আমনের শুরুতে থাকবে খরা, এবারও নির্ভর করতে হবে সেচ পাম্পের ওপর
চলতি বোরো মৌসুমের ধান কাটার পর যে সময়টা আমন রোপনের, তখনই খরার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশ। আবহাওয়ার বিভিন্ন পূর্বাভাস বলছে, তখন স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হবে। আর বৃষ্টি নির্ভর ধানের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদন মৌসুমে খরার কারণে ধান লাগনোই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
তাই সময়মতো আমন চাষে কৃষকদের অতিরিক্ত সেচ সুবিধার প্রয়োজন পড়বে, যা বাড়িয়ে দেবে উৎপাদন খরচ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আমন মৌসুমের শুরুতে এবার এল নিনোর কারণে বৃষ্টিপাত কম হতে পারে। যা একদিকে ফসল রোপন, অন্যদিকে উৎপাদনশীলতা, উভয়ের ওপরেই প্রভাব ফেলবে। কারণ বাংলাদেশে আমন ফসল পুরোপুরি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল।
কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, গত আমন মৌসুমে খরার কারণে ধান লাগাতে দেরি হয়েছিল। বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএডিসি)-এর তথ্যমতে, সে সময় খরা মোকাবেলা করে সেচ প্রদানের জন্য ৫ থেকে ৬ লাখ সেচ পাম্প ব্যবহার করতে হয়েছে সারাদেশে। যেখানে সেচ নির্ভর বোরো মৌসুমে প্রায় ১৬ লাখের বেশি সেচ পাম্প ব্যবহার করা হয়। মূলত জুন-জুলাই মাসে সারাদেশে আমনের লাগানো হয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবারও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসকে বলেন, "যে বছরগুলোতে এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, সে বছরে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং খরার প্রবণতা বেড়ে যায়। এবারও বিভিন্ন আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলে এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ।"
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থার পূর্বাভাসের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে মে, জুন, জুলাই- এই তিন মাসে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হতে পারে। তবে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হবে। এজন্য আসন্ন আমন মৌসুমের শুরুতে গত বছরের মত সেচ পাম্পের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে।"
জানা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৯৬ মিলিমিটার। কিন্তু, ২০২২ সালের জুলাই মাসে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার (মিমি), যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৪৭১ মিলিমিটার।
খরায় উৎপাদন খচর বৃদ্ধি
কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মন্ডল টিবিএসকে বলেন, "খরার স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে এটা সেচের মাধ্যমে অনেকটাই কাভার করা যায়। এর জন্য অবশ্য খরচ বাড়বে।"
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ খরচও বাড়বে, বাড়বে সামগ্রিক উৎপাদন খরচ। এছাড়া, খরা ও খরচের চাপে কম জমিতে ধান রোপণ করলে মোট উৎপাদনও কমে যাবে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা সুজন মিয়া চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদেরকে বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে জমিতে সেচ সুবিধা দিচ্ছেন। এ বছর তিনি পুরো মৌসুমে প্রতি বিঘা (৩৩ দশমিক) জমিতে পানি দেওয়ার জন্য ৩ হাজার ৩০০ টাকা নিচ্ছেন; গত বছরে নিয়েছিলেন ৩ হাজার টাকা।
টিবিএসকে সুজন বলেন, "জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের দাম বেড়েছে (বিঘা প্রতি ৫,০০০ টাকা), যা গত বছর ৪,০০০ টাকার কম ছিল।"
এদিকে, সরকার সব ধরনের সারের দাম ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে চলতি মাসেই। বোরো মৌসুমে এর প্রভাব না পড়লেও আমনজুড়ে এর প্রভাব থাকবে। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণে সেচ পাম্প লাগালেও তার খরচ বেড়ে যাবে। শ্রমিক নিয়ে সংকটের কারণে বাড়তি মজুরি মিলে উৎপাদন খরচের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। আবার খরা এবং খরচের চাপে কম জমিতে ধান লাগালে সেটিও মোট উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।
