সংকেত কর্মী সংকটে ঝুঁকিতে দেশের রেল যোগাযোগ
রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন আছে কি না বা ট্রেন স্টেশন পার হবে কি না— এসব নির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় সংকেত কর্মীর। সংকেত ব্যবস্থাপনা সচল রাখা, যান্ত্রিক ত্রুটি শনাক্ত ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে রেললাইনকে সার্বক্ষণিক নিরাপদ রাখার এই দায়িত্ব মেইনটেইনার সিগন্যাল (এমএস)-এর। অথচ বাংলাদেশ রেলের এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে জনবল সংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ট্রেন চলাচল।
জানা যায়, রেলওয়ের চাহিদার ৩০ শতাংশ সংকেত কর্মী নেই। এজন্য দিনের ১৬ ঘন্টা সংকেত কর্মী থাকে না স্টেশনগুলোতে। এতে আশঙ্কা বাড়ছে দুর্ঘটনার।
রেলওয়ের তথ্যমতে, প্রতিটি স্টেশনের দুই পাশের ১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সংকেত বিভাগে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম। প্রতিটি স্টেশনে আগে ওয়ার্নিং সিগন্যাল, আউটার সিগন্যাল ও হোম সিগন্যাল নামে তিনটি অতিক্রিম করতে হয়। কালো, লাল, হলুদ ও সবুজ সংকেতের মাধ্যমে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। পুরো সংকেত ব্যবস্থাপনা সচল রাখার দায়িত্ব থাকে এমএসের ওপর। এছাড়াও স্টেশনের ভেতরে সংকেতের অটোমেটিক যন্ত্রপাতি দেখভালও করেন তারা। তাদের সহকারি হিসেবে কাজ করেন খালাসীরা। নিরাপদ ট্রেন যাত্রা, সময়মতো ট্রেন চালানোর বিষয়টি অনেকটা তাদের ওপর নির্ভর করে।
সোনার বাংলা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা
গত ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে হাসানপুর স্টেশনে দ্রুতগতির সোনার বাংলা ট্রেন সংকেত ত্রুটির কারণে অপেক্ষমান মালবাহী ট্রেনে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে।
এতে অন্তত ৫০ জন যাত্রী আহত হওয়ার পাশাপাশি ট্রেনের ৭টি কোচ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংকেত ত্রুটি এবং কন্ট্রোলিংয়ে দুর্ঘটনা ও অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত মেইনটেইনার সিগন্যাল (এমএস) এর ডিউটি শেষ হওয়ায় সংকেত ত্রুটির বিষয়টি খেয়াল করেনি কেউ।
মালবাহী ট্রেন থাকার পরেও রেল লাইন বন্ধ করেননি স্টেশন মাস্টার। ওই সময় লোকোমাস্টাররা ট্রেনে বসে ইফতার করায় সংকেত ত্রুটির বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। ফলে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
সোনার বাংলা ট্রেন দুর্ঘটনার সময়টি নির্ধারিত অফিস সূচির বাইরে হলেও স্টেশন ত্যাগ করায় এমএস মো. আবদুল ওয়াহিদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সিগন্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এএমএম ইলিয়াস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নিরাপদ ট্রেন পরিচালনার স্বার্থে সংকেত কর্মীরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তবুও ডিউটি শেষে স্টেশন ত্যাগ করায় একজন এমএসকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি অবিচার।"
কাজের সময়সূচি
মেইনটেইনার সিগন্যাল বা এমএসরা একসময় সার্বক্ষণিক (২৪ ঘণ্টা) দায়িত্বে থাকতেন।
আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সাল থেকে তাদেরকে 'কন্টিনিউয়াস স্টাফ' বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, ৮ ঘন্টা ডিউটি করবেন তারা।
'কন্টিনিউয়াস স্টাফ' বিবেচনার পর প্রতিটি স্টেশনে তিন শিফটে তিনজন এবং আপৎকালীন অতিরিক্ত একজনসহ মোট চারজন এমএস থাকার কথা। কিন্তু এখনো প্রতিটি স্টেশনে আগের মতো একজনই দায়িত্ব পালন করেন।
সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করেন এমএস-খালাসীরা। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বাকি ১৬ ঘন্টা অরক্ষিত থাকে সংকেত বিভাগ ও এর সরঞ্জাম। তখন সংকেতে ত্রুটি হলে দেখার কেউ থাকে না।
কর্মী সংখ্যা
রেলওয়ের সংকেত বিভাগের তথ্যমতে, পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে ১৭১টি স্টেশন ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৮৯টি সেটশন চালু আছে।
জনবল কাঠামো অনুসারে পূর্বাঞ্চলে মঞ্জুরীকৃত এমএস পদ ১৮৫টি ও খালাসী ২৩৯টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে মঞ্জুরীকৃত এমএস ৮৭টি ও খালাসী ১৬৯টি।
এমএসদের কন্টিনিউয়াস স্টাফ শ্রেণিভুক্ত করার পর রেলের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে চাহিদা নিরূপণ করা হয়। ২০২০ সালে পূর্বাঞ্চলে মঞ্জুরীকৃত পদের ৩ দশমিক ২৫ গুণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ৩ দশমিক ২ গুণ চাহিদা দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে দপ্তরে। এ হিসেবে পূর্বাঞ্চলে প্রয়োজন ৬০১ জন এমএস ও ৭৭৭ জন খালাসী এবং পশ্চিমাঞ্চলে ২৭৮ জন এমএস ও ৫৪১ জন খালাসী।
এর বিপরীতে কর্মরত আছেন পূর্বাঞ্চলে ৮২ জন এমএস ও ২৩৫ জন খালাসী এবং পশ্চিামাঞ্চলে ৬০ জন এমএস ও ১৬৯ জন খালাসী। প্রতি স্টেশনে চারজন এমএসের পরিবর্তে কোথাও চারটি স্টেশনে মাত্র একজনও থাকেন।
রেলওয়ের সংকেত বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কন্টিনিউয়াস স্টাফ শ্রেণিভুক্তকরণের আগে ২০২০ সালে মাঝামাঝিতে চাহিদা নিরূপণ করে দপ্তরে পাঠানো হয়। কিন্তু তিন বছরেও তা অনুমোদন পায়নি।
পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা সেতু রেল লিংক, মংলা, ও গোপালগঞ্জ ও পাবনা নতুন রুট চালুর পর স্টেশন সংখ্যা বেড়েছে। অথচ মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা কমানো হয়েছে। খালাসীদের স্টেশনে স্টেশনে মাইকে যাত্রার তথ্যও ঘোষণা করতে হয়।
এ বিষয়ে বেলওয়ের সংকেত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আদালতের রায় শুধু কাগজে-কলমে
একসময় রেলের সংকেত কর্মীরা ২৪ ঘন্টা অর্থাৎ, সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতেন।
তারা কোন ছুটি পেতেন না। স্টেশনও ত্যাগ করতে পারতেন না। বিষয়টি নিয়ে ২০০৯ সালে তারা মামলা করেন।
২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে তাদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে বলা হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলেও ২০১৭ সালে চূড়ান্ত রায় আসে সংকেত কর্মীদের পক্ষে।
তা বাস্তবায়ন ও সংকেত কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নির্দেশনা জারি করা হয়। এরপরও পর্যাপ্ত সংকেত কর্মী নিয়োগ না করায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাদের। বিপরীতে ওভারটাইম বা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান টিবিএসকে বলেন, "জনবল কাঠামে নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতা ছিল। এখন ধাপে ধাপে সবগুলো বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।"