মানা হয়নি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, মশা দমনে ভুল পদ্ধতিতে কোটি টাকা ব্যয় সিটি কর্পোরেশনের
প্রতিবছরই মশা নিয়ন্ত্রণে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। এ মশা নিয়ন্ত্রণেই গত ৬ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সম্প্রতি নিজেই স্বীকার করেছেন রাজধানীর মশা নিধনে এতদিন যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি ভুল ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে আতিকুল বলেন, "আমরা এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এতে মশা ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। আমরা মিয়ামিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ঢাকায় মশা নির্মূলে কাজে লাগাতে চাই।"
বাংলাদেশের কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা একাধিকবার সিটি কর্পোরেশনকে মশক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়েছেন এবং কীটনাশক প্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বলেছেন কিন্তু দুই সিটি কর্পোরেশন তাতে কর্ণপাত করেনি।
রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণের বাজেট প্রতি বছরই বাড়ে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা; যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন রেখেছে ৪৫.৭৫ কোটি টাকা।
কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম পরামর্শক অধ্যাপক কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশন আমাদের থেকে মশক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরামর্শ নিয়েছে কিন্তু সব পরামর্শ মানা হয়নি। হয়তো আমরা দেশি কীটতত্ত্ববিদ বলে আমাদের গুরুত্ব কম দিয়েছেন। এখন বিদেশে গিয়ে বিষয়গুলো স্বচোখে দেখে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, সেটা ভালো দিক।"
এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, "রাজধানী ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে বিষয়টি আমি বারবার বলে আসছি। এক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেগুলো হলো- পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, ক্যামিক্যাল বা কীটনাশক কন্ট্রোল এবং কমিউনিটি পার্টিসিপেশন।"
"কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে লার্ভিসাইডের দিকে আমরা জোর দিতে বলেছিলাম। ফগিংয়ে যতোটুকু না মশা মারা যায়, তার চেয়ে জনমানুষের ক্ষতি বেশি হয়।"
একই সুরে কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, "আমরা ফগিং এ নিরুৎসাহিত করে লার্ভিসাইডে গুরুত্ব দিতে দুই সিটি কর্পোরেশনকে অনেকবার পরামর্শ দিয়েছি কিন্তু সেগুলো তারা আমলে নেয়নি। এখন যেহেতু উত্তরের মেয়রের এ বিষয়ে ধারণা পাল্টেছে এজন্য তাকে ধন্যবাদ।"
তিনি বলেন, "ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে এখন যে লার্ভিসাইড ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো ব্যাকডেটেড। আমরা বিভিন্ন সময় এগুলো পরিবর্তন করে মশার ধরন অনুযায়ী লার্ভিসাইড আমদানির জন্য পরামর্শ দিয়েছি কিন্তু এখনও সেগুলো অনুমোদন পায়নি। আমরা মাঝে মাঝে পরামর্শক হিসেবে ২/১টি সেমিনারে সুযোগ পেতাম পরামর্শ দেওয়ার কিন্তু সে পরামর্শগুলোও আমলে নেয়নি সিটি কর্পোরেশন।"
তিনি বলেন, সারা বছরই সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা চালু রাখতে হবে। এজন্য যেমন লোকবল বাড়াতে হবে তেমনি অভিজ্ঞ লোকদের সমন্বয়ে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তিনি জানিয়েছেন, তারা এখন ফগিংয়ে অর্থ অপচয় না করে লার্ভিসাইডিংয়ে নজর দেবেন।
"আমরা দেখেছি মিয়ামি আর ঢাকার আবহাওয়া এবং মশার ধরন একই। তাই তারা সফল হলে অবশ্যই আমরা সফল হবো। এখন আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই। উন্নত দেশের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে ঢাকাকেও মশামুক্ত করা সম্ভব হবে", বলেন মেয়র।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেছেন, "যেহেতু মেয়র নিজেই মশা নিয়ন্ত্রণে ভুল পদ্ধতি ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছেন, তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত।"
এদিকে এবারের শীতে সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আটজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং পাঁচজনকে ঢাকার বাইরে ভর্তি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।
এছাড়া সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৭৪ জন রোগী। এর মধ্যে ২২৮ জন ঢাকায় এবং ২৪৬ জন ঢাকার বাইরের।
ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ছয়জনের প্রাণহানি ঘটেছে।