অপতথ্য মোকাবেলায় ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে: বিশেষজ্ঞরা
ভুয়া খবর শুধু সাংবাদিকতার জন্য নয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যও একটি বড় হুমকি; তাই ভুয়া তথ্য থেকে বিভ্রান্তি মোকাবেলায় ফ্যাক্ট চেকিং (সত্যতা যাচাই) নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।
রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ডেইলি স্টার সেন্টারে শনিবার (১৯ নভেম্বর) সকালে 'ফ্যাক্ট-চেকিং ফর জার্নালিজম' শীর্ষক ওই সেমিনারে ভুয়া সংবাদ মোকাবেলা ও তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে তথ্য যাচাই কোর্সটির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা।
দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় দ্য ডফেইলি স্টার ভবনে সেমিনারটির আয়োজন করে গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই)।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মশিউর রহমান বলেন, যারা গুজব ছড়ায় তারা খুব সুচিন্তিতভাবেই তা ছড়ায়। কিন্ত এই সব ভুয়া তথ্য শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও কখনও বুঝে, কখনও না বুঝে এই অপতথ্য ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আর বলেন, "এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) প্রায় ৩৮টি বিষয়ে দেশীয় ৭২টি সংবাদমাধ্যমে মোট ২৩২ টি ভুয়া সংবাদ শনাক্ত করা গেছে।"
তিনি আরও বলেন, নতুন নতুন প্রযুক্তি, ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তার ভুয়া খবর তৈরি ও প্রসারের হার বাড়িয়েছে বহুগুণে। কেননা, সম্প্রচার ও মুদ্রণমাধ্যমের তুলনায় অনলাইনে ভুয়া তথ্য তৈরি এবং ছড়িয়ে দেওয়া যায় অনেক দ্রুত ও খুবই কম খরচেই।
তাছাড়া অনলাইন মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া অর্থাৎ টেক্সট, গ্রাফিকস, অডিও, ভিডিও এমনকি অ্যানিমেশন ব্যবহার করেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে কনটেন্ট তৈরি করা যায়।
সেমিনারে প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, "ফ্যাক্ট চেকিং এখন অনেক জটিল হয়েছে। অনলাইনে তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় আপস করতে হয়। তবে অনলাইনে ভুল হলে, সংশোধন করতে হবে, ভুল স্বীকার করতে হবে।"
ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, "সংবাদ সবার আগে প্রকাশের যে চাপ, তাতেও অনেক সময় ভুল হয়। গণমাধ্যমগুলোর উচিত নিজের কর্মীদের তথ্য যাচাই সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া, যাতে তারা ভুল তথ্যে পা না দেন।"
চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, "ভুল তথ্য বা ভুয়া তথ্যের সামনে আসলে, যেসব গ্রুপ থেকে এগুলো সংঘবদ্ধভাবে ছড়ানো হয়, সেগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে গণমাধ্যম কর্মীদের।"
দৈনিক বাংলার প্রধান প্রতিবেদক মোর্শেদ নোমান বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপপ্রচার, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যের যাচাই হয় না। গণমাধ্যমগুলোতে মিডিয়া ট্রায়াল দেখা যায়, যা উচিত নয়।
নাগরিক টিভির প্রধান প্রতিবেদক শাহনাজ শারমিন বলেন, গণমাধ্যমগুলোর নিউজরুমে প্রতিযোগিতা চলে। এই প্রতিযোগিতার ফাঁকে ভুয়া খবর একবার ছড়ালে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এএফপি বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির বলেন, দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোতে প্রায় প্রতিমাসেই ভুয়া খবর প্রকাশিত হয়। এসব খবরের বেশিরভাগের সোর্সই থাকে অনলাইনে, টুইটার থেকে নেওয়া। অথচ খুঁজলে এসবের কোনো অস্তিত্বও পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মী তথ্য যাচাই করতে ব্যর্থ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত কোর্স থাকেল তথ্য যাচাইয়ের চর্চা বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, "তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল ফ্যাক্টচেকের ওপর আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদর বিভাগের পাঠ্যক্রমে এ বছর থেকে ফ্যাক্টচেক যুক্ত হচ্ছে।"
এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের এদেশীয় প্রতিনিদি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহ মো. নাসির খান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ খান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরান হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষক সুমন রহমান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী আনিছ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম রেজওয়ান উল আলম প্রমুখ।