কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী
ডেঙ্গুর প্রকোপ না কমতেই এবার কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাজধানীবাসী। বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট কোথাও যেন নিস্তার নেই। বিশেষ করে সন্ধ্যা না হতেই এ মশার উপদ্রব বাড়ে। রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার চিত্রই এমন।
বাড্ডা এলাকায় একটি আবাসিক ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় থাকেন শাহিদা বেগম। কয়েকদিন ধরে মশার উপদ্রবে তিনি অতিষ্ঠ। বিকাল হলেই ছয় মাসের সন্তানকে মশা থেকে বাঁচাতে মশারির ভেতরে রাখতে হয় তার।
শাহিদা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মশার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। বাচ্চাকে মশারির মধ্যে রেখেও রেহাই নাই। আমাদের এদিকে সিটি করপোরেশনের মশক কর্মীদেরও দেখা যায় না। মশার কামড়ে পরিবারের সবার ত্বকে দাগ পড়ে গেছে।'
রাজধানীর ইস্কাটন এলাকার রিকশাচালক সুব্রত ধর টিবিএসকে বলেন, 'সন্ধ্যার পরে রিকশা থামিয়ে কোথাও দুই মিনিটও বসা যায় না। মশা মনে হয় তুলে নিয়ে যাবে। যেদিন এলাকায় মশা তাড়াতে সিটি কর্পোরেশন থেকে ধোঁয়া দেওয়া হয়, সেদিন মশার উপদ্রব আরও বেশি থাকে।'
শুধু এই দুই এলাকায়ই নয়, ঢাকার অধিকাংশ এলাকাতেই বেড়েছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। দেশে এডিস মশা সংক্রমিত রোগ ডেঙ্গুর প্রভাব কমে আসলেও কিউলেক্স মশায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় এ মশার উপদ্রব দেখা যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্প্রতি করা এক গবেষণায়ও কিউলেক্স মশার বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভাগটিরই অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীতে গত চার মাসে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। এ গবেষণার জন্য পাতা ফাঁদে জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০টিরও বেশি পূর্ণবয়স্ক মশা ধরা পড়ে। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা এবং বাকি ১ শতাংশ এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া।
এর আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে ফাঁদে মশা ধরা পড়েছিল ২০০টিরও কম। আর ডিসেম্বরে একই ফাঁদে মশার সংখ্যা ছিল ২৫০টি।
গবেষণার তথ্য বলছে, এ ধারা চলতে থাকলে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত তা বেড়ে চরমে পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।
ড. কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, 'জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মশা ফাঁদে পড়েছে। রাজধানীর চার এলাকার পাঁচটি স্থানের মধ্যে উত্তরায় মশা সবচেয়ে বেশি। উত্তরায় প্রতিদিন ৪৫০ টির বেশি মশা ফাঁদে পড়েছে। এত সংখ্যক মশা নগরের কোথাও দেখা যায়নি। উত্তরার পর সবচেয়ে বেশি দক্ষিণখানে ৪১০ ও মিরপুরে ৩৫০টির মতো পূর্ণবয়স্ক মশা ধরা পড়েছে।'
তিনি বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণে উত্তরের তুলনায় জলাশয় কম থাকায় কিউলেক্স মশা কিছুটা কম। গবেষণায় দেখা গেছে, রায়েরবাগ এলাকায় দিনে সর্বোচ্চ ৩৫০টির মতো, এরপর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় ২০০টি মশা ধরা পড়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'কিউলেক্স মশা স্বাস্থ্যগতভাবে তেমন ক্ষতি না করলেও এটি মানুষকে বিরক্ত করে। বাংলাদেশের কিছু জায়গায় কিউলেক্স মশা ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ ছড়ানোর প্রমাণ থাকলেও ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় এই রোগের সংক্রমণের তথ্য নেই।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনই মশা নিয়ন্ত্রণে নানা পরিকল্পনার কথা বলছে। তবে তাদের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ও যথাযথ নয়। দুই সিটি কর্পোরেশন ড্রেন, ডোবা, নালা পরিষ্কারের কার্যক্রম হাতে নিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পরিষ্কারের সাথে সাথে লার্ভা থেকে যাতে প্রাপ্তবয়স্ক মশা না হতে পারে এজন্য লার্ভিসাইড করে মেরে ফেলতে হবে।
ধোঁয়া উড়িয়ে যে মশা মারার চেষ্টা করা হচ্ছে এতে মশা খুব একটা মড়ছে না বলেও দাবি তাদের।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশে ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। এর মধ্যে ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে যে কয়েক প্রজাতির মশা থাকে, এর মধ্যে কিউলেক্সই ৯৫ শতাংশের বেশি।
দেশে কিউলেক্স মশার প্রভাব দেখা দেয় অক্টোবর থেকে। অবশ্য শীতের তীব্রতা বাড়লে মশার কামড়ের মাত্রা কমে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকেই কিউলেক্সের দাপট বাড়ে। প্রতিবছর এ সময় দীর্ঘ দিন বৃষ্টি না হওয়ায় ডোবা বা নালা-নর্দমার পানির ঘনত্ব বাড়ে। এতে পানিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কিউলেক্স মশা প্রচুর খাদ্য পায়। এতে বংশ বিস্তার বেড়ে যায়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রুবাইয়াত ইসমত অভীক টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় খাল, ড্রেন অনেক দিন ধরে বদ্ধ অবস্থায় থাকায় সেসব স্থানে মশার ঘনত্ব কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। ওসব জায়গায় ওষুধ দিয়েও তেমন কাজ হতো না। আমরা ওসব জায়গায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান পরিচালনা করছি। আশাকরি কিছুদিনের মধ্যে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন স্থানে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের চলার কারণে সেখানে ড্রেনগুলোর মুখ আটকে থাকায় আমাদের পরিষ্কার কাজে বেগ পেতে হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, অন্যান্য যেকোনও বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকা দক্ষিণের কিউলেক্স মশার ঘনত্ব কম। আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। অন্যান্য বছর এই সময়ে মানুষ মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে যেত। এবার এখনো কোনো এলাকা থেকে একটি অভিযোগও আসেনি।