ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে না পারায় ফুরিয়ে আসছে বিক্রিয়যোগ্য রিকন্ডিশন্ড গাড়ি
ডলার সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার অনুমতি পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। পুরাতন এলসিতে কেনা গাড়ির মজুদও এখন প্রায় ফুরিয়ে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে গাড়ি ব্যবসার খাত হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে গাড়ির যে মজুদ রয়েছে, তাতে কেবল সামনের এক থেকে দুই মাস বাজারে গাড়ির সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভব; পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে, রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসায়ে নিশ্চিতভাবেই ধস নামবে।
"আমরা ইতোমধ্যে সরবরাহ সংকটে রয়েছি। এই অবস্থা চলতে থাকলে দুই-তিন মাস পর বাজারে কোনো রিকন্ডিশন্ড গাড়ি পাওয়া যাবে না," বলেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)-এর সভাপতি মোঃ হাবিব উল্লাহ ডন।
"সরকার বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমাতে কঠোর ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গত বছরের শেষের দিকে রিকন্ডিশন্ড গাড়িসহ ২৩ ধরণের পণ্যের ওপর শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করেছে। যদিও আমাদের ব্যবসায়ীরা মার্জিন পরিশোধ করে তাদের আমদানি চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক, তবে অধিকাংশ ব্যাংক আমাদের ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে এই সংকট আরও বাড়ছে।"
ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উপায়ে পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছে উল্লেখ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "গত বছরের অক্টোবর থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। চলতি মাসে তো এটি প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।"
বারভিডার সভাপতি জানান, তিনি তার ৩২ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে আগে কখনও এমন পরিস্থিতি দেখেননি। "দীর্ঘ সময় ডলার সংকটের ক্ষেত্রে, আমাদের বিশ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের ব্যবসা এবং কয়েক হাজার চাকরি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনীয় যানবাহন পাওয়াটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।"
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের (এমপিএ) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোংলা বন্দর দিয়ে দেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়েছিল ৯ হাজার ২১৩ টি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুটা কম।
২০২২ অর্থবছরজুড়ে প্রায় ২১ হাজার ৪৮৪টি গাড়ি এই বন্দর দিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে এসেছে ১৩ হাজার ৯৭৫টি।
বারবিডা'র মোংলা বন্দরের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান আরজু বলেন, "অন্যান্য বছর প্রতিমাসে ৩ থেকে ৪ টি জাহাজ গাড়ি নিয়ে মোংলা বন্দরে আসতো। তবে এ অর্থবছর মাসে একটির বেশি জাহাজ আসছে না। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি নিয়ে আসা জাহাজের সংখ্যা আগের অর্থবছরের তুলনায় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।"
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বর্তমানে মোংলা বন্দরের বিভিন্ন শেডে গাড়ি রয়েছে ১ হাজার ২ টি। ডলার সংকট শুরু হওয়ার আগে পুরাতন এলসি দিয়ে আমদানি করা হয়েছে এসব গাড়ি।
"আরেকটি জাহাজ ৩০০ থেকে ৪০০ গাড়ি নিয়ে বন্দরে আসবে, তবে তা আসবে ফেব্রুয়ারিতে। এখন এলসি না করতে পারলে এই অর্থবছরে আর গাড়ি আনা সম্ভব হবে না," যোগ করেন তিনি।
মোংলা বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩ জুন মোংলা বন্দর ব্যবহার করে প্রথম জাপান থেকে ২৫৫টি গাড়ি আমদানি করে ঢাকার হক'স বে অটোমোবাইলস। এরপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও গাড়ি আমদানির জন্য এ বন্দর বেছে নেয়। তাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোংলা দিয়ে আসে ৩ হাজার ১১৯টি গাড়ি। ২০১০-১১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯২৫টিতে।
মোংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান বলেন, "২০২১-২২ অর্থবছরে মোংলা কাস্টমসের মোট আয়ের শতকরা ৫২ শতাংশ এসেছিল গাড়ি আমদানির শুল্ক থেকে। তবে এই অর্থবছরে তা হবে না। কারণ গত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- টানা তিনমাস গাড়ি আমদানি খাত থেকে আমাদের শুল্ক হ্রাস পাচ্ছে।"
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০২১ সালের ডিসম্বরে মোংলায় বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ২৮৯ টি। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর গাড়ি আমদানি হয়ে মাত্র ৩৮৯টি। অর্থাৎ ৭০ শতাংশ গাড়ি কম এসেছে। সুতরাং ওই মাসে শুল্কও ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
"শুধু মোংলা বন্দর নয়, প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের অবস্থাও একই। আমাদের আমদানি থেকে সরকার সাধারণত প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। চলমান পরিস্থিতির কারণে, এ খাত থেকে রাজস্বের একটি বড় অংশ কমে যাবে," বারভিডার সভাপতি মোঃ হাবিব উল্লাহ ডন উল্লেখ করেন।
বাণিজ্য সংস্থার তথ্য বলছে, দুই সমুদ্রবন্দর মিলিয়ে আগে যেকোনো সময় প্রায় ৬-৭ হাজার যানবাহন শুল্ক ছাড়পত্রের জন্য প্রক্রিয়াধীন থাকত; কিন্তু এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২ হাজারে।
বারভিডার সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, যারা আমদানিনির্ভর ব্যবসা করেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
"রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করছে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। এর ফলে আমরা গাড়ি আমদানিকারকরা প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এখন আমরা ব্যবসা চালাতে এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি," যোগ করেন তিনি।
মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স এমনকি প্রাইভেট কারের মতো যানবাহন, বিশেষ করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, এগুলো বিলাসবহুল নয়। এগুলো কেবল প্রয়োজনীয় যানবাহন, হিসেবে উল্লেখ করেন বারভিডার সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন।
তিনি সরকারের প্রতি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান, যাতে তারা সাধারণ সময়ে যা আমদানি করেন, এখন অন্তত তার এক-তৃতীয়াংশ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বাজারে যানবাহনের ন্যূনতম সরবরাহ নিশ্চিত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।