ভাঙাচোরা রাস্তা যেভাবে পাঠ্য পুস্তকের সফল নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ খেলাপি বানালো
শূন্য থেকে উঠেছিলেন সাফল্যের শিখরে। সামান্য গৃহবধূ থেকে লুৎফা সানজিদা হয়ে উঠেছিলেন সফল উদ্যোক্তা। তার উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের সেই অদম্য গল্প স্থান পেয়েছে নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়েও। অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে কীভাবে সংগ্রাম এবং ধৈর্য্যের মাধ্যমে সফলতার উচ্চ শিখরে যাওয়া যায়, তা লেখা রয়েছে সেই গল্পে। কিন্তু আজ সবই যেন শুধু বইয়ের পাতায়। যার সংগ্রামী জীবন পড়ে শিক্ষার্থীরা ব্যবসায় উদ্যোগী হওয়ার দীক্ষা নিচ্ছেন, সেই লুৎফা সানজিদা আজ ভাঙাচোরা এক রাস্তা এবং অন্যান্য বেশকিছু অপ্রত্যাশিত প্রতিবন্ধকতার কারণে ঋণ খেলাপি।
লুৎফার জীবনের গল্পটা এখন তাই শূন্য থেকে শিখরে ওঠা এক উদ্যোক্তার ফের শূন্যে মিইয়ে যাওয়ার। এই নারী উদ্যোক্তার কাছে দুই লিজিং প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে।
লুৎফার কাছে বর্তমানে মাইডাস ফাইন্যান্সের ১ কোটি ৩০ লাখ ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ৮ লাখ টাকা খেলাপি হয়ে আছে।
পাওনা আদায়ে ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার (এনআই অ্যাক্ট) মামলা দায়ের করেছে মাইডাস ফাইন্যান্স। ঋণ খেলাপি হওয়া ও আইনগত ঝামেলায় পড়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন এক সময়ের সফল এই নারী উদ্যোক্তা।
লুৎফার ব্যবসায়ী হয়ে উঠা
নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বই ও লুৎফার সানজিদার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসএসসি পরীক্ষার আগেই ১৯৮৬ সালে বিয়ে হয় লুৎফা সানজিদার। স্বামীর ব্যবসায় টানা লোকসান হওয়ায় বিয়ের দুই বছর পর ১৯৮৮ সালে সংসারের হাল ধরতে বুটিকস হাউজের ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
প্রথম দিকে চকবাজার চকভিউ মার্কেটে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করলেও পরবর্তীতে (১৯৯৫ সাল) শোরুম দেন শপিং কমপ্লেক্সে। এরপর শোরুম খুলেন আমিন সেন্টারে। বুটিক শপের পাশাপাশি ততদিনে নগরীর হালিশহরে গড়ে তোলেন পার্লার ও স্পা সেন্টার।
সব মিলে ব্যবসা ভালোই চলছিল লুৎফার। স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ৪০ জন কর্মী কাজ করতো এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়িয়েছিল ৫০ লাখ টাকার বেশি।
অ্যাপার্টমেন্টে লোকসান ও ভাঙাচোরা রাস্তা
এরপর ২০১১ সালে হালিশহর এলাকায় নাইট'স স্কয়ার নামে নির্মাণাধীন ভবনে বাণিজ্যিক অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং দেন এই উদ্যোক্তা। মাইডাসের কাছ থেকে ৬৫ লাখ টাকা হাউজিং লোন নিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, ভাড়া করা দোকানের পরিবর্তে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ব্যবসা করা। কিন্তু ডেভলাপার প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করায় বিপাকে পড়েন লুৎফা। এক যুগের বেশি সময়েও বুঝে পাননি অ্যাপার্টমেন্ট; এদিকে যোগ হতে থাকে ঋণের সুদ।
লুৎফা সানজিদা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পার্লার ও স্পা সেন্টারের ব্যবসা ভালো হওয়ায় বুটিকস শপও হালিশহরে নিয়ে যাই। ব্যবসার টাকায় প্রথম কয়েক বছর অ্যাপার্টমেন্টের ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করি। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে।
আগ্রাবাদ অ্যাক্সেস রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড ও স্লুইচ গেট নির্মাণে ওই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে ওই সময় নগরীর অন্যান্য এলাকার লোকজন হালিশহরে যেত না। এতে দীর্ঘ তিন বছর ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। তিন বছর পর সড়কের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয় করোনা মহামারি।
"এভাবে টানা কয়েক বছর ব্যবসায় লোকসানের কারণে ঋণের টাকা শোধ করতে পারিনি। এছাড়া পারিবারিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিতে হয়েছে। এতে ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হই," যোগ করেন লুৎফা।
মাইডাসের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত রেডি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে হাউজিং ঋণ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি এই ঋণ প্রদানে। ভবন তৈরির আগেই অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ঋণ ছাড় দেয় মাইডাস।
বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটি মাত্র দোতলা। নিচ তলার ফ্লোরজুড়ে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়। দোতলার ছাদ ও দেয়াল থাকলেও পুরো ফ্লোর খালি পড়ে আছে। দোতলার পর উপরে আর কোনো ফ্লোর নেই। অথচ লুৎফা সানজিদার কেনা অ্যাপার্টমেন্টটি চতুর্থ তলায়।
অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য শূন্যের ওপর ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাইডাসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও চট্টগ্রাম শাখার ইনচার্জ মোহাম্মদ রহিম উল্লাহ্ বলেন, মাইডাস ফাইন্যান্স এর আগেও বেশ কয়েকবার সানজিদাকে ঋণ দিয়েছে এবং সেই ঋণ সময়মতো আদায়ও হয়েছে।
কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে কেন একটি অস্তিত্বহীন অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ঋণ মঞ্জুর করা হল, বিভিন্ন অজুহাতে এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান রহিম উল্লাহ।
মাইডাসের তথ্যমতে, লুৎফা সানজিদার ঋণটি বর্তমানে খেলাপি হয়ে আছে। এর আগে ২০১৯ সালে ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়ে পড়লে তখনি এই উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে চেক ডিজনার (এনআই এ্যাক্ট) মামলা দায়ের করে মাইডাস। বর্তমানে মামলাটি যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে যুক্তিতর্কের জন্য রয়েছে।
নতুন করে শুরু
বর্তমানে ছোট পরিসরে ঢাকাকেন্দ্রিক বুটিকসের ব্যবসা পরিচালনা করছেন লুৎফা সানজিদা।
তিনি বলেন, "এখনও আমার প্রোডাক্টের ভালো গ্রাহক আছে। কিন্তু প্রয়োজন বিনিয়োগের। করোনা মহামারিতে বড় বড় ব্যবসায়ীরা প্রণোদনা পেলেও আমরা কিছুই পাইনি।"
এই বিষয়ে চিটাগং ইউম্যান চেম্বার অব কর্মার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, "প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্য সৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগের কারণে উদ্যোক্তারা বিপদে পড়তে পারেন। তিন দশকের একজন নারী উদ্যোক্তা আজকে ঋণ খেলাপি হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আদালতে রায় হলে তাকে জেলেও যেতে হতে পারে। তাই এসব উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সহায়তা দিয়ে ব্যবসায় ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।"