বালুতে বিলীন নদী
পানির ছিটেফোঁটাও নেই। চারদিকে কেবল ধু ধু বালু। দেখে মনে হয় বালুর স্তুপ, অথচ এটি একটি নদী।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর অবস্থা এমনই। তাও দুয়েকবছর নয়, দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এমন অবস্থায় রয়েছে নদীটি। বালু জমে হারিয়ে গেছে নদী।
পিয়াইন নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে আশপাশের এলাকায়। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে পিয়াইন নদীর অবস্থান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে অস্তিত্ব হারিয়েছে পিয়াইন নদী। পাথর উত্তোলন বন্ধ না হলে পাশ্ববর্তী ডাউকি নদীও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঢালু এলাকা দিয়ে পানির ঢল নামে। আগে এই ঢলের পানি পিয়াইন নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। এখন নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে পানি। ফলে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা ও ভাঙ্গন। কিছুদিনে আবার শুরু হচ্ছে বৃষ্টির মৌসুম। ফলে আবারও ভাঙ্গন ও জলাবদ্ধতার শঙ্কায় ভুগছেন স্থানীয়রা।
গোয়াইনঘাটের সংগ্রামপুঞ্জির বাসিন্দা জোসেফ তাংচং বলেন, এক সময় পিয়াইন নদী দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করত।
"কিন্তু ১৯৮০ এর দশকের ভয়াবহ বন্যা, অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন এবং অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ফলে নদীটি ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গেছে," তিনি বলেছিলেন।
স্থানীয় ৩নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান লেবু বলেন, পাহাড়ে বৃষ্টি হলে এইদিকে ঢল নামে। কিন্তু পিয়াইন নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ঢলের পানি আর এখন নদী দিয়ে যেতে পারে না। পানি আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
"এতে আমার ইউনিয়নের নদী-তীরবর্তী বসতবাড়ি ও জাফলং চা বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢল নামলেই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়," বলেন তিনি।
সিলেট পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, পিয়াইন নদী মরে যাওয়ায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র জাফলং।
"এক সময়ের প্রমত্তা এ নদী রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে খনন করে দ্রুত এর নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে," যোগ করেন তিনি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের খসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে পলি ও বালু এসে ভরাট হয়ে যায় পিয়াইন নদীর উৎসমুখ। সে সময় নদীর উৎসমুখ থেকে পাদুয়া হয়ে ঢালারপাড় পর্যন্ত চার কিলোমিটার নদী ভরাট হয়ে যায়। সেই থেকে শুষ্ক মৌসুমে পুরো পানিহীন থাকে নদী। আর বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে প্লাবিত হয়ে পড়ে আশপাশের এলাকা। এতে গত কয়েকবছরে নদীর আশপাশের অনেক স্থাপনা ও জাফলং চা বাগানের ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদীটি ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়ায় এটি খনন করা যাচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পিয়াইন নদীর উৎপত্তি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ওমগট নদী থেকে। গোয়াইনঘাটের জাফলং দিয়ে এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এরমধ্যে পিয়াইন নদী সীমান্তঘেঁষে গোয়াইনঘাট থেকে কোম্পানীগঞ্জ গিয়ে ধলাই নদীতে মিলিত হয়েছে। অপরদিকে, আরেকভাগ ডাউকি নামধারণ করে জাফলং-বল্লাঘাট হয়ে সারী-গোয়াইন নদীর সঙ্গে মিশেছে।
২০১৯ সালের মে মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান পিয়াইন নদী পরিদর্শনে আসেন। এসময় তিনি নদীটি খননে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে এখন পর্যন্ত এই নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, "ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী হওয়ায় এটি খননে ভারতের সম্মতি প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।"