কারণ বোরো মৌসুমের পর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ধানের উৎপাদন আসে আমন থেকে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অন্যতম ভূমিকা রাখে। গত বছর বোরো মৌসুমে ২.০২ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে এবং আমন মৌসুমে ১.৫৫ কোটি টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, যা পূরণ হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, খরা, শ্রম ব্যয় ও সার বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে আমন উৎপাদনের খরচ বেড়েছে।
২০২১ সালে প্রতিকেজি আমন ধানের উৎপাদন খরচ ছিল ২৫ টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে ২৮.৬২ টাকা হয়েছে।
ব্রি-এর মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির টিবিএসকে বলেন, "আমরা সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছি। আমন মৌসুমে বর্তমান বৃষ্টিহীন অবস্থা বিরাজ করলেও কৃষকদের বিকল্প পদ্ধতিতে, অর্থাৎ সেচের মাধ্যমে ধান রোপণের পরামর্শ দেওয়া হবে। তাই সময়মতো ধান রোপণ করা হবে বলে আশা করা যায়, কারণ দেরি হলে তা উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে।"
এছাড়া, খরা মোকাবেলা করে টিকে থাকার মত ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি-৫৬, ৫৭, ৭১ ধানের জাত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে আমনের শুরুতে সম্ভাব্য খরার বিষয়ে কৃষকদের সতর্ক করেনি সরকার। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, জামালপুরসহ কয়েকটি জেলার কৃষকরা টিবিএসকে জানান, এ ধরনের কোনো নির্দেশনা না থাকায় তারা বৃষ্টিপাতের আশায় রয়েছেন।
দিনাজপুরের কৃষক মিলন মিয়া টিবিএসকে বলেন, "গত বছর আমরা বৃষ্টির অপেক্ষা করেছিলাম এবং নির্ধারিত সময়ের এক মাসেরও বেশি সময় পরে ধান রোপণ করেছি। এবারও খরা হবে কি-না তা জানিনা। সরকার বললে আমরা সেচ মাধ্যমে চাষ করবো।"
ভারত ও অন্যান্য দেশেও খরার আশঙ্কা
ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী জুন-সেপ্টেম্বরে খরার সতর্কতা জারি করেছে ভারত সরকার। বলা হয়েছে, ধান, ভুট্টা, বেত, তুলা এবং সয়াবিনের মতো ফসল উৎপাদন এল নিনোর প্রভাবে সৃষ্ট খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এল নিনো অবস্থার কারণে খরা পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ কমে গিয়ে দাম বেড়ে যেতে পারে।
ভারতে ধান, ভুট্টা, বেত এবং তুলা উৎপাদন কমলে তা বিশ্ব বাজারে প্রভাব ফেলবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। কারণ সংকট হলে আমদানির বদলে ভারত নিজেই তখন চাহিদা মেটাতে নির্দিষ্ট পণ্যের রপ্তানি করবে।
এদিকে, গেল ৬০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে খারাপ খরার সম্মুখীন হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। ফলে এ বছর দেশটিতে ২০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ফসলের ক্ষতি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
খরার কারণে এবার ব্রাজিলের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া চীনে তাপপ্রবাহ ও আমেরিকার খরাও প্রভাব ফেলছে ফসল উৎপাদনে। এতে বিশ্বব্যাপী তেল, চিনি, গমসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতালি, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে খরা
শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) ব্লুমবার্গ গ্রিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুসারে, স্পেনের সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার কর্ডোবা বিমানবন্দরে তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (প্রায় ১০২ ফারেনহাইট)। এশিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়ানোর পরের সপ্তাহেই স্পেনের পরিস্থিতি এমন হলো।
ফ্রান্সের দক্ষিণ ও ইতালির উত্তরাঞ্চলসহ স্পেনের বেশিরভাগ অংশজুড়ে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করছে। ইউরোপের খরা নজরদারী সংস্থার মতে, পূর্ব এবং দক্ষিণ কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলগুলোও খরার চাপে রয়েছে। দক্ষিণ ইউরোপ ছাড়াও নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের বড় অংশে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করছে।
তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একই রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন খরা পর্যবেক্ষণ সংস্থার সর্বশেষ তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের (৪৮টি রাজ্য) প্রায় ২৫.৫৫ শতাংশ এখন খরার সম্মুখীন। এর বেশিরভাগই মধ্য ও নিম্ন সমভূমি, যেমন- কানসাসের ৮১.৯২ শতাংশ এবং টেক্সাসের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এখন খরার সম্মুখীন।