা হলো না। গত কয়েকদিনের মধ্যে আজই (মঙ্গলবার) গোলাগুলির শব্দ বেশি শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে জমিতে যেতে পারছি না।'
মঙ্গলবার বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি প্রথমবারের মতন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমান সীমান্তেও মর্টারশেল ও গুলি শব্দ শোনা গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ইউনিয়নের আঞ্জুমান সীমান্তে মায়ানমারের ওপাড়ে ভারী মর্টারশেল ও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোলা আতঙ্কে ভুগছেন গ্রামের মানুষ। বিষয়টি সীমান্ত বাহিনীকে জানানো হয়েছে।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, 'মঙ্গলবার সকালে উখিয়া সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ পাওয়ার কথা স্থানীয়রা জানিয়েছে। আঞ্জুমান সীমান্তের ৩০০ মিটারের ভেতরে একশ'র বেশি পরিবার রয়েছে। আমরা তাদের খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
আতঙ্কে ফাঁকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র-বাজার, এলাকা ছাঁড়ছে অনেকে:
মঙ্গলবার সকালে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার পশ্চিমকুল, ফকিরা ঘোনা, ক্যাম্পপাড়া, কোনারপাড়া ও ভূমিহীন পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ বাড়ির বাসিন্দা স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি হয়ে রয়েছেন। খুব জরুরি দরকার ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না।
ফকিরাঘোনা মক্তব, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাজবানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের চাইতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম।
তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুজিবুল হক বলেন, 'স্কুল থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার। এই দুরত্ব আসতে ১০টির উপরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছি। এমন একটা অবস্থায় আমরা নিজেরাই যেখানে আতঙ্কে আছি, সেখানে শিক্ষার্থীদের কী করে স্কুলে আসতে বলি? তবে যেহেতু এখনো সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই আমরা স্কুল চালিয়ে যাচ্ছি। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আনুপাতিক হারে স্কুলে বেশি আসছে, তবে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই নেই।'
ফকিরাঘোনা মক্তবের শিক্ষার্থী মো. সাকিব বলেন, 'সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবসময় এখানে গোলাগুলি হচ্ছে। আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।'
বেলা ১১টার দিকে তুমব্রু স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পুরো চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে একজন রোগীও নেই। একা বসে আছেন সহকারী চিকিৎসক উচিং নু চাক।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এটি তুমব্রুর একমাত্র স্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রতিদিন শতাধিক রোগী এখান থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে রোগী কমছে, আজ পরিস্থিতি আরও খারাপ। শিশু ও নারীদের নানান স্বাস্থ্য সমস্যা থাকার পরেও কেন্দ্রে আসছেন না আতঙ্কে।'
কোনারপাড়ার বাসিন্দা ও মাদ্রসা শিক্ষক লুৎফর রহমানের বাড়ি মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরত্বে। তিনি জানান, সোমবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে গোলাগুলি শুরু হয়, চলে গভীর রাত পর্যন্ত। গোলার বিকট শব্দে ঘরবাড়ি কাঁপতে থাকে, রাতভর কেউ ঘুমাতে পারে না।
লুৎফর রহমান বলেন, 'কোনারপাড়ার ৩৫ পরিবারের মধ্যে মাত্র আটটি পরিবার এখন এলাকায় আছে।'
ঘুমধুম ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাজার তুমব্রুবাজার। মঙ্গলবার দুপুরে বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাজারের অর্ধেকেরও বেশি দোকান বন্ধ। যে কয়েকটি দোকান খোলা আছে, সেগুলোতেও ক্রেতাদের তেমন কোনো উপস্তিতি নেই।
সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে ৩০০ পরিবার, সরতে চায় রোহিঙ্গারাও:
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সীমান্তের ২০০ গজের মধ্যে অন্তত ৭০টি বাংলাদেশি পরিবারের বসবাস। সেগুলোসহ ৩০০ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে, এরইমধ্যে তালিকা করা হয়েছে। এসব পরিবারকে সরিয়ে আপাতত নিরাপদ দূরত্বের কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩৫টি পরিবার কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় তাদের আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছে।'
এদিকে ঘুমধুম সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, 'এ সীমান্তে ৪ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা বসবাস করছে গত পাঁচ বছর ধরে। আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই তারা নানান আতঙ্কে আছে। মিয়ানমার বার বার রোহিঙ্গাদের জিরো পয়েন্ট থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেছে। গত একমাস ধরে চলে আসা গোলাগুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আমরা এখন খুবই আতঙ্কিত। অনেকেই বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন, তবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।'
তবে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদ দৌজা জানিয়েছেন, সীমান্তের জিরো পয়েন্টের জনগোষ্ঠীর জন্য কমিশনের কিছু করার সুযোগ নেই। অনেকেই স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করছেন এবং সীমান্তে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জরুরি সেবা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে।