সিটি নির্বাচন: গাজীপুরের ফলের প্রভাব সিলেটেও
বর্তমান মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী না হওয়ায় এবার সিলেট সিটিতে প্রতিদ্বন্দিতাহীন নির্বাচনের ধারণা করা হচ্ছিলো। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সহজেই জয় পেতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করেছিলেন দলটির অনেকেই। তবে তাদের এমন ধারণায় বাধ সেধেছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফল।
গাজীপুরে ছায়াপ্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতার পরাজয়ে সিলেটে নড়েচড়ে বসেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও নেতারা। আরিফের প্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর তাদের প্রচারে কিছুটা ঢিলেমি এলেও গাজীপুরের ভোটের পর আবার আটঘাঁট বেধে মাঠে নেমেছেন তারা।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলের প্রভাব পড়েছে সিলেটের অন্য প্রার্থীদের উপরও। গাজীপুরের মতো চমক দেখাতে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগেই মাঠ সরগরম করে রেখেছেন তারা। এছাড়া ইভিএম আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন তারা। তবে গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফল তাদের শঙ্কা কাটিয়ে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।
গত ২৫ মে ইভিএমে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী, দলটির বর্ষীয়ান নেতা আজমত উল্লাহ খান। তাকে প্রায় ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন।
আগামী ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে। সিলেটে মেয়র পদে ১১ জন মনোনয়নপত্র জমা দিলেও ৫ জনের বাতিল হয়। ফলে এখন লড়াইয়ে রয়েছেন ৬ প্রার্থী।
সিলেটে এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় দলটির যুক্তরাজ্য শাখার নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে প্রবাসী একজনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় শুরু থেকেই ক্ষোভ ছিলো আওয়ামী লীগের মধ্যে। প্রকাশ্যে প্রচারে থাকলেও ভেতর থেকে দলের অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না আনোয়ারুজ্জামানকে।
স্থানীয়দের এই ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে সম্প্রতি সিলেটে আওয়ামী লীগের কর্মীসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে গত ৪ মে আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, 'দলে খন্দকার মোশতাকের অনুসারী যেমন রয়েছে, তেমনি মুজিব আদর্শের লড়াকু এবং ত্যাগী কর্মীরাও রয়েছেন। মোস্তাক বাহিনীর কারণেই বিগত দিনে এই নগরের অভিভাবক বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারতে হয়েছে। এবার সেই সুযোগের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ।'
গাজীপুরে একজন ছায়াপ্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতার পরাজয় ভাবাচ্ছে দলটির সিলেটের নেতাকর্মীদেরও। যদিও প্রকাশ্যে তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। সিলেটে গাজীপুরের মতো কিছু হবে না বলেই দাবি করছেন তারা।
আওয়ামী লীগের মহানগর কমিটির সম্পাদকীয় পদের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'দলের মধ্যে কিছু বিভেদ সত্ত্বেও আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী না হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী অনেকটা সহজেই জিতে যাবেন বলে মনে করছিলেন দলের অনেকে। কিন্তু গাজীপুরের ফল তাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তারা নড়েচড়ে বসেছেন। গাজীপুরে একজন ছায়াপ্রার্থী যেভাবে বর্ষীয়ান একজন নেতাকে হারিয়ে দিলেন তা সবাইকে ভাবাচ্ছে। আজমত উল্লাহর তুলনায় সিলেটের প্রার্থী একেবারেই আনকোরা। নগরে ততোটা পরিচিতও নয়।'
তিনি বলেন, আরিফের প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের প্রচারে অনেকটা ঢিলেমি এসেছিলো। তবে গাজীপুরের ফলের পর তারা আবার শক্তভাবে মাঠে নেমেছেন। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও প্রচারে গতি বাড়িয়েছেন। সহজে যে জয় পাওয়া যাবে না এটি তিনি বুঝতে পারছেন।
তবে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলেও সিলেটে সেই আশঙ্কা নেই জানিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'গাজীপুর ও সিলেটের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সিলেটে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী নৌকার জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করছেন। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ কখনো পরাজিত হয় না। এটা সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আরেকবার প্রমাণিত হবে।'
তিনি বলেন, 'ইভিএম নিয়ে যারা এতোদিন নানা গল্পকথা বলছিলেন, গাজীপুরের নির্বাচনের পর তাদের মুখে কুলুপ পড়েছে। মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়েছে ভোটারদের বিভ্রান্ত করতেই ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছিলো।'
ইভিএম নিয়ে শঙ্কা, প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান মেয়র ও বিএনপির নির্বাহী সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। আর নির্বাচনে প্রার্থী হলেও একই শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মাহমুদুল হাসান। নজরুল বাবুল গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রার্থিতা নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলে শঙ্কা কিছুটা কেটেছে বাবুলের। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, 'গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে সামান্যতম সুযোগ পেলে ভোটাররা তাদের মতামত প্রকাশে উদগ্রীব। কিন্তু সিলেটে এখনো সে পরিবেশ তৈরি হয়নি। সিলেটে প্রতিদিনই আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কিন্তু নির্বাচন কমিশন এতে নিশ্চুপ।'
তিনি বলেন, 'গাজীপুরের নির্বাচনের পর ভয় কিছুটা কাটলেও ইভিএম নিয়ে অস্বস্তি পুরো দূর হয়নি। কারণ সিলেটের ভোটাররা ইভিএমের সাথে পরিচিত নন। তাদের আগে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। তাছাড়া ইভিএমে ভোট প্রদানের গতি অনেক মন্থর। অনেক সময় ইচ্ছে করেও মন্থর রাখা হয়। কোন কারচুপি করা না হলে সিলেটেও গাজীপুরের মতো নৌকার বিপক্ষে ভোট বিপ্লব হবে।'
এ ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, 'কেউ কেউ অটোপাসের স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু গাজীপুরের মানুষজন বুঝিয়ে দিয়েছে অটোপাসের সুযোগ নেই। জনতা সজাগ থাকলে ভোটচুরিরও সুযোগ পাওয়া যাবে না।'
এই তিনজন ছাড়াও সিলেটে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন জাকের পার্টির মো. জহিরুল আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুল হানিফ কুটু ও মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন।