বিটিআই কী? মশা নিধনে কেন উত্তর সিটি এই ব্যাকটেরিয়া আমদানি করেছে?
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে একটি বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস সেরোটাইপ ইসরায়েলেন্সিস (বিটিআই) নামক কীটনাশক ব্যাকটেরিয়া আমদানি করেছে।
এই জৈবিক লার্ভিসাইড (লার্ভাধ্বংসকারী) ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষ মশার বংশবৃদ্ধি কমাতে এবং রাজধানীতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হ্রাস করার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে। ডেঙ্গুর আক্রমণে এ বছর ইতোমধ্যে ২০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।
ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ সপ্তাহের শুরুতে প্রায় পাঁচ মেট্রিক টন বিটিআইয়ের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে।
তিনি বলেন, 'আগামী সপ্তাহে ট্রায়ালের পর আমরা উত্তর সিটির বিভিন্ন এলাকায় এটি ব্যবহার করতে পারব বলে আশা করছি। প্রথম পর্যায়ে আনা বিটিআই আমরা কমপক্ষে চার–পাঁচ মাস ব্যবহার করতে পারব। এটি কার্যকর প্রমাণিত হলে সারা বছর বিটিআই ব্যবহার করা হবে।'
ঢাকা উত্তর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কীটনাশক ব্যাকটেরিয়া কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে সিঙ্গাপুর থেকে দুজন বিশেষজ্ঞ এখানে আসবেন।
বিটিআই হলো এক ধরনের জৈবিক লার্ভিসাইড যা কার্যকরভাবে মশা ও মাছির লার্ভাকে ধ্বংস করে। এ ধরনের কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধির জলজ আবাসস্থলে এ কীটনাশক প্রয়োগ করলে এটি মশা-মাছির বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। আর বিটিআই ব্যবহারে মানুষ, পোষা প্রাণী, গবাদি পশু এবং উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষতি হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বিটিআই ভিন্ন প্রকৃতির এবং এটি ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে আরেকটি অস্ত্র। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি একটি জৈবিক সমাধান। এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিটিআই খুব একটা কার্যকর হবে না। এটি কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর। লার্ভিসাইড যদি এডিস মশার উৎপত্তিস্থলে না পৌঁছায় তবে তা কার্যকর হবে না। ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই এডিসের আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে।'
প্রতি বছর সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম এবং চিরুনি অভিযানের মতো নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এসব প্রচেষ্টা মশার বংশবিস্তার রোধে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি।
এ ধরনের সপ্তাহ বা মাসব্যাপী প্রচারণা মূলত মশা নিধনের জন্য নেওয়া হয়। তবে জটিল নামের এসব প্রচারণা যে নিষ্ফল তা ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকেই স্পষ্ট।
এছাড়া নগরবাসী জলাশয়ে হাঁস, ব্যাঙ ও গাপ্পি মাছ ছেড়ে এবং উড়ন্ত মশা নিধনের জন্য পাখির ব্যবহারের কর্তৃপক্ষের নানা প্রকল্পের সাক্ষী হয়েছে। এগুলো বাদেও ঢাকা উত্তর ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্গম জলাশয়ে মশার উৎস শনাক্ত করে ওষুধ ছড়িয়েছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণের জন্য একাধিকবার বিদেশেও গেছেন প্রতিনিধি দল। গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি-ডেড কাউন্টি থেকে ফিরে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এত দিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিধনের চেষ্টা করেছে।
মশা নিয়ন্ত্রণের আগের সমস্ত পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ায় এখন ঢাকা উত্তর লার্ভিসাইডিং প্রক্রিয়ায় বিটিআই ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে মশকনিধনে সফল হওয়ার প্রত্যাশা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটিআই প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী এবং টেকসই। সিঙ্গাপুর ও ভারতের কলকাতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি প্রধানত অণুজীব থেকে সৃষ্ট কম-বিষাক্ত কীটনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাকটেরিয়া প্রচুর পরিমাণে টক্সিন তৈরি করতে পারে, যার প্রভাবে কীটপতঙ্গের খাদ্যগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকা উত্তরের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন দেশ এই ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন করে। সিঙ্গাপুর, ভারতের বিভিন্ন শহর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন বিটিআই ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ুও এসব দেশের মতোই।
'কলকাতায়ও কিছু কোম্পানি বিটিআই উৎপাদন করে। কলকাতার একটি কোম্পানি এখানে বিটিআই বিক্রি করার জন্য আমাদের কাছে এসেছিল কিন্তু সস্তা হওয়ায় এটি সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে,' তিনি যোগ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুকুর, হ্রদ, নদী এবং ফোয়ারার মতো জলাশয়ে বিটিআই স্প্রে করা যায়। বদ্ধ পানিতে বিটিআই প্রয়োগ করলে এটি মশার বিকাশমান লার্ভাকে মেরে ফেলে।
বাড়ির আশেপাশের যেসব জায়গা ও পাত্রে — যেমন ফুলের টব, টায়ার, পাখির স্নানপাত্র ইত্যাদি — পানি জমে, সেখানে বিটিআই ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পুকুর, হ্রদ এবং সেচের নালার মতো পানির বড় আধারগুলোতেও ব্যবহার করা যায়।
১০০ লিটার পানিতে ১৫ গ্রাম বিটিআই মিশিয়ে দেড় বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছিটিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ওষুধটির কার্যকারিতা থাকে ৩০ দিন।
কিন্তু চোখে লাগলে বিটিআই দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত ঘটাতে এবং ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। বিটিআই মানুষের জন্য বিষাক্ত নয় এবং এটি জৈব চাষপদ্ধতিতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।