ভারতীয় চোরাই চিনির চাপে নিম্নমুখী দেশীয় বাজার
দেশে অবৈধভাবে কম দামের ভারতীয় চিনি ঢোকায়, দেশের বাজারে হ্রাস পাচ্ছে এই নিত্যপণ্যের দাম। একমাস আগে পাইকারিতে প্রতিকেজি চিনি ১৩৩-১৩৪ টাকা বিক্রি হলেও, এখন তা কমে ১২৩ টাকায় নেমে এসেছে।
দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বাড়তি দামে চিনি বিক্রি হয়ে আসছে দেশীয় বাজারে। পার্শ্ববর্তী দেশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হওয়ায় এবার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অবাধে ঢুকছে চিনি, যার চাপ পড়ছে দেশীয় চিনির বাজারে।
ভোগ্যপণ্যের দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, সোমবার (২২ আগস্ট) এই বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিমণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হয়েছে ৪,৫৯০-৪,৬০০ টাকায়। অথচ জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পণ্যটি লেনদেন হয়েছিল ৪,৯০০-৫,০০০ টাকার মধ্যে। সেই হিসেবে, একমাসের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিমণ চিনির দাম কমেছে ৪০০ টাকা।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী ও মেসার্স আরাফাত ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী বখতেয়ার উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি, সরকার পাইকারি ও খুচরা দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা মানেনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির বুকিং দর দেশিয় বাজারের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু দেশীয় আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে পণ্যটির দাম কমায় নি।
তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে পাইকারি বাজারে কিছুটা কমেছে চিনির দাম।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে চোরাই পথে আসা ভারতীয় চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১১৮-১২০ টাকায়। যেখানে আমদানিকৃত চিনির দাম ১২৩ টাকা।
বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। আগে প্রতিকেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হলে নতুন দাম অনুযায়ী এখন তা বিক্রি হবে ১৩০ টাকায়। এছাড়া প্যাকেট চিনি ১৪০ টাকা থেকে কমে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হবে। গত মাসে পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারে চিনির দাম কিছুটা কমেছে।
চট্টগ্রাম নগরীর এস এস খালেদ রোডের মুদি দোকানদার (জান্নাত স্টোর) নুরুল আবছার বলেন, "বর্তমানে খুচরায় প্রতিকেজি খোলা চিনি ১৩৫ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে, গত একমাসে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনির দাম কমেছে ৫ টাকা।"
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী আমান উল্লাহ জানান, "পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বর্তমানে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৬-৪৮ রুপিতে। সেই হিসেবে, ভারতে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৬৩ টাকার মধ্যে। যা চোরাই পথে প্রবেশ করে সীমান্তবর্তী হাটগুলোতে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর খাতুনগঞ্জে পৌঁছে এর দাম হয়ে যাচ্ছে ১১৮-১২০ টাকা কেজি।"
www.chinimandi.com এর তথ্যেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রোববার (২১ আগস্ট) ৩৬-৪৮ রুপিতে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হতে দেখা গেছে বলে জানান তিনি।
কনজুম্যার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ'র (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, পাশের দেশের চেয়ে দামের তফাৎ বেশি হওয়ায় চোরাই পথে পণ্য ঢুকছে বাজারে। এতে আপাত দৃষ্টে চিনির বাজার কিছুটা কমে আসলেও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। চোরাই পথে চিনি আমদানি বন্ধ করতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যটির দাম কমিয়ে আনতে হবে।
চিনি আমদানিকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ডিজিএম (সেলস) প্রদীপ কানন বলেন, "গত কয়েক মাস ধরে ভারত থেকে চোরাই পথে চিনি প্রবেশ করার বিষয়টি শুনে আসছি। তবে সম্প্রতি এটি খুব বেশি বেড়েছে। যে কারণে চোরাই চিনি এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে গত একমাস ধরে দেশিয় বাজারে চিনির দাম কমে গেছে। চোরাই পথে আসা চিনির কারণে দাম কিছুটা কমলেও এতে বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।"
সীমান্তে চোরাই চিনির প্রবেশ ঠেকাতে সিটি গ্রুপসহ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮-২০ লাখ টন। এরমধ্যে সরকারি মিলগুলো একসময় দেড়-দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। তবে সর্বশেষ দুই বছরে ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় উৎপাদন ৫০ হাজার টনের নিচে নেমে এসেছে। যে কারণে দেশের চিনি খাতটি প্রায় শতভাগ বেসরকারি মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এমনকি, এক সময় বড় কর্পোরেট গ্রুপগুলোর পাশাপাশি ছোট-মাঝারি অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন চিনির নিয়ন্ত্রণ ৮-১০ প্রতিষ্ঠানের হাতে।