চসিকের গৃহকর পুনর্মূল্যায়নে বাড়ি মালিকদের স্বস্তি
'স্বামী মারা গেছেন দশ বছর। ৫ শতাংশ জমিতে সেমি পাকা বাসায় তিন মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছি। বছরের শুরুতে সিটি কর্পোরেশনের নোটিশ সেই কষ্টের জীবনে যেন বজ্রাঘাত ঘটালো। আগে গৃহকর দিতাম মাত্র ২১০০ টাকা, সেখানে নতুনভাবে কর নির্ধারণ করা হয় ১৫ হাজার টাকা! যা আমার পক্ষে কোনোভাবেই পরিশোধ করা সম্ভব ছিলো না। তবে আজ গৃহকর শুনানীতে তা ৩০০০ টাকা পুনঃনির্ধারণ হয়েছে। এটা আমাদের পরিবারের জন্য স্বস্তির খবর।'
বুধবার চট্টগ্রাম নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত 'এসেসমেন্ট রিভিউ বোর্ড এর শুনানী' শেষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন নগরের ৪ নং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের বাড়ইপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার।
একই এলাকার বাসিন্দা লায়লা বেগমকে একতলা একটি ভবনের জন্য ২০১০ সালে গৃহকর দিতে হতো ২ হাজার ৪০ টাকা। কিন্তু নতুন করে নির্ধারিত কর কাঠামায় তার গৃহকর দাঁড়ায় ২০ হাজার ৪০০ টাকা। আজ শুনানীতে লায়লা বেগমের গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন করে ৩ হাজার ৭৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ইয়াসমিন আক্তার বা লায়লা বেগমই নয়, এ দিন চসিক মেয়র রেজাউল করিমের উপস্থিতে 'বর্ধিত' গৃহকর নিয়ে নগরের ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। শুনানীতে অংশ নেওয়া বাড়ি মালিকদের বক্তব্য যাচাইবাছাই শেষে 'বর্ধিত' গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। যা স্বস্তি এনে দিয়েছে নগরবাসীর মনে। এসময় গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের পরপরই অনেকে তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধও করেন।
ইতোপূর্বে সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে চসিক সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করতো। ২০১৬ সালে তৎকালীন মেয়র আজম নাছির উদ্দিন 'পঞ্চবার্ষিকী কর মূল্যায়ন কর্মসূচি'র মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রণীত 'দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস' অনুসারে বাড়ি ভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিংয়ের কর নির্ধারণের কাজ শুরু করেন। যার ফলে চট্টগ্রাম নগরীর গৃহকর সর্বোচ্চ ৮ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
এসময় স্থাপনার আয়তন হিসেবে (আগের নিয়মে) হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে চসিকের ওই উদ্যোগ আটকে যায়। তবে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি নিজেদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর ভিত্তিতে জুলাই মাস থেকে নতুন নিয়মে কর আদায় শুরু করে চসিকের রাজস্ব বিভাগ। চসিকের নতুন ধার্য করা গৃহকরকে 'গলা কাটা' বলে মন্তব্য করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ।
৬ নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কালু মিয়াকে তিনকাঠা জমির উপর পাঁচতলা বাড়ির জন্য বার্ষিক ২০ হাজার ৭২৫ টাকা গৃহকর পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নতুন কর কাঠামোয় তার ওই বাড়ির জন্য চলতি বছর কর নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা; যা আগের চাইতে ৮২০ শতাংশ বেশি! শুনানীতে কালু মিয়ার আপত্তি আমলে নিয়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ কর ছাড় করেন মেয়র রেজাউল করিম।
শুনানীতে অংশ নিতে আসা কিছু গ্রাহককে বিড়ম্বনা পোহাতেও দেখা যায়। ইতোপূর্বে গ্রাহকদের গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের আবেদনের অধিকাংশই নিষ্পত্তি করা হয়নি। ফলে নতুন করে নির্ধারিত করের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়নি তাদের।
তাদের একজন আসহাব উদ্দিন (৬৫)। তিনি বলেন, 'প্রথমদিকে আমার তিনতলা বাড়ির জন্য কর দিতাম ১৭ হাজার টাকা। ২০১১-১২ সনে সেটি ভুলবশত ৫১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে আপিলের মাধ্যমে আমার গৃহকর ১৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু জুলাইতে পাঠানো নোটিশে পুরোনো শুনানী আমলে না নিয়ে নতুন করে ১ লাখ টাকা গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে। শুনানীতে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়েও পাইনি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র রেজাউল করিম বলেন, 'নগরবাসীর উপর যে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা আমি করিনি। তাই নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বলেছি এই কর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যুক্তিযুক্ত কারণ দেখিয়ে আপিল করলেই আমরা তা বিবেচনায় নেবো। আমি যতদিন মেয়র আছি নগরবাসীর উপর কোনো জুলুম হবে না।'
এনজিও কর্মী সৌরভ বড়ুয়া কাজল টিবিএসকে বলেন, 'টিনশেডের একটি বাড়ির জন্য আমি কর দিতাম মাত্র ৮৮২ টাকা। কিন্তু জুলাই মাসে চসিকের পক্ষ থেকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়, এখন থেকে ২৫ হাজার ১৬০ টাকা কর দিতে হবে। এই নোটিশ দেখে সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম, যাই হোক এই অবিচার মেনে নেবো না; তাই করদাতা সুরক্ষা পরিষদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। আজ শুনানীতে ২৫০০ টাকা গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ আজ তাদের আন্দোলনের ফল হাতে পেলো।'
চসিকের শুনানী পরিচালনা করেন এসেসমেন্ট রিভিউ বোর্ড এর সদস্য ১৪ নং লালখান বাজার ওয়ার্ড কমিশনার আবুল হাসনাত মো. বেলাল। উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, ৪ নং চান্দগাঁও ওয়ার্ড কমিশনার মো. এসরারুল হক ও ৫ নং মোহরা ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ কাজী নুরুল আমিন প্রমুখ।