উৎপাদনের পর বাজারে বিক্রি হলেও, শুধু জেলে নৌকায়ই নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল
নদী, সমুদ্র ও দেশীয় জলাশয়ে মাছ ধরার বিশেষ যন্ত্র কারেন্ট জালের ব্যবহার ২০ বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ইলিশসহ দেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে থাকায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীতে জেলেদের নৌকায় প্রায় সময় অভিযান চালিয়ে কারেন্ট জাল জব্দ করে তা পুড়িয়ে দেয় আইনশৃংখলা বাহিনী ও মৎস্য বিভাগ। মাঝে মধ্যে জরিমানা দেওয়ার পাশাপাশি জেলও খাটে জেলে ও নদীপাড়ের জাল ব্যবসায়ীরা।
কিন্ত দেশব্যাপী এ রকম শতশত অভিযানেও কারেন্ট জাল ব্যবহার বন্ধ হয়নি। জেলেদের অভিযোগ তাদের নৌকায় একতরফা অভিযান করা হয়। কিন্ত কারেন্ট জাল উৎপাদন ও বাজারজাতে কোন অভিযান হয় না। ফলে কারেন্ট জাল উৎপাদন বন্ধ হয় না।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনাপাড়ের অন্তত ৫০ জন জেলে এবং ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
শুধু কারেন্ট জালই না, দেশের জলজ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন অসংখ্য জাল কারখানায় তৈরি হয়ে ঢাকার বাজার হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব জাল কারখানায় উৎপাদনে কেউ বাধা দেয় না। মাঝেমধ্যে নদী, খাল ও বিলে ব্যবহারের সময় অভিযানে ধরা হয় এসব জাল।
পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিজ্ঞানীরা ইলিশ, মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছ বিলুপ্ত হওয়ার জন্য এ জালকে দায়ী করছেন।
শনিবার জেলার মেঘনাপাড়ের কমলনগর উপজেলার নাসিরগঞ্জ এলাকায় নদী পাড়ে গিয়ে দেখা যায় ঘাটের নিকটে একটি নৌকা পড়ে আছে। পাড়ে বসে থাকা জেলে আমির জানান, নতুন নৌকাটি নদীতে নামার ২ দিনের মধ্যে নৌ পুলিশ জাল আটক করে নিয়ে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ টাকার জাল ছিল তার। এখন ১ মাস যাবত নৌকাটি ঘাটেই আছে। আবার নতুন জাল কেনার পয়সা মালিকের কাছে নেই। ওই নৌকায় ১০-১২ জন জেলেই এখন বেকার।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার মাছঘাটে প্রায় শতাধিক নৌকা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এসময় ৪৫টি নৌকা খুঁজে দেখলে ৩১টিতে কারেন্ট জাল পাওয়া যায়।
নিষিদ্ধ জেনেও জেলেরা কেন এ জাল কিনছে তা জানতে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর মতিরহাট, বাত্তিরখাল এবং আলেকজান্ডার ঘাটে অন্তত ১০-১২ জন জেলের সাথে কথা হয়।
এসময় বাত্তিরখাল ঘাটের জেলে আজগর জানান, এ জাল পানিতে দেখা যায় না। তাই এধরনের জাল এড়িয়ে চলা মাছের পক্ষে কঠিন। এ জালে ছোট বড় সব মাছ ধরা পড়ে। সহজে বহনযোগ্য, ওজন কম এবং সুতার জালের তুলনায় প্রতি কেজিতে দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এ জাল জেলেদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়।
জেলে আজগর আরো জানান, কারেন্ট জাল জেলেদের নিকট নিষিদ্ধ মাদকের মতো। কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে, বাজারে বিক্রি হয়, তাই জেলেরা নিষিদ্ধ জেনেও কারেন্ট জাল কিনছে। আলাপকালে সকল জেলে কারেন্ট জাল কারখানা থেকে উৎপাদন নিষিদ্ধ দাবি করেছিলেন।
জেলে কাশেম (২৭) নদীতে মাছ ধরেন ১৫ বছর। কাশেম বলেন, "কারেন্ট জাল অবৈধ দাবি করে জেলেদের নৌকা অভিযান করে নৌ পুলিশ ও মৎস্য বিভাগ। এতে জেলেরা অর্থনৈতিভাবে পুরো ধ্বংস হয়ে যায়। কাশেমের অভিযোগ কারখানায় উৎপাদনে কোনো বাধা নেই, ঢাকার পাইকারি বাজারে বিক্রি হতে বাধা নেই, খুচরা দোকানে সমস্যা নেই। সব সমস্যা আমাদের নৌকায়। এটা একতরফা এবং আমাদের গরিবের ওপর অত্যাচার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি।"
এসময় জেলে এমরান হোসেন জানান, কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হলে নৌ পুলিশের আর কোন অভিযান দিতে হবে না। জেলেরাও বেঁচে যাবে। তাদের জাল, নৌকা রক্ষা পাবে। উৎপাদন না থাকলে জেলেরা অন্য জাল ব্যবহারে উৎসাহিত হবে।
জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে জেলেরা এককভাবে কারেন্ট জাল ব্যবহার করতো। তবে এখন এককভাবে কারেন্ট জাল ব্যবহার কম। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলতে চিকন সুতার জালের সাথে কারেন্ট জাল মিশিয়ে ব্যবহার করে তারা।
জেলে এমরান, কাশেম এবং আজগর জানান, ১ কেজি জাল দৈর্ঘ্য ৩ ফুট এবং গভীরতা পাঁচ ফুট হয়। জেলেরা ৫টি জাল একত্রিত করে একটি ছড়া তৈরি করেন। এরকম একটি ছড়ার গভীরতা হয় ১৫ ফুট। যার মধ্যে ৩টি থাকে কারেন্ট জাল। আর একটি জালে ১শ থেকে ২শ ছড়া জাল থাকে।
একটি জালের ওজন হয় কমপক্ষে ৪০-৫শ কেজি। প্রতি কেজি কারেন্ট জাল তারা ক্রয় করেন ১ হাজার থেকে ১৪শ টাকায়। সুতার জাল প্রতি কেজি ৭শ থেকে ৮শ টাকা। কোন সমস্যা না ঘটলে একটি জাল ৪-৫ মাস ব্যবহার করা যায়। জেলেরা জানায়, প্রতি ছোট নৌকায়ও কমপক্ষে ১ লাখ টাকার জাল কিনতে হয়।
জেলে ছিদ্দিক জানায়, "নৌকা তৈরি ও জাল কিনতে গিয়ে জেলেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঋণের টাকায় জাল কেনার পরেই নদীতে নামলে নৌ পুলিশ নিয়ে যায় জাল।"
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুর ইসলাম জানান, মাছ ধরার বিশেষ ধরনের বস্তু কারেন্ট জাল। জেলেদের নিকট অতি পরিচিত কারেন্ট জালের রাসায়নিক নাম 'মনোফিলামেন্ট ফিশিং নেট'। কিন্তু, পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিজ্ঞানীরা মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছ বিলুপ্ত হওয়ার জন্য এ জালকে দায়ী করছেন।
কারেন্ট জালে ২৩ সেন্টিমিটারের ছোট ইলিশ মাছ বা জাটকা ধরা পড়ে। ইলিশের উৎপাদন সংকটের মধ্যে পড়েছে জাটকা নিধনের কারণে। সেকারণে ১৯৫০'র একটি আইন ২০০২ সালে সংশোধন করে ইলিশসহ মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে দেশে কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। কিন্তু কারেন্ট জাল ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি।
মৎস্য কর্মকর্তার দাবি, "নদীতে আমরা অভিযান করি। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ করতে না পারলে এটা পুরো বন্ধ করা যাবে না।"
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদেশে যে কারেন্ট জাল পাওয়া যায় তা উৎপাদন হয় মুন্সিগঞ্জ জেলার মুক্তারপুর ও সদর উপজেলা তিনটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে।
বাগবাড়ি, বিনোদপুর, নয়াগাঁও, মিরেশ্বরাই, সুতারপাড়, রিকারীবাজার, মালিগাও, মিরকাটিং, সিপাহীপাড়ায় ছোট বড় প্রায় পাঁচ শতাধিক জাল তৈরির কারখানা রয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কাজ করে এসবে। এসব কারখানায় অন্যান্য জালের সাথে লাখ লাখ মিটার কারেন্ট জাল তৈরি হয়। ঢাকার চকবাজার হয়ে সারাদেশে পৌঁছে যায় কারেন্ট জাল।
সদ্য বিলুপ্ত মুন্সিগঞ্জ জেলা জাল উৎপাদনকারী সমিতির সাবেক সভাপতি মহি উদ্দিন জানান, "২০০২ সালে সরকার আইন করে কারেন্ট জাল উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। তখন আমরা প্রায় ৫৬টি মামলা দায়ের করে কারেন্ট উৎপাদন করেছিলাম। কিন্ত ২০১৫ সালে উচ্চ আদালত সব মামলা খারিজ করে দিয়ে কারেন্ট জাল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।"
তিনি দাবি করেন এখন গোপনে ৭০-৮০টি কারখানায় কারেন্ট জাল উৎপাদন করে।
অন্যদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চায়না দুয়ারি নামের একটি জাল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে দেশীয় মাছ হুমকিতে পড়েছে। সে চায়না দুয়ারি জালও তৈরি হয় মুন্সিগঞ্জে।
এদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের 'বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট' প্রকল্পের এক সমীক্ষায় দেখানো হয় কারেন্ট জাল উৎপাদন বন্ধ করতে পারলে দেশে অতিরিক্ত সাড়ে তিন লাখ টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব।
মৎস্য অধিদপ্তর নভেম্বর হতে মে মাস পর্যন্ত ২৩ সেন্টিমিটারের বা ৯ ইঞ্চি নিচের ইলিশ ধরা এবং ৪.৫ সেন্টিমিটারের কম ব্যাসের জাল ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর সীমানা রয়েছে ৮৮ কিলোমিটার। যেখানে প্রায় ১ লাখ অধিবাসী মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত মৎস্যজীবির সংখ্যা ৫০ হাজার ২শ ৫২ জন। যার মধ্যে ৪০ হাজার রয়েছে ইলিশজীবি।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের অক্টোবরে ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য বিভাগ ২৭০টি অভিযান পরিচালনা করে ২৭টি মামলা করে। এসময় সাড়ে ২৫ লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
প্রতিবছর শুধু লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর সীমানায় কমপক্ষে ১শ কোটি টাকার কারেন্ট জাল আটক ও পোড়ানো হয় বলেও জানায় জেলা মৎস্য বিভাগ।